দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশেনর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের চার বছর পূর্ণ করলেন মো. আতিকুল ইসলাম।
২০২০ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ‘সুস্থ ঢাকা, সচল ঢাকা ও আধুনিক ঢাকা’ এই তিন রূপরেখার মাধ্যমে তিনি দিয়েছিলেন ৩৮টি প্রতিশ্রুতি।
রাজধানী ঢাকাকে স্মার্ট সিটি করার লক্ষ্য নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি নগরবাসীর কাছে যেসব ওয়াদা করেছিলেন, তার বেশকিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। কিছু চলমান আছে; কিছু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটিতে মো. আতিকুল ইসলাম মেয়র হিসেবে দ্বিতীয়বার শপথ নেন। আগের মেয়রের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার নিয়ম আছে। এজন্য তিন মাস পর ওই বছরের ১৩ মে দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব নেন আতিকুল ইসলাম।
মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে অংশ নিয়ে নয় মাস মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন মো. আতিকুল ইসলাম।
সোমবার (১৩ মে) ডিএনসিসির মেয়র হিসেবে এই মেয়াদে চার বছর পূর্ণ হলো তার। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চার বছরে নগরে অনেক অবকাঠামো উন্নয়ন করেছেন তিনি। তবে এখনো অনেক প্রকল্পের কাজ চলমান। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নাগরিক সেবা সহজ করার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি।
ডিএনসিসির মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই জলাবদ্ধতা নিরসন, অবৈধ দখলে থাকা খাল উদ্ধার, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, যানজট নিরসন, মশা নিধন, পরিবেশবান্ধব সড়ক বাতি স্থাপন, পার্ক-খেলার মাঠ আধুনিকায়ন, ডিএনসিসি করোনা হাসপাতাল চালু, পাবলিক টয়লেট স্থাপন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নগরের উন্নয়নে সমঝোতা চুক্তিসহ জলাশয় রক্ষায় কাজ শুরু করেন আতিক।
সুস্থ ঢাকা প্রতিশ্রুতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করা, বর্জ্য অপসারণসহ ড্রেনের বর্জ্য নিয়মিত পরিষ্কার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাসাবাড়ির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (বর্জ্য রাখার বড় ঘর) তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পও চলমান। কারওয়ান বাজার আড়ত মার্কেটের দোকান স্থানান্তরের প্রক্রিয়াও চলমান। অগামী এক বছরে প্রতিশ্রুতির বাকি কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন বলে আশাবাদী মেয়র আতিকুল ইসলাম।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুস্থ, সচল ও আধুনিক ঢাকা গড়তে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা বাস্তবায়নে আমি বদ্ধপরিকর। প্রতিশ্রুতি ধরে ধরে বেশকিছু কাজ করেছি, আবার কিছু কাজ করা সম্ভব হয়নি। তবে ধাপে ধাপে নগরে অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করার চেষ্টা করছি।
মেয়র বলেন, কাজের মাধ্যমে মানুষের আস্থা-ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছি। আমি সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি নগরবাসীকে স্বস্তিতে রাখার। আমার প্রতি নগরের মানুষের অস্থা-বিশ্বাসই আমার কাজের শক্তি। ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে শেষ পর্যন্ত কাজ করে যাব।
মো. আতিকুল ইসলাম
চার বছরে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে-সে বিষয়ে ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, সুস্থ ঢাকা ইশতেহারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র। উত্তর সিটি এলাকায় এক হাজার ২৫০ কিলোমিটার ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার করছে ডিএনসিসি। এছাড়া বাসাবাড়ির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নগরের বিভিন্ন এলাকায় ৫৫টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। আমিনবাজারে ল্যান্ডফিলে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ডিএনসিসির প্রকৌশল দপ্তর সূত্র জানায়, গত চার বছরে ২৪টি পার্ক ও খেলার মাঠ উদ্বোধন করা হয়েছে। চলতি বছর উদ্বোধন করা হয়েছে গুলশানের ডা. ফজলে রাব্বি পার্ক।
এছাড়া মিরপুরে প্যারিস রোড মাঠ পরিত্যক্ত ছিল। মাঠটি শিশু-কিশোরদের খেলার জন্য সংস্কার করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন নাগরিকদের যেসব সেবা দিয়ে থাকে এর মধ্যে মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণ অন্যতম। এজন্য ডিএনসিসি ৫৪টি ওয়ার্ডে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়া বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশা নিধনে ল্যাব স্থাপন এবং পাঠ্যপুস্তকে এডিস মশা সম্পর্কে সচেতনতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যবস্থা নিয়েছে ডিএনসিসি। সকাল-বিকাল লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং করছে। এডিসের লার্ভা পেলে ম্যাজিস্ট্রেটরা জরিমানা করছেন।
যেসব পরিত্যক্ত দ্রব্যে পানি জমে এডিসের লার্ভা জন্মাতে পারে, সেসব দ্রব্য সিটি করপোরেশন কিনে নিচ্ছে। ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপ, দইয়ের কাপ, পুরনো টায়ার, কমোড, রঙের কৌটা-এগুলো ডিএনসিসির কাউন্সিলরদের কাছে নিয়ে গেলে তারা কিনে নিচ্ছেন। বায়ুদূষণ রোধে জার্মান প্রযুক্তির অত্যাধুনিক স্প্রে-ক্যানন ব্যবহার করছে ডিএনসিসি। এছাড়া ১০টি ওয়াটার ব্রাউজার দিয়ে দৈনিক চার লাখ লিটার পানি ছিটানো হয়।
