আমাদের তিনজনের প্রথম দেখা হয় মর্গের সামনে। মর্গ মানে একটা টিন আর লোহার শিকের গেট। উপরে টিনের সাইনবোর্ডে লেখা- মর্গ। ভেতরে কী, ভেতরটা কেমন, আমি কেন এখানে, কেউই হয়তো ঠিক জানে না। কেউ হয়তো জানতেও পারে। কারণ সুফিয়ান আত্মহত্যা করেছে- ভোরে এ খবর পেয়ে ঘুম ভাঙলেও, আমার এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজেছে সকাল দশটা। সঙ্গত কারণেই সুফিয়ানের ফোন ছিল বন্ধ। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কার কাছে ঠিকঠাক খবরটা পাব। খবরটা সত্য না কি মিথ্যা, সত্য হলে সুফিয়ানের মৃতদেহটা এখন কোথায়, কী অবস্থায়; ঠিক কোথায় এলে সুফিয়ানকে একনজর দেখা যাবে ইত্যাদি খবরগুলো একত্রিত করে সিদ্ধান্ত নিতে বেশ সময় লেগেছে। শেষ পর্যন্ত মর্গের সামনে এসে দেখি এর মাঝেই সুফিয়ানের বন্ধু পরিজনসহ গোটা ত্রিশজন উপস্থিত।
এত দিন মর্গ শব্দটা মনে এলেই একটা উটকো গন্ধ নাকে এসে লাগতো। মনে হতো মর্গের সামনে গেলেই মরা লাশের ভুরভুর পচা গন্ধে নাড়িভুড়ি উলটে আসবে। কিন্তু আদতে এখন মর্গের সামনে বসে নাকে লাগছে চা পাতা জ্বাল দেয়ার ঘ্রাণ। নেশা ধরানো। যে গন্ধ নাকে ধাক্কা দিলে খাওয়ার ইচ্ছে সব নিয়ন্ত্রণের বাধ ভেঙে ছুটে যায়। অদূরে একটা চায়ের টং, টিনের চুলায় লাকড়ি পুড়িয়ে চা জ্বাল হচ্ছে, ঝুলানো পাউরুটি, কলা, কেক। মর্গ থেকে স্বজনের মৃতদেহ নিতে এসে মানুষ খিদা-তৃষ্ণা অস্বীকার করতে পারে না।
এখানে জমায়েত হওয়া সবাইকে আমি চিনি না। তবে আমাদের সহকর্মী দুজন, যাদের একজন আমাকে খবরটা দিয়েছিলেন; তিনিও আছেন। তার কাছে একবার জানতে চাই, কয়টা বাজতে পারে ওকে বের করতে? তিনি নিরুত্তর ঠোঁট উল্টান। যার অর্থ দাঁড়ায় তিনি ঠিক জানেন না। জমায়েত হওয়া গোটা ত্রিশেক মানুষের মতো আমিও অনিশ্চিত অপেক্ষায় যুক্ত হই। চারপাশটা অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখি কোথায় বসলে নির্বিঘ্নে ঘণ্টাকয় অপেক্ষা করা যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখে গভীর বিষাদ। আরোপিত বিষাদ নয়, একটা তরতাজা ছেলের অকাল মৃত্যুতে নেমে আসা বৈশাখের বিকেলে ঈশাণ কোণ কালো করে হঠাৎ জমা মেঘের মতো বিষাদ। মাঝবয়সী যে লোকটি রাস্তার পাশে বালির স্তূপে বসা, ধারণা করি তিনি সুফিয়ানের বাবা হবেন। কারণ তাকে ঘিরেই ভিড়টা বেশি। কেউ তাকে হাতের পত্রিকা দিয়ে বাতাস করছে। কেউ পানির বোতলের ছিপি খুলে দাঁড়িয়ে আছে, যদি তাকে খাওয়ানো যায়। কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এদের কাউকেই আমি চিনি না, সুফিয়ানের কী হয় তাও জানি না।
