ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে অর্থ সময় বয়স কোনো কিছুই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। আর সেই ভ্রমণ পিয়াসী যদি মোটরসাইকেল রাইডার হন তাহলেতো কোনো কথাই নাই। মোটরসাইকেল নিয়ে দীর্ঘতম যাত্রার বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন আর্জেন্টিনার এমিলিও স্কটো। ১০ বছরে তিনি ৭ লাখ ৩৫ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার সময় ২১৪টি স্বাধীন দেশ ও অঞ্চল পরিদর্শন করেছিলেন। দীর্ঘ এই যাত্রায় তার সঙ্গী হয়েছিল হোন্ডার গোল্ড উইং জিএল ১১০০ বাইকটি। নিজের এই বাহনটিকে এমিলিও আদর করে ডাকতেন ‘ব্ল্যাক প্রিন্সেস।’
আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সের বাসিন্দা স্কটো শৈশব থেকেই বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৮০ সালে স্কটো তার প্রথম মোটরসাইকেল হিসাবে হোন্ডা গোল্ড উইং জিএল ১১০০ কিনেছিলেন। পরবর্তী চার বছরে বাইকটি দিয়ে ৪৮ হাজার কিলোমিটার পথ চলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে স্কটো চাকরি ছেড়ে দেন। ভ্রমণের জন্য অর্থের সংস্থান করতে নিজের সব জিনিসপত্র বিক্রি করে দেন তিনি। বিক্রি শেষে তার হাতে সর্বসাকুল্যে জমা হয় মাত্র ৩০৬ মার্কিন ডলার।
হাল জামানায় মোটরসাইকেল নিয়ে বিদেশ যাত্রা করতে গেলে কত কিছুর জন্যই না প্রস্তুতি নিতে হয়। অথচ স্কটোর কোনো স্পনসর ছিল না, কোনো ক্রেডিট কার্ড ছিল না, কোনো যোগাযোগ ছিল না। এমনকি তিনি কখনো আর্জেন্টিনার বাইরে যাননি। এর পরেও স্কটোর স্বপ্ন তিনি বিদেশ ভ্রমণ করবেন।
স্কটোর এই মটোট্যুরের শুরুটা ভালো ছিল না। প্রথম বর্ডার ক্রসিং ছিল আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ে। উরুগুয়ের সীমান্ত কর্মকর্তারা তার বাইকে থাকা বোচকাবুচকি দেখে উচ্চস্বরে হেসেছিল। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তারা বলেছিল, ‘বিশ্বভ্রমণে যাচ্ছেন? আপনার সঙ্গে থাকা জিনিসপত্রের যা বহর তাতে মনে হচ্ছে মহাবিশ্বের চারপাশে ঘোরাঘুরি করার জন্য আপনার কাছে যথেষ্ট জিনিসপত্র রয়েছে।’ স্কটো সেই অপমান গায়ে মাখেননি।
উরুগুয়ে হয়ে ব্রাজিল এবং গ্ল্যামারাস শহর রিও ডি জেনেরিওতে যান স্কটো। সেখানে ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে হয়েছিল তাকে। এর ফলে স্কটোর হাত প্রায় শূন্য হয়ে যায়। দৈবক্রমে ওই এলাকার একটি ধনী পরিবারের একজন যুবকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন স্কটো। বন্ধুর সহায়তায় স্কটো শিগগিরই আবার উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করেন তিনি।
ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই পৃথিবীর ঘন জঙ্গল আমাজনে পৌঁছান স্কটো। সেখানে, তাকে বলা হয়েছিল, জঙ্গলটি যানবাহন চলাচলের জন্য দুর্গম, তার উচিত আর্জেন্টিনায় ফিরে যাওয়া। তবে হাল ছাড়েননি স্কটো। তিনি আমাজন নদী দিয়ে ব্রাজিলের মানাউসে তার মোটরবাইকটি নিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজের খোঁজ লাগান। শেষ পর্যন্ত পেয়েও যান।
সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করতে গিয়ে স্কটো বলেন, ‘আমার গোল্ড উইং এবং আমি ছাড়াও জাহাজটিতে তিন ডজন রুক্ষ চেহারার লোক ছিল। আমি যখন তাদের দেখেছি এবং কথা শুনেছি, তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এরা অপরাধী শ্রেনির লোক, সমাজের প্রান্ত সীমানায় বসবাসকারী লোক। এরা এমন দস্যু বা অপরাধী ছিল যারা জঙ্গলে থাকলে কর্তৃপক্ষ বিরক্ত করবে না।’
