উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে এবার শুধু ‘হুমকিতে’ সীমাবদ্ধ থাকেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মন্ত্রী ও এমপিদের তাদের পরিবারের লোকজন এবং আত্মীয়-স্বজনকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে কঠোর সাংগঠনিক পথে হেঁটেছে দলটি। এতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হওয়ার পথে আপাত বাধা না দেখলেও প্রার্থীদের মনে শঙ্কার কালো মেঘ রয়েই গেছে। আত্মীয়-স্বজনকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখলেও ‘মাই ম্যান’ সংস্কৃতিকে রুখে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে বলে মনে করছেন তারা। যদিও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে প্রয়োজন অনুযায়ী কঠোর হবে দল।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও দলীয় নেতারা যেন কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ করতে না পারেন, সেজন্য কঠোর সাংগঠনিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে আ.লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রথম ধাপের নির্বাচন উপলক্ষে সারা দেশে প্রার্থীদের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনবিরোধী অবস্থান নেওয়ায় ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগকেও কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করতে হয়েছে। তাই আওয়ামী লীগ এবার দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেয়নি। দল ও দলের বাইরে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি যাতে নির্বাচিত হন, সেটাই আওয়ামী লীগ প্রত্যাশা করে।
দলের নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের মন্ত্রী-এমপি এবং কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে বিরক্ত আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোথাও কোথাও নেতাদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ আসছে কেন্দ্রে। সম্প্রতি নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নিজের ছেলেকে ভোট না দিলে উন্নয়নকাজ না করার হুমকি দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। নাটোরে লুৎফুল হাবিবের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে। এর আগে, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং টাঙ্গাইল-১ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের দুই নেতা। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দলীয় সভাপতির দপ্তরে অভিযোগ জমা দেন। নরসিংদী-২ আসনের এমপি আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারসহ নানা অভিযোগ তুলে কেন্দ্র লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং প্রার্থী সৈয়দ জাবেদ হোসেন। এসব খবরসহ নানা বিভেদের তথ্য দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর হলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংগঠনিক সম্পাদকদের নিয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বৈঠকে দলের দপ্তর সম্পাদক এবং উপ-দপ্তর সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন।
দলীয় সূত্র বলছে, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে দলীয় মন্ত্রী ও এমপিদের তাদের পরিবারের লোকজন এবং আত্মীয়-স্বজনকে নির্বাচন না করতে নির্দেশ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই নির্দেশ যারা অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বিরুদ্ধে দল বহিষ্কারসহ কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে বলে জানানো হয়েছে। ওবায়দুল কাদের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দপ্তরকে সারা দেশে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাদের স্বজন ও পরিবারের সদস্য নির্বাচন করছেন, সেই তালিকা তৈরির নির্দেশ দেন।
এ সময় তাৎক্ষণিকভাবে মাদারীপুর সদরের সংসদ সদস্য ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান এবং নোয়াখালীর একরামুল করিম চৌধুরীকে ফোন করে দলীয় সিদ্ধান্তের কথা জানান সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক।
পড়ুন- উপজেলা নির্বাচন নিয়ে হার্ডলাইনে আওয়ামী লীগ
দলীয় সূত্র বলছে, উপজেলায় মূল লক্ষ্য ছিল সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনটি প্রভাবমুক্ত রাখা। কিন্তু মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের ভোটে মাঠে নির্বাচন করিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকেও ব্যবহারের চেষ্টা করছেন তারা।
আগামী মাসের শুরুতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকা হতে পারে। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের উপজেলা নির্বাচন বিষয়ে তার নির্দেশনার কথা জানাতে পারেন। এ ছাড়া, শিগগিরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদেরও বৈঠক হতে পারে। সেখানেও এই নির্দেশনা আসতে পারে বলে দলের একটি সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, মন্ত্রী-এমপিদের পরিবারের লোকজনকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন থেকে দূরে রাখা গেলেও তাদের ‘মাই ম্যান’ ঠিকই মাঠ দাপাবে এবং তাদের পেছনে এমপি-মন্ত্রীদের প্রভাব থাকবে বলেও মনে করেন উপজেলার অন্য প্রার্থীরা। যদিও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে সম্ভাব্য সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করবে আওয়ামী লীগ।
দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল রাইজিংবিডিকে বলেন, নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে যারা দায়িত্বশীল, তাদেরও তো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। যদি না করেন, তখন নিশ্চয়ই সাংগঠনিক নিয়মে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট না করার বিষয়টি কিন্তু গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেখানে কোনও হস্তক্ষেপ ছিল না। যার যার মতো নির্বাচন হয়েছে। এতে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী বের হয়ে এসেছেন। উপজেলায়ও যাতে কোনওভাবে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন বা নিজেদের ‘মাই ম্যান’ দাঁড় করিয়ে কোনও মন্ত্রী-এমপি যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন; সেই বিষয়টির জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।