সুফিয়ান যার সাথে মেসে থাকতো, নাহিদ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে এনেছে- এই খবরটা জানি। সে মর্গের ভেতরটা দেখলে দেখে থাকতে পারে। আচ্ছা মর্গের ভেতরে এখন কী হচ্ছে? সুফিয়ানের গলা থেকে পেট বরাবর চিড়ে দিচ্ছে ডোম। সুফিয়ানের বুকের নিচে, পেট যেখানে শুরু সেখানে একটা বড় আঁচিল; মনে পড়ে আমার- আঁচিলটা কি কাটা পড়ছে ডাক্তারের ছুরির নিচে? প্রফেসর এক এক করে ছাত্রদের দেখাচ্ছে, এটা হৃৎপিণ্ড, এটা যকৃৎ। আমার এক কাজিন মর্গে পোস্টমর্টেমের ক্লাস করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিচ্ছু খেতে পারেনি কয়েকদিন। খাবার দেখলেই হড়বড় করে বমি করতো। আর বলতো, পেট কাটতেই কি বীভৎস গন্ধ! চোখের সামনে দিয়ে অধ্যাপক সাদা এপ্রোন পরা একদল ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে মর্গের দিকে গেলেন একটু আগেই।
নীল জামা আর গ্রে জিন্স পরা মেয়েটি সামনে এসে একটি সিগারেট ধরিয়ে আমার দিকে হাত বাড়ায় হ্যান্ডশেকের জন্য। আমি নব, নবনীতা। সুফিয়ানের বন্ধু। আমি সিগারেট খাই না। হ্যান্ডশেক করে সারিসারি দেবদারু গাছের একটার নিচে বসি। আমি রুমা, সুফিয়ানের... একটু থমকাই। আমি সুফিয়ানের কী? বন্ধুই সবচেয়ে নিরাপদ শব্দ। তাই বলি। নবনীতা নির্বিকার সিগারেট টানতে টানতে হঠাৎ দুয়েকটা শব্দ বলে ওঠে, কী করলো সুফিয়ান এটা! বলেই দু’হাঁটুর ভাঁজে মুখ লুকিয়ে আবার দৃষ্টি মেলে দেয় দূরে, সীমাহীন। স্পষ্টই বোঝা যায়, কাছে দূরের কিছুই দেখছে না সে। এই যে রোগীদের আসা-যাওয়া, যন্ত্রণা, চিৎকার, স্ট্রেচার, খুঁঁড়িয়ে চলা, রক্তের দালালের ছোটাছুটি কিছুই দেখছে না। ও দেখছে অন্যকিছু। সুফিয়ানকে ঘিরে নিকট অতীতের কোনো স্মৃতি। সিগারেটটা সামনের ইট বালির স্তূপে গুঁজে দিয়ে, আবার স্বগতোক্তি করে, আমি তো কোনো তাড়া দিচ্ছিলাম না। কারো উদ্দেশ্যে নয়, নিজের কাছেই নিজের বলা। কেউ শুনলেও আপত্তি নেই, না শুনলেও- এমনই নির্বিকার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার দু’হাঁটুর মাঝে থুতনি রাখে সে। কথাগুলো অস্পষ্ট নয়, স্পষ্টই। আমার যে কৌতূহল হয় না একথা বললে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করার মতো সম্পর্ক আমার নেই মেয়েটার সাথে। মাত্রই পরিচয়।
দূরে একা দাঁড়িয়ে থাকা মাথায় হিজাব পরা মেয়েটি অপরিচিত পরিবেশ আর মানুষের মাঝে অস্বস্তিকর দাঁড়িয়ে থাকা থেকে বাঁচতেই হয়তো আমাদের কাছে এসে বসে। আমি হাত ধরে এমনভাবে বসতে দেই, যেন কতকালের চেনা। মেয়েটি কোনো ভদ্রতার ধার না ঘেঁষে কেঁদে মাথা গুঁজে দেয় আমার ঘাড়ে। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। কে হয়, কী বলতে হবে, বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকি। মেয়েটি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি...আমি তারানা, সুফিয়ানের স্ত্রী।
সুফিয়ানের স্ত্রী! আমরা, আমি আর নবনীতা চমকে তাকাই একে অন্যের দিকে। এই মুহূর্তে এ নিয়ে আর কোনো কথা বাড়ানোর পরিবেশ এখানে নেই।
নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর মৃত্যুর মতো আহাজারি নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসতে থাকে। হুইল চেয়ারে আসে একটা যুবতী। মুখ ঢেকে রেখেছে ওড়নায়। ওড়নায় ছাপানো ফুল লতাপাতা ছাপিয়ে তার যন্ত্রণা আকাশে বাতাসে বেদনা ছড়ায়। স্বজনের অসহনীয় আর্তনাদ চারদিকে বিছিয়ে দিয়ে ভুস করে চলে যায় একটা অ্যাম্বুলেন্স। সেই আর্তনাদের বিষাদ গভীর থেকে গভীরতর হয় আরও বেলা বাড়ার সাথে সাথে। হাসপাতালের অদূরে মর্গ, হাসপাতালে ক্রমাগত আসতে থাকা রোগী, বিদীর্ণ বিষাদ থেকে মুক্তি নেই এর চারপাশের।
বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা হতে থাকে। আমি ইশারায় নাহিদকে ডাকি, নাহিদ আর কতক্ষণ? নাহিদ আবারও ঠোঁট উল্টায়, যার অর্থ অনিশ্চিত অপেক্ষার শেষ কখন সে জানে না। হয়তো তিন নারীকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করার জন্যই আবার বলে, শুনেছি রাত হবে, সকালেও দিতে পারে। কত ফর্মালিটিজ। দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার এখনো আসেনি। আমরা অপরিচিত তিনজন সুফিয়ানের মৃত্যুতে একত্রিত হয়েছিলাম, আবার একটা অনিশ্চিত রাত সামনে রেখে এক হয়ে যাই। নবনীতা জানায়, রাত ৯টার পর ও আর কর্মজীবী হোস্টেলে ঢুকতে পারবে না। এখান থেকে এখন রওনা হলেও ৯টার আগে কর্মজীবী হোস্টেলে পৌঁছানো অসম্ভব। তারানা তো সুফিয়ানের মেসেই থাকতো। ও আর কই যাবে! অগত্যা আমাদের তিনজনেরই গন্তব্য আমার বাসা। ভাগ্যিস একা একটা রুম সাবলেট নিয়ে থাকার ব্যবস্থা ছিল আমার।
সুফিয়ানকে শেষ দেখা হয় না আমাদের। হবে কিনা তাও এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের মতো আতঙ্কময় অনিশ্চয়তায় ঝুলে থাকে। সারাদিনের অপেক্ষা আর বিষাদময় ক্লান্তি আমাদের কতটা মিইয়ে দিয়েছে প্রাণশক্তি শুষে, বাসায় ফিরে টের পাই। টের পাই কারো জন্য যে জীবনের জৈবিক প্রয়োজন থেমে থাকে না, পেট জানান দিচ্ছে ভালোই। সারাদিন অভুক্ত আমরা। আমরা অপরিচিত তিনজন।
তারানা তেমন কোনো নাগরিক প্রাইভেসি কিংবা ভদ্রতার তোয়াক্কা করে না, কখনো জিজ্ঞেস করে, কখনো নিজেই খুঁঁজে চাল-ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি বসায়। ডিম ভাজি করে। সব সাজিয়ে ডাকলে হাতমুখ ধুয়ে আমরাও বসে যাই যেন এরকমই হওয়ার কথা। যেন আজ কোনো অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। আজকের আগে যে আমরা তিনজন অপরিচিত ছিলাম ব্যাপারটা উহ্যই থেকে যায় মুহূর্তের প্রয়োজনে। খিচুড়িতে আরেকটু লবণ লাগতো কিংবা একটুকরো লেবু হলে বেশ হতো- কথাগুলো আমরা বিনিময় করি নৈমিত্তিক স্বাভাবিকত্বে। সুফিয়ান নামে কেউ একজন অনুপস্থিত থাকে কিছুক্ষণ।
ঘরে রাত নেমে এলে বাতি নিভিয়ে আমরা ঘুমের ভাণ করি। বুঝতে পারি ঘুমের মতো নিঃশব্দে সুফিয়ান নেমে এসেছে আমাদের মধ্যে, আমরা তিনজনই তিনজনের অজান্তে আত্মদহনের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমরা তিনজনই আলাদা আলাদা অভিন্ন ভাবনা ভাবছি, আমার জন্যই কি...? আমরা আঁকুপাকু করি। সুফিয়ানের সাথে আমাদের কার সম্পর্ক কেমন এই ভাবনাটা আমাদের স্বাভাবিক মানবমনকে অস্থির করে, পীড়িত করে, কৌতূহলী করে। আমাদের কারো ঘুম আসে না। আমি মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজগুলো আনসেন্ট করি। কে জানে সুফিয়ানের মোবাইলটা এখন কার হাতে!