চলমান তাপদাহের মধ্যে চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনের পরামর্শে স্প্রে-ক্যাননের মাধ্যমে নগরীর বিভিন্ন স্থানে পানি ছিটানো হচ্ছে। গত বছর ৮০ হাজার গাছ লাগিয়েছে উত্তর সিটি। চলতি বছর আরও এক লাখ ২০ হাজার গাছ লাগানো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মেয়র আতিক দায়িত্ব নেওয়ার পর গত চার বছরে ডিএনসিসির বিভিন্ন এলাকায় ৪৯টি নতুন পাবলিক টয়লেট স্থাপনসহ ১৫টি সংস্কার করা হয়েছে।
এসব পাবলিক টয়লেটে নারী ও পুরুষদের জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। এছাড়া গোসল, অজু, লকার, ব্রেস্ট ফিডিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে। ডিএনসিসি মেয়র নগরীর অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন। রাস্তা নির্মাণে সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ পেতে হলে অবশ্যই তা ২০ ফুট প্রশস্ত হতে হবে। এমন নির্দেশনার পর মিরপুরের মোল্লা রোড, আদর্শ রোড, পীরের বাগ, কাওলাসহ বিভিন্ন এলাকায় ২০ ফুট চওড়া করে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। ২০২১ সালে ওয়াসা থেকে ২৯টি খালের দায়িত্ব বুঝে পায় ডিএনসিসি। এরপর খাল উদ্ধার, খনন, পরিষ্কার, খালের পার সবুজায়ন, সাইকেল লেন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ শুরু করে ডিএনসিসি। ইসিবি স্কয়ার থেকে কালশী পর্যন্ত ৩.৭০ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্ত করেছে সংস্থাটি।
জলাবদ্ধতা নিরসনে কুইক রেসপন্স টিম গঠন করেছে ডিএনসিসি। জনদুর্ভোগ দূর করতে কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া এলাকায় ওয়াসা থেকে পাওয়া ড্রেনেজ অংশ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন করা হয়েছে।
২০২১ সালে প্রথমবারের মতো ডিএনসিসি ডিজিটাল পশুর হাট চালু করেন মেয়র। গত বছরও ডিজিটাল পশুর হাট আয়োজন করে সংস্থাটি। এবারো ডিজিটাল পশুর হাটের আয়োজন করা হবে বলে জানা গেছে।
ঘরে বসেই একজন গ্রাহক অনলাইনের মাধ্যমে ট্রেড লাইসেন্স পাচ্ছেন। কিউআর কোডভিত্তিক রিকশার লাইসেন্স, ক্যাশলেস মার্কেট ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিএনসিসি-১, খিলগাঁও তালতলা মার্কেটকে কিউআর কোডভিত্তিক ক্যাশলেস মার্কেট হিসেবে ঘোষণা করেছে ডিএনসিসি। টিকাদানের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ই-ট্র্যাকার জিআইএসের মাধ্যমে শিশুদের তথ্য সংগ্রহ করে টিকা দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, যেসব প্রতিশ্রুতি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি, তার মধ্যে রয়েছে-স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা চালু, সুনিয়ন্ত্রিত ও নারীবান্ধব গণপরিবহন চালু। এছাড়াও ‘জনতার মুখোমুখি মেয়র’ শীর্ষক নিয়মিত মতবিনিময় করে ওয়ার্ডভিত্তিক সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত এসবের বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
মেয়র বলেছিলেন, নির্বাচিত হলে তিনি ফুটপাত দখলমুক্ত করে এলাকাভিত্তিক পথচারীবান্ধব ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য ফুটপাত নেটওয়ার্ক তৈরি করবেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিকদের জন্য গণস্থাপনা এবং গণপরিবহন নিশ্চিত করবেন।
ডিএনসিসির ব্যস্ততম এলাকায় নির্মাণ করার কথা ছিল, বহুতল ও আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং কমপ্লেক্স। নাগরিকদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য পরিকল্পিত স্মার্ট বাসস্টপ ও বাস-ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করবেন বলেছিলেন। আধুনিক ঢাকা গড়ার লক্ষ্যে একটি সার্বক্ষণিক ডিজিটাল কমান্ড সেন্টার তৈরি করে শহরের নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও স্মার্ট নেইবারহুড পরিচালনা এবং বায়ুদূষণ রোধে ইলেকট্রিক বাস সার্ভিস চালু করারও কথা বলেছিলেন আতিকুল ইসলাম।
এছাড়া মিরপুরে উত্তর সিটির নিজস্ব জায়গায় বৃক্ষপ্রেমীদের জন্য বৃক্ষ ক্লিনিক ও পোষ্য প্রাণী ক্লিনিক নির্মাণ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত উদ্যোগ দেখা যায়নি।
মেয়র যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার কতটা বাস্তবায়িত হলো-এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভোটারদের আকৃষ্ট করতে এখতিয়ারের বাইরে গিয়েও অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। চাইলেও এর মধ্যে অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশনকে তদারকির দায়িত্ব বেশি করে পালন করতে হবে।
রিকশাচালকদের ছাতা দেন ডিএনসিসির মেয়র
তিনি বলেন, বড় প্রকল্পের জন্য অপেক্ষা না করে ছোট ছোট পরিসরে কাজ করে যেতে হবে। এই পরিকল্পনাবিদ খাল উদ্ধারে উত্তর সিটির নেওয়া উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, খাল রক্ষা করতে হলে এ কাজে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করতে হবে। জনগণের কাছে করা অঙ্গীকারের পুরোটা বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও সেসব বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।