মহান আল্লাহ তা’আলা যে সব দিনকে বিশেষভাবে বরকতময় ও মর্যাদাবান করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো জুমার দিন। এই দিনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে সংগঠিত হয়েছে অসংখ্য অলৌকিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা। মহামহিম স্রষ্টা পবিত্র কোরআনে ‘জুমআ’ নামে একটি সূরা নাযিল করে দিবসটিকে করেছেন আরো মহিমান্বিত। পুণ্যময় এই দিনটি মুমিনের জন্য সওয়াব বৃদ্ধি, গুনাহ মোচন ও দয়াময় স্রষ্টার নৈকট্য লাভের বিশেষ মুহূর্ত। মহিমান্বিত এই দিবস প্রতি সপ্তাহে আমাদের মাঝে ফিরে আসে।
হযরত আবু লুবাবা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, জুমার দিন সব দিনের সরদার। আল্লাহ তা’আলা এই দিনে আদমকে (আ.) সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে তাঁকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। এই দিনে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে মৃত্যুদান করেছেন এবং কেয়ামত এই দিনেই সংগঠিত হবে। (ইবনে মাযাহ)
জুমার দিন প্রসঙ্গে প্রিয়নবী (সা.) আরো ইরশাদ করেন, মুমিনের জন্য জুমার দিন হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন। (ইবনে মাযাহ)
জুমার দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো জুমার নামাজ আদায় করা ও খুতবা শ্রবণ করা। মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ! যখন জুমার দিনে জুমার নামাজের আযান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে (মসজিদে) গমন করো এবং ক্রয়-বিক্রয় (দুনিয়াবী যাবতীয় কাজকর্ম) বন্ধ করে দাও। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর; যদি তোমরা জানতে। (সূরা জুমআ, আয়াত -৯)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, জুমার দিন ফেরেশতাগণ মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে যান। প্রথম আগমনকারীর নাম প্রথমে; এভাবে মসজিদে আগমনকারীদের নাম লিপিবদ্ধ করেন। অতঃপর যে ব্যক্তি অতি প্রত্যুষে মসজিদে গমন করে, সে একটি উট সদকা করার সওয়াব লাভ করে। তারপর আগমনকারী গাভী, তারপর আগমনকারী দুম্বা, তারপর আগমনকারী মুরগি ও তারপর আগমনকারী ডিম সদকা করার সওয়াব লাভ করে। যখন ইমাম খুতবা প্রদানের জন্য আসেন অর্থাৎ খুতবা শুরু করেন, তখন ফেরেশতাগণ খাতা বন্ধ করেন এবং খুতবা শ্রবণে মশগুল হন। (বুখারী, মুসলিম)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে, অতঃপর জুমার নামাজের জন্য মসজিদে আসে, খুব মনোযোগসহ খুতবা শ্রবণ করে এবং খুতবার সময় চুপ থাকে, তার এই জুমা থেকে বিগত জুমা পর্যন্ত এবং অতিরিক্ত আরো তিনদিনের গুনাহ্ মাফ করে দেওয়া হয়। (মুসলিম)
হযরত আওস ইবনে আওস সাকাফী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) ইরশাদ করতে শুনেছি, যে ব্যক্তি জুমার দিন উত্তমরূপে গোসল করবে, প্রত্যুষে মসজিদে যাবে, পায়ে হেঁটে যাবে; কোনো বাহনে আরোহণ করবে না, ইমামের নিকটবর্তী হয়ে বসবে, মনোযোগসহ খুতবা শ্রবণ করবে এবং খুতবার সময় কোনো প্রকার কথা বা কাজকর্মে লিপ্ত হবে না, সে জুমার জন্য যত কদম হেঁটে আসবে, প্রত্যেক পদক্ষেপের বিনিময়ে এক বছরের রোজা ও তাহাজ্জুদ নামাজ পালনের সওয়াব লাভ করবে। (আবু দাউদ, তিরমিযি)
হযরত আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, জুমার দিনের গোসল চুলের গোড়া থেকে পর্যন্ত গুনাহ সমূহ বের করে দেয়। (তাব্রানী, মাজমায়ে জাওয়ায়েদ)
জুমার দিনে এমন বিশেষ মুহূর্ত রয়েছে, ঐ সময়ে যদি কোনো মুসলমান বান্দা অশ্রুসিক্ত নয়নে মহান স্রষ্টার দরবারে কোনো কিছু প্রার্থনা করে, দয়াময় আল্লাহ তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না; যদি সে হারাম জিনিস কামনা না করে।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, জুমার দিনে এমন এক মুহূর্ত রয়েছে, কোনো বান্দা যদি ঐ সময়ে আল্লাহর নিকট কিছু কামনা করে, আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই তা কবুল করেন। আর সেই মুহূর্তটি হলো আসরের পর।(মুসনাদে আহমদ) মুসলিম শরীফের রেওয়ায়েতে আছে, খুতবা শুরু হওয়ার পর থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত এর মধ্যবর্তী সময়।
জুমার দিনের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি আমল হলো, সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করা। হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করবে, সে ৮ দিন পর্যন্ত সর্বপ্রকার ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। আর যদি দাজ্জাল বের হয়, তবে সে দাজ্জালের ফেতনা থেকেও নিরাপদ থাকবে। (তাফসীর ইবনে কাসীর) অন্য রেওয়ায়েতে আছে, তার এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত সব (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন আসরের নামাজের পর না উঠে ঐ স্থানে বসা অবস্থায় ৮০বার নিম্নে উল্লেখিত দরুদ পাঠ করবে, তার ৮০বছরের গুনাহ মাফ হবে এবং ৮০বছর নফল ইবাদত করার সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হবে। দরুদ শরীফটি হলো: আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আলা আলিহী ওয়া সাল্লিম তাসলিমা।
প্রিয় পাঠক! জুমার দিনে আরো কিছু বিশেষ আমল ও আদব রয়েছে, যা নিম্নে উপস্থাপণ করছি। ১. গোছল করা ২. মিসওয়াক করা ৩. সুগন্ধি ব্যবহার করা ৪. যথাসম্ভব উত্তম পোষাক পরিধান করা ৫. আগে মসজিদে আসা ৬.সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে মসজিদে আসা ৭. ইমামের দিকে মুখ করে বসা ৮. খুতবার সময় ইমামের কাছাকাছি বসা ৯. মনোযোগ সহকারে খুতবা শ্রবণ করা এবং খুতবা চলাকালীন সময় চুপ থাকা ১০. দুই খুতবার মাঝখানে মহান স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা করা; এ ক্ষেত্রে হাত তোলা জরুরি নয় ১১. জুমার দিন ও জুমার রাতে বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা ১২. পরে মসজিদে এসে মুসুল্লিদের ডিঙিয়ে সামনে না যাওয়া; এরূপকারীদের ব্যাপারে প্রিয়নবী (সা.) কঠোর মনোভাব পোষণ করেছেন।
লেখক : মুফাস্সিরে কোরআন ও ইসলামী গবেষক