আমরা কখন কার তুমি হয়ে গেছি মনে নেই। তুমি সুফিয়ানকে কীভাবে চিনতে- আমি প্রশ্নটা শুরু করি; ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করে নিজেই বুঝি না। নবনীতা উত্তর দেয়, তবে প্রসঙ্গ পুরোই পাল্টে। আমি কি একটা সিগারেট খেতে পারি? নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই...আমি আশ্বস্ত করি। পাশ ফিরে শুয়ে থাকা তারানার অসুবিধা হবে কিনা জিজ্ঞেস করাটা বাহুল্য মনে করি। আমার ঘর, আমিই সিদ্ধান্ত দেয়ার মালিক। যতই আধুনিক হই এ জাতীয় সামন্ত চিন্তা আমাদের ক্রমোজমে গাঁথা। চাইলেই এড়াতে পারি না। তবে আধুনিক শিক্ষায় এটা শনাক্ত করতে পারি, ঘরটা আমার বলেই ঘরে থাকা সবার মতামত আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না।
নবনীতা অপূর্ব রিং বানায় সিগারেটের ধোঁয়ায়। রিংগুলো বাতাসে মিলিয়ে যেতে যেতে ও আমাকেই ফ্লোর দেয়, তুমিই আগে বলো। কীভাবে চিনতে সুফিয়ানকে? আমি আর সুফিয়ান গত কয়েকমাস ধরে একসাথে চাকরি করতাম। আমি অনার্স শেষ করেছি, মাস্টার্স করতে হবে। বাড়ি থেকে খরচ আনার মতো অবস্থা নেই, তাই আপাতত এই চাকরিতে ঢোকা। মাস্টার্সের পর ভালো চাকরি খোঁজা যাবে, গ্রামের ছাউনিতে তো আর ফিরে যাওয়া যাবে না। এই শহরেই টিকে থাকতে হবে। সহজ-সরল, প্রচলিত গল্প আমার। ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল ওর সাথে, হয় না একটা অফিসে সবাই তো একরকম নয়। কারো সাথে হয়ে যায় ভালো বন্ধুত্ব, যতটা বন্ধুত্ব হলে অগ্রিম বাসা ভাড়ার জন্য টাকা ধার নেয়া যায়। একসাথে থাকার জন্য ফেইসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে জিগাতলা শঙ্করের দিকে কম ভাড়ার বাসা খোঁজা যায়। প্রাণ আরএফএলের দোকানে প্লাস্টিক আর ইটালিয়ানোর বাসনপত্র দেখা যায় সংসার শুরু করার জন্য। শুরুটা ওর দিক থেকেই। আমার ওকে মন্দ লাগে না। জীবনে যখন থাকার ঠিকানা আর সঙ্গী লাগেই, সুফিয়ান হলে মন্দ কী! আমি জড়িয়ে যাই সুফিয়ানের সাথে। অফিস শেষ করে সুফিয়ান এই বাসায় প্রতিদিনই চলে আসতো। বলতে দ্বিধা নেই, আমরা শরীরে যেতাম। হ্যাঁ, প্রতিদিন। শুয়ে থাকা তোশক উলটে আমি কনডমের খালি প্যাকেটের স্তূপ... সুফিয়ান নেই। অথচ ওর স্পর্শ লাগা প্যাকেটগুলো...। আমি আজ শাওয়ার নেইনি, গতকালও ওর লালায় মাখামাখি হয়েছি, আমার গলা-বুকে এখনো লেগে আছে... আমি ঠিক করতে পারি না ওদের কি এসব কথা বলা যায়, কতটা বলা যায়? ওদের সাথে সুফিয়ানের সম্পর্কই বা কতখানি। পর মুহূর্তে ভাবি এখন আর বললেই কী, না বললেই বা কী!
