বরগুনার তালতলী উপজেলার নিউপাড়া গ্রামের হাচেন মোল্লার চার মেয়ে—রাহিমা বেগম, হালিমা বেগম, ফাতেমা বেগম ও জরিনা বেগম। তাদের কোনো ভাই নেই। বাবা দরিদ্র কৃষক ছিলেন।
গরিবের ঘরে জন্ম চার বোনের। বাবা মেয়েদের খাবারের যোগান দিতে পারতেন না। প্রায় অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হতো তাদের।
চার বোন বাধ্য হয়ে খরস্রোতা পায়রা নদীতে মাছ শিকার শুরু করেন। নৌকা নিয়ে নদীতে গিয়ে কখনো জাল দিয়ে, কখনো বড়শি দিয়ে চলে তাদের মাছ শিকার। সেই মাছ বাজারে বিক্রি করেন। আয় দিয়ে সংসার চালান। ছেলে-মেয়েদের মুখে অন্ন তুলে দেন। তবে, বড় বোন রাহিমা বেগম (৬৬) অসুস্থ থাকায় এখন আর নদীতে যেতে পারেন না। তিন বোন এখনও মাছ ধরতে যান।
একসময় চার বোন লোকলজ্জার ভয়ে রাতে মাছ শিকার করতেন। কিন্তু, পরে লজ্জা ভুলে দিন-রাত মিলিয়ে মাছ শিকার করা শুরু করেন। আগে নদীতে মাছ বেশি ধরা পড়ত। একদিকে বড়শি পাততেন, অন্যদিকে জাল। এখন মাছ কম, তাই আয়ও তেমন নেই। এখন কোনো দিন ২০০-৩০০ টাকার মাছ ধরতে পারেন। কোনো দিন আরও কম।
মেয়ের ভরণপোষণ দিতে না পারায় বাবা অল্প বয়সে হালিমাকে বিয়ে দেন। তবে, সেই বিয়ে সুখের হয়নি। হালিমা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে অভাবের মধ্যে বড় হইছি। অভাবের সঙ্গে বাপে না পাইরা ১১ বছর বয়সে বিয়া দিয়া দেছে ৪৮ বছরের পুরুষের সঙ্গে। যেই খাওনের অভাবে বিয়া দিছে, সেখানে যাইয়া দেহি সতীন আছে ঘরে। খাওনের কষ্ট আর গেল না। এর পর থেকে শুরু করলাম বড়শি দিয়া নদীতে মাছ ধরা। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে মাছ ধরি।’
৬২ বছর বয়সী হালিমা বলেন, ‘এই মাছ ধরেই পোলাপান বড় করেছি। পোলাপাইনরে খাবারের কষ্ট পাইতে দেই নাই।’
১৪ বছর বয়সে প্রথম মা হন হালিমা। তবে, সেই ছেলে বাঁচেনি। এক বছরের মাথায় মারা যায়। এর পর ১৬ বছর বয়সে দ্বিতীয় ছেলে, আর ১৮ বছর বয়সে মেয়ের জন্ম হয়। স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। তাই, মাছ শিকার করে, সেই মাছ বিক্রি করে ছেলে-মেয়েদের তিন বেলা খাবার খাইয়েছেন।
হালিমার আরেক বোন ফাতেমা বেগম (৫৫) নদীতে নৌকায় করে মাছ ধরেন। ফাতেমা বেগমের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। স্বামী অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তিনি নিউপাড়া থেকে খরস্রোতা পায়রা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বড়শি ফেলে মাছ শিকার করে সংসার চালান।
সবার ছোট জরিনা বেগম (৫২)। এক ছেলে ও এক মেয়ের মা তিনি। তারও বিয়ে হয় গরিবের ঘরে। স্বামীর একার আয়ে সংসার চলত না। তাই, বোনদের সঙ্গে তিনি মাছ শিকারে যেতেন। আর এখন স্বামী প্যারালাইসিস হয়ে অচল।
তিনি মাছ ধরে দুই সন্তানকে লেখাপড়া শিয়েছেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে জমিতে চাষাবাদ করে সংসার চালান। তবে, স্বামী আর নিজের কথা চিন্তা করে এখনও মাছ শিকার করছেন জরিনা।
জরিনা বেগম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মাছ শিকার করলেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। তবে, আগে যে অনাহারে থাকতাম, এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না। নিজে অনাহারে থেকে ক্ষুধার যন্ত্রণা বুঝেছি। তাই, সন্তানদের কখনো ক্ষুধার যন্ত্রণা বুঝতে দিইনি।’
ফাতেমা বেগম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘একটা সময় আমরা বোনেরা মাছ ধরতাম, তাই এলাকার মানুষ হাসাহাসি করতেন। কিন্তু এখন প্রশংসা করেন।’
নিউপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফজলে উদ্দিন রাইজিংবিডিকে বলেন, ওরা চার বোন মাছ শিকার করে জীবন কাটাল। তবে, সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দিতে পেরেছেন। তারা সকলে সমাজের সকলের সঙ্গে মিলেমিশে চলেন, সৎভাবে জীবন যাপন করেন।