সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগ (এসওই) বা সরকারি সংস্থা ও কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি মৌল ভিত্তিসম্পন্ন শেয়ারের সরবরাহ বাড়িয়ে দেশের পুঁজিবাজারকে আরও জোরদার করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন। গত ৯ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এ নির্দেশকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।
তবে, দীর্ঘদিন ধরেই পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেতৃত্বে কাজ করে যাচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। সরকারি কোম্পানিগুলোর অনাগ্রহের কারণেই কয়েক দফা চেষ্টা করেও তাদেরকে পুঁজিবাজারে আনা সম্ভব হয়নি। অবশেষে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে গতিশীল করতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাভুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই, প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে অর্থ বিভাগকে সহযোগিতা করতে চায় ডিএসই। এরই ধারাবাহিকতায় বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে ডিএসই সূত্রে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার চার দিন আগেই অর্থাৎ ৫ মে সরকারি কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি লক্ষ্যে সচেতনতামূলক কর্মসূচির আয়োজন করতে চেয়ে অর্থ বিভাগকে চিঠি দেয় ডিএসই। সরকারি কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এ আয়োজন করতে চায় ডিএসই। এ বিষয়ে কাজ করতে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ডিএসই যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। আগামী সপ্তাহে এ সচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজন করা হতে পারে বলে ডিএসই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
এদিকে, বাজার প্রতিযোগিতামূলক করতে কোন কোন সম্ভাবনাময় সরকারি প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে অর্থ বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার আগে সম্ভাবনাময় সরকারি কোম্পানিগুলোকে যথাযথ যাচাই-বাছাই করে নির্বাচন করতে বলা হয়েছে। বিষয়টি চূড়ান্ত করতে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবে অর্থ বিভাগ। এ কাজে অর্থ বিভাগকে প্রস্তাবনা দিয়ে সহযোগিতা করতে চায় ডিএসই। কীভাবে প্রস্তাবনা দেওয়া যায়, সেজন্য ডিএসইর ম্যানেজমেন্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ব্রোকারেজ হাউজদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনকেও (বিএমবিএ) এ বিষয়ে প্রস্তাব দিতে বলেছে ডিএসই। শিগগিরই এ সংক্রান্ত প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানো হবে। এ বিষয়ে সম্মিলিতভাবে অর্থ বিভাগকে সহযোগিতা করবে ডিএসই।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা উচিত। ভালো মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের অবদান রাখবে। এছাড়া, পুঁজিবাজারের প্রতি সরকারের দায়িত্ব বাড়বে। এতে সরকারি কোম্পানিগুলোর অব্যবস্থাপনা অনেকাংশে কমে যাবে। কোম্পানিগুলোতে জবাবদিহির কারণে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বেড়ে যাবে। পুঁজিবাজারের স্বার্থে ও স্বচ্ছতা বাড়ানোর লক্ষ্যেই সরকারি কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করা উচিত। এতে লোকসানে থাকা সরকারি কোম্পানিগুলো মুনাফায় ফিরবে। এর সুফল পাবেন বিনিয়োগকারীরা।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে মাত্র ২০টি সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। এগুলোর বাজার মূলধন ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১২ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। এরপর নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও আর কোনো কাজে আসেনি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো হলো—এটলাস বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড (বিডি সার্ভিস), বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস কোম্পানি (বিএসসিসিএল), বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ইস্টার্ন কেবলস, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইবিসি), যমুনা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, ন্যাশনাল টিউবস, পদ্মা অয়েল, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, রূপালী ব্যাংক, শ্যামপুর সুগার মিলস, তিতাস গ্যাস, উসমানিয়া গ্লাস সিট ফ্যাক্টরি ও জিলবাংলা সুগার মিলস।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হাফিজ মুহম্মদ হাসান বাবু রাইজিংবিডিকে বলেছেন, পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়াতে ভালো ভালো কোম্পানির পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। যেটা আমাদের পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরেই নেই। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজার উন্নয়নের সরকারি কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির যে নির্দেশ দিয়েছেন তা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আগে থেকেই ডিএসই কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা সরকারি কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির লক্ষ্যে সচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজন করতে চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়েছি। আগামী সপ্তাহে এ কর্মসূচি আয়োজন করতে পারব বলে আশা করছি। এছাড়া, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারে, এমন সম্ভাবনাময় সরকারি কোম্পানিগুলোকে যাচাই-বাছাই করার ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগকে প্রস্তাবনো দিয়ে সহায়তা করবে ডিএসই। এজন্য ডিএসই ম্যানেজমেন্ট, ডিবিএ ও বিএমবিএ সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে সব ধরনের সহযোগিতা করবে ডিএসই।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেছেন, পুঁজিবাজারে সরকরি কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত হতে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা অত্যন্ত প্রজ্ঞাময় আদেশ। এ কাজে যারা বাধা দেবে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এখন শুধু সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বলে দেওয়া উচিত যে, এ কাজে যারা সহযোগিতা করবে না, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। তাহলে ছয় মাসের মধ্যে পুঁজিবাজারে নতুন নতুন সরকারি কোম্পানিকে দেখা যাবে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হতে সরকারি কোম্পানিগুলো নানা ধরনের অজুহাত দেখাবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে কঠোর হতে হবে। অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি আছে, যা সরকারের অধীনে থাকার কারণে লাভজনক হতে পারছে না। সেসব কোম্পনির ৫১ শতাংশ শেয়ার পাবলিকের কাছে বিক্রি করতে হবে। এর ফলে ওই কোম্পনিগুলোর মালিকানায় বা পরিচালনা পর্ষদে শেয়ারহোল্ডার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বেশি থাকবে। তখন সরকারি কোম্পানিগুলো ইচ্ছে করলেও লোকসানে থাকতে পারবে না। যেসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে আছে, তাদের আরো বড় অংশের শেয়ার পাবলিকের কাছে ছাড়তে বা অফলোড করতে হবে।