নবনীতার চেহারার ভাষা অন্ধকার ঘরে পড়া যায় না, যেন মৃদু হাসির শব্দ শুনি। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নবনীতা। ফার্স্ট সেমিস্টার থেকে ও আমার বয়ফ্রেন্ড। আমি শব্দটায় একটু সন্দেহ ঢোকাই, বয়ফ্রেন্ড? আসলে আমি এখনো গা থেকে গ্রামের গন্ধ ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। প্রেম এই শব্দটির বাইরে বয়ফ্রেন্ড শব্দটি দিয়ে সম্পর্কের ঠিক কতটা গভীরতা বোঝায় বুঝতে পারি না। নবনীতা পরিষ্কার করে ওর মতো। হ্যাঁ, বয়ফ্রেন্ড। জাস্ট ফ্রেন্ড নয়। বিয়ে করার কথা ভাবছিলাম আমরা। আমার ভেতরের বিস্ময় যেভাবে ছিঁড়েফুঁড়ে মুখের ভাঁজে উঠে আসছে নবনীতা দেখতে পায় না। ও বলতে থাকে, আমার বাবা নেই, মা আমাকে এই ভয়েই ঢাকায় পড়তে দিতে চায়নি। সুফিয়ানের সঙ্গে প্রেম করছি, বিয়ে করে আমিও নবনীতা থেকে সুফিয়া হয়ে যাব... মা এটাকে বিশাল পরাজয় ভাবেন। বাড়ি গেলেই হাতেপায়ে ধরে কান্নাকাটি করেন। যে প্রাইমারি স্কুলটাতে তিনি চাকরি করেন, যে পাড়ায় আমার বাবার বাড়িটা, মায়ের ধারণা এর কোথাও তার চেহারা দেখানোর জো থাকবে না। মাকে আত্মহত্যা করতে হবে। নবনীতা আবার হা হা হা হাসে। মেয়েটির কি হাসির বাতিক? নইলে মায়ের আত্মহত্যার আশঙ্কার কথা বলে কেউ এভাবে হাসতে পারে!
তারানা যখন কথা বলে, মনে হয় দূরের মাঠের ওপার থেকে কেউ ডাকছে। তারানা সুফিয়ানের প্রেমিকা। উপজেলা সদরের কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করে ওখানেই একটা কিন্ডারগার্টেনে সামান্য বেতনের চাকরি। কিশোর বয়সের প্রেম, কো-এডুকেশন স্কুল। সুফিয়ান ঢাকায় পড়তে চলে এলেও সম্পর্কে ছেদ পড়েনি। ছুটিছাটায় বাড়ি গেলে দেখা হতো, চাই কি রাত গভীর হলেও। সুফিয়ানকে ছাড়া জীবন ভাবতেই পারে না তারানা। কিন্তু বাবা অন্যত্র বিয়ে দেখছেন। তাই পালিয়ে এসেছে ঢাকায়। সুফিয়ানের মেসেই আছে মেয়েটি। স্বামী-স্ত্রীর মতোই সংসার পেতে। এটুকু বলে মেয়েটি থামে। বাড়ি থেকে মৃতদেহ চলে গেলে আর্তনাদক্লিষ্ট স্বজনদের মধ্যে ক্ষণিকের স্তব্ধতা নামে, তেমনই স্তব্ধতা ঘরের অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে।
তারপর যেন অমাবস্যার নিঝুম রাতে মাঠের মাঝখানে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া হার্মাদের মতো আক্রমণ করে মেয়েটি, জানায় সে পাঁচ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা।
আমরা কেঁপে উঠি। আমি কিংবা নবনীতা, আমাদের সম্পর্কের রেশ খালিখাতায় পেন্সিলের দাগের মতো। সুফিয়ানের মৃত্যু ইরেজ করে দিয়েছে অনায়াসেই। কিন্তু তারানা যে কলমের দাগ বয়ে বেড়াচ্ছে। এই দাগ দেয়া পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু কীভাবে! কীভাবে ছেঁড়া যায় এই চিন্তা মুহূর্তে অন্ধকারে বিজলির মতো আমাদের দুজনের মস্তিষ্ক একইসাথে ছেদ করে।
তারানা বোধহয় ষষ্ঠন্দ্রিয়ে টের পায়। আবার মাঠের আরেক পার থেকে ভেসে আসা দূরবর্তী স্বরে বলে, বাচ্চাটা না হয় নষ্ট করে দেব। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথ যে আমার বন্ধ! আমরা তিনজন কেউ কাউকে চিনতাম না। মুহূর্তে একটা মৃত্যু ঘরের একটা খুঁটি হয়ে আমাদের বাকি তিন মাথায় দাঁড় করিয়ে দেয়।