একদিন রাতে এই দলের মধ্যে কয়েকজন তাস খেলা শুরু করে। দলটির নেতা স্কটোকে এই জুয়ার আসরে না বসার জন্য সতর্ক করেছিল। তবে যখন খেলা শুরু হলো, তখন তাকে একরকম জোর করেই আসরে বসানো হয়। জুয়ার টেবিলে ছিল স্থানীয় মুদ্রা, সোনা, বন্দুক ও ছুরি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্কটো পরপর পাঁচটি গেমেই জিতেছিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অন্য জুয়াড়িরা বলেছিল, সে প্রতারণা করছে। এমনকি স্কটোকে লক্ষ্য করে বন্দুকও তাক করে ফেলে। এদের মধ্যে এক জন হুমকি দিয়ে বলেছিল, জাহাজ থেকে তীরে সে জীবিত নামতে পারবে না। পরিস্থিতি দেখে স্কটো তার জেতা জিনিসগুলো ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এতে আরও ক্ষীপ্ত হয় দস্যু দলটি। ওই রাত পুরোটাই নিদ্রাহীন কেটেছিল স্কটোর। পরের দিন সূর্যোদয়ের সময় মানাউসে জাহাজটি নোঙ্গর করে। স্কটোর সেই সঙ্গীরা জাহাজ থেকে তার দিকে চোখ টিপে হাসছিল। দলটির নেতা স্কটোকে কাগজের একটি টুকরা দিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল ‘তোমার যাত্রা শুভ হোক।’
দলটির নেতা স্কটোকে বলেন, ‘এর আসলে আপনাকে ইচ্ছা করেই জিততে দিয়েছিল, যাতে তারা আপনার ভ্রমণের জন্য আর্থিক সহায়তা করতে পারে। এই পুরুষরা পশু, কিন্তু তারা আপনার যাত্রা চালিয়ে যেতে সাহায্য করতে চেয়েছিল এবং আপনার সাথে একটু মজাও করতে চেয়েছিল।’
উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ ভ্রমণ শেষে ১৯৮৭ সালে স্কটো পূর্ব ইউরোপে প্রবেশ করেন। এখানে ওই সময় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজমের প্রভাব। সরকারের কঠোর দমন নীতির কারণে নাগরিকরা ওই সময় বিদেশিদের সঙ্গে তেমন কোনো আলাপচারিতাতেই যেতো না। পুরো সফরটিতেই চুপচাপ কাটাতে হয়েছে স্কটোকে। এরপর তিনি প্রবেশ করেন আফ্রিকায়।
আফ্রিকা ভ্রমণের সময় স্কটোকে অসংখ্য অপ্রত্যাশিত জিনিসের মুখোমুখি হতে হয়- নতুন ভূমি, মারাত্মক পরিস্থিতি, নতুন নিয়ম, নতুন বিশ্বাস, নতুন বাস্তবতা, ক্ষুধার্ত শিশু, সেনাবাহিনীর লড়াই, মানব বলি, নরখাদক এবং আরও অনেক কিছু। ওই সময় তার আর্জেন্টিনায় ফেলে আসা প্রেমিকার কথা মনে পড়ে। তুরস্ক ও ইরানের সীমান্তে পৌঁছেই তিনি প্রেমিকা মনিকাকে ফোন দেন। স্কটো ভারতে এসে পৌঁছলে সেখানে হাজির হন মনিকা ভারতে। দিল্লিতে দুজন মিলে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলেন। বিয়ের পর মনিকা অবশ্য স্কটোকে কানে ধরে আর্জেন্টিনায় ফেরত নিয়ে যাননি। উল্টো গোল্ড উইংয়ে সওয়ার হয়ে নব দম্পতি ছুটলেন বিশ্বের বাকী দেশগুলোতে ট্যুর দিতে।
স্ত্রী মনিকার সঙ্গে স্কটো
বাংলাদেশে প্রবেশের সময় গোল্ড উইং এর গিয়ার শ্যাফ্ট নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশি এক ট্রাক চালক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন স্কটোর দিকে। ট্রাকটি আলু পরিবহণ করছিল। ওই ট্রাক চালক আলু নামিয়ে গোল্ড উইংকে ট্রাকে তোলেন। ভারী এই বাইকটি ট্রাকে তুলতে ২০ জন লোক লেগেছিল। বাইক ট্রাকে ওঠানোর পর পুনরায় আলু লোড করা হয়। অতিরিক্ত ওজনের কারণে ট্রাকটি ৪৫ ডিগ্রি হেলেছিল। ঢাকায় আসার পর ট্রাক ড্রাইভার একটি পয়সাও নেননি স্কটোর কাছ থেকে।
ঢাকায় স্কটো ও তার স্ত্রী মনিকাকে একটি বিলাসবহুল হোটেল কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। ঢাকার অনেকেই ওই সময় স্কটো ও মনিকাকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। স্কটোর বাইকটি বিনা পয়সায় মেরামত করে দিয়েছিল বাংলাদেশের হোন্ডা কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ সফর শেষে স্কটো ও মনিকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোর উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
আগেই বলেছি, স্কটো তার পুরো এই সফরে পাড়ি দিয়েছিলেন ৭ লাখ ৩৫ হাজার কিলোমিটার। তার এই দীর্ঘ যাত্রায় শুধুমাত্র একবার বাইকের ইঞ্জিন পরিবর্তন করতে হয়েছিল। ১০ বছরের এই ভ্রমণে প্রায় ১৩টি পাসপোর্টের সবগুলো পাতা পূর্ণ করেন তিনি। তার গোল্ড উইং জিএল ১১০০-এর জন্য খরচ হয় ৪৭ হাজার লিটার তেল, ১ হাজার ৩০০ লিটার ইঞ্জিন অয়েল, পরিবর্তন করা হয় ৮৬টি টায়ার, ১২টি ব্যাটারি এবং ৯টি সিট।