প্রবল ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা ও আম্পানের পর আরও একবার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব দেখল উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের মানুষ। প্রতিবার ঘূর্ণিঝড় এসে লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূলবাসীর ঘরবাড়ি, জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নেয় মাছের ঘের ও ফসলের ক্ষেত। রক্ষা পায় না বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূল অতিক্রম করার পর যতই সময় গড়াচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে ধ্বংসলীলার ক্ষতচিহ্ন।
রোববার (২৬ মে) বিকাল থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত তাণ্ডব চালিয়ে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা, রামপাল, মোরেলগঞ্জ, কচুয়া ও বাগেরহাট সদরসহ প্রায় সব কটি উপজেলায় ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রমের এক দিন পেরিয়ে গেলেও বহু মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। গাছ পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের ধানসাগর গ্রামে ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন সময়ে গাছ চাপায পড়ে ফজিলা বেগম নামে নারীর মৃত্যু হয়।
শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন খান মহিউদ্দিন জানান, ‘প্রতিবছর আমাদের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরা। রোববার বিকাল থেকে ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিপাত হয়ে সোমবার পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। ফলে আমাদের এলাকায় বহু মানুষের ক্ষতি হয়েছে। প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই গাছপালা ভেঙে পড়েছে। গাছ চাপায় এক নারীর মৃত্যুও হয়েছে। গাছ পড়ে বিদ্যুতের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখনও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছি। শুধু আমার ইউনিয়ন নয়, আশপাশের প্রায় সব এলাকায় কিছু না কিছু ক্ষতি হয়েছে।’
মঙ্গলবার (২৮ মে) বিকালে বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের ভাইজোড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটা বাড়িতে প্রায় তিন থেকে চার ফিট পানি জমে আছে। পার্শ্ববর্তী পানগুছি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে এসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা বিউটি বেগম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময়ও আমাদের এলাকায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এবারও ঘূর্ণিঝড় হয়ে আমার সব শেষ হয়ে গেছে। কয় দিন আগে ধান কেটে ঘরে রেখেছিলাম। সোমবার রাতে হঠাৎ পানগুছি নদীর পানি এসে আমাদের এলাকা ডুবে যায়। আমার ঘরের ভেতরেও কোমর সমান পানি উঠে যায়। ঘরে রাখা চার-পাঁচ বস্তা ধান নষ্ট হয়ে গেছে। চুলার ভেতরে পানি উঠে গেছে। এলাকা থেকে পানি নামার সুব্যবস্থা না থাকায় এখনও উঠানে হাঁটু সমান পানি। কী খাব, কে আমাদের সাহায্য করবে, কিছুই বুঝতে পারছি না।’
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল বিরুনী বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বাগেরহাটের বেশকিছু বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সোমবার (২৭ মে) দুপুর পর্যন্ত জেলার মোট ১.৪৮ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এখনও বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। জেলায় মোট কতটুকু বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে, তা এখুনি বলা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, মোরেলগঞ্জ উপজেলার শ্রেণিকালী ও বাগেরহাট সদর উপজেলার গোপালকাটি এলাকায় বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো চিহ্নিত করে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন বলেন, এই ঝড়ে ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৫ হাজার ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৯ লাখ টাকা, ১১ হাজার কেজি চিড়া, ৭০০ কেজি গুঁড় ও ২০ হাজার প্যাকেট বিস্কুট দেওয়া হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে সারা দিন বৃষ্টি না হওয়ায়, বাগেরহাটবাসী স্বাভাবিক হচ্ছেন।
ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রম করার পর দিন বাগেরহাটের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হলেও এখনো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে বাগেরহাট উপকূলের ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার গ্রাহক।
বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার সুশান্ত কুমার মজুমদার বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা পুরো এলাকা পরিদর্শন করতে পারিনি। তবে যেসব এলাকা আমরা পরিদর্শন করেছি, সেসব এলাকায় মোট ১১৪টি পোল ভেঙে গেছে। হেলে পড়েছে ২১৭২টি পোল। ১ হাজার ৫৪১টি তার ছিঁড়ে গেছে। ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে ৩৭টি। মিটার ভেঙেছে ৪৯৮টি। ক্রস আর্ম ভেঙেছে ৭৩টি। সার্ভিস ড্রপ তার ছিঁড়েছে ৪৬৭টি এবং ইন্সুলেটর ভেঙেছে ৮৩টি।
তিনি বলেন, সকল লাইনম্যান, ঠিকাদারের লোকবল এবং স্থানীয় লেবার একযোগে লাইন পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। ঝড়ে লাইনে পতিত শত শত গাছ কেটে অপসারণ করার পাশাপাশি ছেঁড়া তার মেরামত করে বাগেরহাট সদর উপজেলার কিছু কিছু জায়গায় সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখনও প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
তিনি বলেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে এবং মাঠ পর্যায় থেকে এই বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি লাইন রক্ষণাবেক্ষণ কাজ অব্যাহত রয়েছে। সম্পূর্ণ লাইন মেরামত করতে আরও ৩-৪ দিন সময় লাগতে পারে।
এদিকে, জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে বাগেরহাটের বেশ কিছু মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রামপাল উপজেলার মাছ চাষিরা।
রামপাল উপজেলার বাইনতলা ইউনিয়নের চাকশ্রী গ্রামের চিংড়ি চাষি শেখ নূর ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবার ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে আমাদের মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ের রাতে অতিরিক্ত জোয়ারের পানির চাপে আমার ঘেরের বাঁধ ভেঙে যায়। এতে প্রায় প্রায় এক লাখ টাকার চিংড়ি মাছ ভেসে গেছে। আশপাশের অনেকের ঘের তলিয়ে গেছে।’
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বাগেরহাটের ৩৫ হাজার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে চাষিদের প্রায় ৭০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া মাছের ঘেরের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি মিলে মোট ৭৩ কোটি টাকা হবে। এখনও বিভিন্ন স্থানে ঘেরগুলো পানিতে প্লাবিত রয়েছে। যার ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। পুনরায় মাছ চাষের জন্য চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় থেকে স্থলভাগকে রক্ষা করতে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় সুন্দরবন। প্রতিবারের মতো এবারও ঢাল হয়েছিল বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী এ ম্যানগ্রোভ বনটি। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানিয়েছে বন বিভাগ। ঘূর্ণিঝড়ের পর দিন সকাল থেকে বনের অভ্যন্তরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে কাজ শুরু করে বন কর্মীরা। একদিনে বনের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৩৯টি মৃত হরিণ, একটি বন্য শুকর এবং অর্ধশতাধিক আহত হরিণ উদ্ধার করেছে তারা। এছাড়া বন বিভাগের বিভিন্ন অফিস, নৌযান ও গাছগাছালির ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানিয়েছে সুন্দরবন বিভাগের খুলনার বনসংরক্ষক মিহির কুমার দে।
তিনি বলেন, পূর্ব বন বিভাগের কটকা অভয়ারণ্যের অফিস ঘাটের জেটি ও পুকুর বঙ্গোপসাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দুবলা, কটকা, কচিখালী, বগিসহ বিভিন্ন বন অফিসের ২৫টি টহল ফাঁড়ির রান্নাঘর, অবকাঠামোর টিনের চালা উড়িয়ে নিয়ে গেছে। সুন্দরবনের ৮০টি মিঠাপানির উৎস পুকুর ৮-১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বনকর্মীদের পাশাপাশি প্রাণিরাও সুপেয় পানির সংকটে পড়েছে।