প্রশ্নটা প্রথম তোলে নবনীতা। আচ্ছা সুফিয়ান আত্মহত্যা করল কেন? কেন করল? আমি জানি অফিসে বেতন হচ্ছিল না কয়েকমাস ধরে। আমি সুফিয়ানকে বলেছিলাম, চিন্তার কিছু নেই। গত সপ্তাহে অগ্রিম বাড়ি ভাড়ার টাকাটা আমি দিয়েছি। এজন্য ওর আত্মহত্যা করার কথা নয়।
নবনীতা বলে, প্রথম যখন খবরটা শুনি ভেবেছিলাম আমার জন্যই সুইসাইড করলো ও। বলতো, বাবা-মা কোনো দিন মেনে নেবে না। আমি ওকে আশ্বস্ত করেছিলাম। বলেছিলাম, তাড়া নেই, আমি অপেক্ষা করব। ও সময় নিক। মেনে নিয়েছিল সুফিয়ান। এজন্য তো ওর আত্মহত্যা করার কথা নয়।
আমারও তো তেমনই মনে হয়েছিল, তারানা বলে। আমার এভাবে হঠাৎ চলে আসায় ভীষণ বিপদে পড়ে গিয়েছিল সুফিয়ান। কী করবে, কোথায় রাখবে, কীভাবে চলবে। আমি ওকে আশ্বস্ত করেছিলাম, মায়ের অনেক গয়নাগাটি আর টাকাপয়সা নিয়ে এসেছি। এজন্য ওর আত্মহত্যা করার কথা নয়।
আমরা বুঝি। আমরা তিনজনই সুফিয়ানকে বিশ্বাস এবং ভরসা করেছিলাম। আশ্রয় দিয়েছিলাম। কিন্তু...কিন্তু আমরা এখন কী করব? আমরা তিনজন এখন কী করব?
নবনীতা অন্ধকারের ভাষা পড়তে পারে কি না জানি না। হঠাৎ দাঁড়িয়ে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে সুইচের অবস্থান দেখে। এগিয়ে ঘরের আলো জ্বালায়। যেনো গভীর পথ হারানো সুড়ঙ্গে হঠাৎ সূর্যরশ্মি ঢোকার পথ পায়। সেই সূর্যরশ্মিতে আমার মুখে অতিলৌকিক ভাষার মতো কথা ফোটে... জীবনে চলতে গিয়ে কতো মানুষ আমাদের জীবনে আসে। কেউ অল্প সময়ের,কেউ দীর্ঘ সময়ের... সেই স্মৃতি, সেই সময়, ফেলে আসা প্রতিশ্রুতি সব নিয়েই দিনশেষে আমরা একা আসলে। আমাদের যুদ্ধটা আমাদের যার যার। যতোক্ষন সুফিয়ানের সাথে ছিলাম নিজেদের নিংড়েই দিয়েছি, ঠকাইনি…।
হঠাৎ ছিনতাইকারীর মতো মগ্নতা কেড়ে নিয়ে আমার ফোনটা বেজে উঠলো। নাহিদ। সুফিয়ানকে মাটি দেয়ার জন্য গ্রামে রওয়ানা হবে এক্ষুনি, আমি কি একনজর দেখতে যাবো? পরে যতোই আফসোস করি, নাহিদকে যেনো দোষারোপ না করতে পারি, কণ্ঠে সেই দায়সারা ক্লান্তি স্পষ্ট। ও ভালো করেই জানে রাত তিনটায় এই রাষ্ট্রে কোনো মেয়ে একা মর্গের উদ্দেশ্যে বের হবে না। তারানা আর নবনীতা এমন আকুল চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে যেন এই শেষ রাতের ফোনটার জন্য আমাদের যুগ যুগান্তরের অপেক্ষা ছিল।
আমি যাবো না, নির্বিকার কণ্ঠে এই কথাটা নাহিদকে জানাতে আমি একটুও দ্বিধাবোধ করি না। ফোনটা রেখে বিষয়টা আমি তারানা আর নবনীতাকে জানাতে চাই, ঠিক তখন তারানা আর নবনীতার ফোন দুটোও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের মতো বুক কাঁপিয়ে একসাথে বেজে ওঠে। দুজনেই স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চোরের মতো বিস্ময় সামলায়। আমি বুঝেও না বোঝার ভাণ ধরে আগ্রহ গোপণ করি। ফোন রিসিভ করে গভীর রাতে একা রাস্তায় সামনে ঠাণ্ডা শীতল ফণা ওঠা সাপ দেখার মতো চমকে উঠে প্রায় একই সঙ্গে দুজনেই বলে ওঠে- সুফিয়ান, কই তুমি?