সারা বাংলা

কেএনএফ’র তাণ্ডব: বান্দরবানের পর্যটন ব্যবসা চরম ঝুঁকিতে

সপ্তাহখানেক পরেই ঈদ, পহেলা বৈশাখ, সাংগ্রাইয়ের সরকারি ছুটি। পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বান্দরবানকে ঘিরে পর্যটকদের আগ্রহের শেষ নেই। পাহাড় আর মেঘের মিতালি দেখতে হাজারো পর্যটক প্রতিদিন ভিড় করেন এই জেলায়। দীর্ঘদিন ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ও পরবর্তীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে লম্বা সময় ধরে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ফলে দীর্ঘ সময় পর পর্যটন ব্যবসায় লাভের আশা করছিলেন তারা। 

সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) বান্দরবানে রুমায় সোনালী ব্যাংক ডাকাতির ১৫ ঘণ্টার মাথায় থানচি উপজেলার সোনালী ও কৃষি ব্যাংক লুটপাট করে নিয়ে যায় তারা। বর্তমানে বান্দরবানের পরিস্থিতি থমথমে। স্থানীয় বাসিন্দারাও রয়েছেন আতঙ্কে। এমন পরিস্থিতিতে বান্দরবানের পর্যটন সম্ভাবনা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করেন পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। 

পাহাড়ের বম, পাঙ্খুয়া, খুমি, ম্রো ও খিয়াং নামক ক্ষুদ্র ছয়টি জাতি-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠন করা হলেও এ সংগঠনে সিংহভাগ বম সম্প্রদায়ের। ফলে পাহাড়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ‘বম পার্টি’ নামেই বেশ পরিচিত। সর্বশেষ সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে তৎপরতা শুরু করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতিপূর্বে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল।

সেই আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত বছর অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। ওই সময় বান্দরবানে রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি ও আলীকদম কয়েক দফায় পর্যটক ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে স্থানীয় প্রশাসন। এ সময় পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। বহু আলোচনার পরে কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে কেএনএফ’র সশরীরে দ্বিতীয় দফা ৫ মার্চ বৈঠক হয়েছিল বেথেল পাড়ায়। বৈঠকে কেএনএফ আর সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এরইমধ্যে কেএনএফ আবার ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণের মত সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ায় পর্যটন শিল্প বড় হুমকির মুখে পড়েছে।

গত মঙ্গলবার ও বুধবার রুমা-থানচি দুই উপজেলায় তিনটি ব্যাংকে ডাকাতি ও অর্ধশত মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় কেএনএফ সদস্যরা। থানচি বাজারে ফাঁকা গুলি চালিয়ে জনসাধারণের মনে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয়রা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। 

বান্দরবান হোটেল মোটেল রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সমিতির সভাপতি অমল কান্তি দাশ বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জেলার পর্যটন ব্যবসায়ীরা। সামনে ঈদের ছুটি, পহেলা বৈশাখ, সাপ্তাহিক ছুটি উপলক্ষে আগত পর্যটকদের ভ্রমণ সুন্দর ও আনন্দময় করতে সকল হোটেল কক্ষগুলো সারা মাসব্যাপী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং নবরূপে সজ্জিত করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েক দিনের মধ্য প্রশাসনের সাথে পর্যটন ব্যবসার সংশ্লিষ্টরা পর্যটকদের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠক করবেন। ফলে আগত পর্যটকেরা ভালোভাবে ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবেন বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।

বান্দরবান হোটেল ও মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, সামনে ঈদ। প্রতি বছর ঈদের ছুটিতে বান্দরবানে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় থাকে। এ বছর পর্যটকদের অগ্রিম রুম বুকিং কম হচ্ছে। রুমা ও থানচিতে দিনদুপুরে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা সারাদেশে আলোচিত খবর হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পর্যটকরা বান্দরবান ভ্রমণে খুব বেশি আসবে বলে মনে হয় না। কেএনএফ ও সরকারের সাথে স্থায়ী কোনও সমাধান না হলে চাঁদাবাজি, ডাকাতি, অপহরণসহ নানা অপরাধের প্রভাব গোটা জেলায় পড়বে। 

রোয়াংছড়ি পর্যটক গাইড সমিতির সভাপতি পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, রোয়াংছড়ি উপজেলায় সরকারি রেজিস্ট্রেশনকৃত ৯৫ জন পর্যটক গাইড রয়েছেন। দীর্ঘদিন নিষেধাজ্ঞা থাকার পর ২২ জানুয়ারি প্রশাসন থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে তারা খুবই হতাশ। ঈদের ছুটিতে আশানুরূপ পর্যটক আসবেন কি না সন্দেহ রয়েছে। 

হোটেল হিল ভিও ব্যবস্থাপক মো. তৌহিদ পারভেজ বলেন, ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে কিছু দিন আগে থেকেই বেশ ভালো অগ্রিম রুম বুকিং হয়েছিল। পরে রুমা ও থানচি ব্যাংক লুটের ঘটনা ও কেএনএফ’র তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় অনেকে অগ্রিম বুকিং বাতিল করে দিয়েছে। এখন অগ্রিম বুকিংও হচ্ছে না। কেএনএফ’র তৎপরতার কারণে ঈদের সিজনে পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

বান্দরবান টুরিস্ট জোনের পুলিশ সুপার মো. মনজুর মোরশেদ বলেন, অন্যান্য বারের মতই ঈদের ছুটিতে পর্যটকদের নিরাপত্তার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ বছর রুমা ও থানচিতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে, যার কারণে এ বছর আরও বেশি নিরাপত্তায় সোচ্চার থাকবে পুলিশ। জরুরি কোনও প্রয়োজন ছাড়া টুরিস্ট পুলিশ কাউকে ছুটি দেওয়া হবে না। ঈদের ছুটির পরবর্তী বৌদ্ধদের ধর্মীয় বৈসাবি উৎসবেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকবে।

জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে আলাপ-আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।