সারা বাংলা

পাহাড়ে দুর্বৃত্তের আগুন, প্রশাসন নির্বিকার

ভারতের সীমান্তঘেঁষা উত্তরের জনপদ শেরপুরের তিনটি উপজেলার বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে রয়েছে বনভূমি। গারো পাহাড়ের এই বনভূমির বিভিন্ন জায়গায় দিনে ও রাতে আগুন দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের গারো পাহাড়ের শাল-গজারির বনের অন্তত ১৫টি স্থানে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। স্থানীয়রা বলছেন, দুর্বৃত্তরা তাদের নিজের স্বার্থ হাসিল করার উদ্দেশে এমন ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আগুনে পুড়ে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ স্থানীয় প্রশাসন নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে।

অভিযোগ উঠেছে, কয়েকটি চক্র বনে আগুন দেওয়ার পেছনে জড়িত। শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে আগুন দিয়ে রাতের অন্ধকারে বনের মূল্যবান গাছ চুরি করছে চক্রের সদস্যরা। পাশাপাশি অসাধু বালু ও পাথর ব্যবসায়ীরা অসৎ উদ্দেশে বনের ভেতর আগুন দিয়ে ভীতির সৃষ্টি করছেন। বনের জমি দখল ও লাকড়ি সংগ্রহ করতেও দুর্বৃত্তরা আগুন দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা জানান, আগুনের কারণে নতুন গজিয়ে ওঠা চারাগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বনের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকির মুখে। 

জানা গেছে, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত সুফল বাগানের অধিকাংশ ছোট গাছই আগুনে পুড়ে গেছে। শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ি এবং ঝিনাইগাতী উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বন পোড়ানোর ঘটনা ঘটছে ঝিনাইগাতীতে। এই উপজেলার রাংটিয়া রেঞ্চ এলাকায় বেশি বনে আগুন দেওয়া হচ্ছে।

শুক্রবার জেলার সীমান্ন সড়কের রাংটিয়া রেঞ্জের গজনী বিট এলাকার গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের চারটি স্থানে বড় আকারে আগুন জ্বলছে। দুইটি স্থানে অল্প আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা বলেন, কে বা কারা ঘণ্টা খানেক আগে সেখানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে বন পোড়ানো হয়। এ মৌসুমে বনে আগুন দেওয়ার কারণে পুড়ে যায় ছোট গজারি গাছ (শালকপিচ), লতাপাতা, পোকামাকড় এবং বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ। আগুনের ফলে নতুন করে হচ্ছে না কোনো গাছ। 

রাতের অন্ধকারেও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে গারো পাহাড়ে

গারো পাহাড়ে বেশিরভাগ জমি শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছসমৃদ্ধ। প্রতি বছরের ফাল্গুন-চৈত্র মাসে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন গাছপালার পাতা ঝরে পড়ে। বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলাচলের জন্যে সড়কপথ থাকায় খুব সহজেই দুর্বৃত্তরা রাতে আবার কখনো দিনে বনে আগুন দেয়। ঝরা পাতাগুলো শুকনো হওয়ার কারণে মুহূর্তেই বনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এর পেছনে যারা জড়িত তারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় বছরের পর বছর চলছে বন পোড়ানোর এমন ঘটনা। 

বন বিভাগ জানায়, ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের আওতায় ৩টি বিট কার্যালয় রয়েছে। এই বিট কার্যালয়গুলোর আওতায় বনভূমি রয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৮৮০ একর। বিশাল এই বনাঞ্চল রক্ষার্থে নেই পর্যাপ্ত জনবল।

রাংটিয়া এলাকার বাসিন্দা হামিদ মিয়া বলেন, গত সোমবার বিকেলে রাংটিয়া রেঞ্জের ছোট গজনী এলাকায় গিয়ে দেখি, পাহাড়ের ভেতর থেকে ভেসে আসছে ধোঁয়া। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ছে বনের গাছপালাসহ ছোট ছোট চারা গাছ। বন বিভাগ বা ফায়ার সার্ভিসের কারও কোনও দেখা পাইনি সেখানে।

আগুনে পুড়ে যাওয়া গাছ 

ছোট গজনি এলাকার টারু মিয়া নামের এক কৃষক বলেন, আগুন যখন লাগে তখন আর কিছু করার থাকে না। শুকনো পাতা অপসারণ করলে আগুন থেকে বন বাঁচানো যাবে। আগুন লাগলে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

লাল মিয়া নামের স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘আগুন কে দিতেছে তাকে তো আমরা চিনি না। আমরা এই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করি, মাঝেমধ্যেই দেখি আগুন জ্বলতাছে। যদি সময় থাকে তখন আমরা কাছের আগুনগুলো নিভিয়ে দিই। ফরেস্টের লোকজন ওতো আর আসে না আগুন নিভাতে।’

স্থানীয় শিক্ষক রহমত আলী বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে বনের ঝরা শুকনো পাতায় প্রতিবছরই আগুনের ঘটনা ঘটে। মাঝেমধ্যে বিট কার্যালয়ের আশপাশের বনেও আগুন জ্বলতে দেখি। এরপরও এসব বন্ধের বিষয়ে কোনও উদ্যোগ নেই বললেই চলে। এভাবে চলতে থাকলে বন ধ্বংস হবে একদিন। তাই দ্রুত কঠোর নজরদারি বাড়িয়ে দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনা হোক।’

বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি ঝিনাইগাতী শাখার সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বন দরকার। আগুনে পুড়ে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন নির্বিকার। আমরা এর সমাধান চাই।

পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মেরাজ উদ্দিন বলেন, ‘গারো পাহাড়ের আগুনে গাছ ক্ষতিস্ত হচ্ছে। দুর্বৃত্তরা নিজেদের স্বার্থে গাছগুলো নষ্ট করছে। আমরা চাই, দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক। দুর্বৃত্তরা তাদের নিজের স্বার্থ হাসিল করার উদ্দেশে এমন ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আমরা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছি, যেন দ্রুত অপরাধীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা যাতে নেওয়া হয়।’ 

পরিবাশবাদী যুব সংগঠনের সভাপতি কবি ও সাংবাদিক রফিক মজিদ বলেন, ‘এই বন রক্ষায় আমরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন করি। সামাজিকভাবে মানুষকে সচেতন করি। এ ছাড়াও আমরা মানবন্ধন, প্রতীকী অনশনসহ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একাধিকবার স্বারকলিপিও দিয়েছি। কিন্তু, সবাই নির্বিকার। আমরা আমাদের গর্বের সম্পদ এই গারো পাহাড়কে রক্ষায় স্থায়ী সমাধান চাই।’

ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম বলেন, ‘এ সময়টাতে বিভিন্ন গাছপালার পাতা ঝরে পড়ে। দুই-তিন ইঞ্চি উঁচু স্তরে জমা হয়ে যায় পাতাগুলো। দুর্বৃত্তরা শুকনো পাতায় আগুন ধরিয়ে দিলে তা দ্রুত বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এক জায়গা আগুন নেভাই, পরে শুনি আরেক জায়গায় আগুন লেগেছে। আমরাও পড়ে গেছি মহাবিপদে। কারণ, আমাদের জনবল খুবই কম, এই কম জনবল দিয়ে এতো বড় পাহাড়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কিছুটা কঠিনই হয়ে পড়েছে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে পাহাড় রক্ষা কাজ করছি।’