ভারতের সীমান্তঘেঁষা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীঅধ্যুষিত জেলা শেরপুর। এখানে গারো পাহাড় এবং তার আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী এই জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি। কিন্তু, সেখানে যাতায়াত ব্যবস্থা তেমন ভালো নয়। চিকিৎসাসেবার জন্য নেই কোনো ক্লিনিক। শত বছরের কৃষি পেশা ছেড়ে এখনো তারা বিকল্প আয়ের কোনো উৎস সৃষ্টি করতে পারেননি। মূলত, উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে পিছিয়ে পড়ার কারণে সবার থেকে পৃথক চলতে পছন্দ করেন তারা। তাই, নিজেদের এগিয়ে নিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নেতাদের দাবি, আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যেন তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়।
জানা গেছে, ১৩৬৩.৭৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের শেরপুর জেলায় প্রায় ১৬ লাখ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তজুড়ে কোচ, হাজং, বানাই, হদি ও গারো জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করেন। এদের মধ্যে গারো ২৬ হাজার, বর্মন ২২ হাজার, হদি ৩৫০০, কোচ ৪ হাজার, ঢালু ১৫০০, হাজং ৩ হাজার ও বানাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১৫০ জন মানুষ বসবাস করছেন। যদিও মোট হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার ফারাক রয়েছে। ওইসব এলাকায় দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নে দুই-একটি স্কুল থাকলেও সেটা অপ্রতুল। এছাড়া, সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ক্ষুদ্র এসব নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও তাদের তৈরি বিখ্যাত কিছু শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। অর্থাভাবে সেগুলো ধরে রাখতে পারছে না তারা। যেমন- কোচদের তৈরি তাঁত শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। গারোদের তৈরি মাছ ধরার চাই, খালই, টেডা, কুলা, চালুন, ঘুটনি, ঝাড় এখন তৈরি কমে যাচ্ছে।
প্রবীণ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতা ডা. সৃতি কুমার বলেন, আমরা সমাজের সব চেয়ে অবহেলিত মানুষ। আমাদের চলাচলের রাস্তার খুবই খারাপ অবস্থা। এতোটাই খারাপ যে, একজন গর্ভবতী নারীকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হলে রাস্তায় তারা বাচ্চা হয়ে যায়। পাহাড়ি জনপদে সমতলের মানুষের ১০ ভাগ সুবিধাও পৌঁছায়নি।
আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্প (আইইডি) এর ফেলো সুমন্ত বর্মণ বলেন, আমাদের শেরপুর জেলার তিনটি উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় বসবাস করে। তারা যেসব এলাকাগুলোতে বসবাস করে সেখানে কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। বিশেষ করে রাস্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও ক্লিনিক নেই। সেখানকার মানুষরা কয়েক প্রজন্ম থেকে একই পেশা ধরে রেখেছেন। কোনো নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়নি। ফলে জীবন যাত্রার মান বাড়েনি। সমস্যা দূর করতে বিশেষ বরাদ্দ ছাড়া কোনো উপায় নেই। সরকার আমাদের মতো বিশেষ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না। তাই আসন্ন বাজেটে আমাদের জন্য আলাদা বরাদ্দ চাই।
বাংলাদেশ ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার জাতীয় সংসদে বাজেট পাশ করবেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি সমতল অঞ্চলে যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছেন তাদের জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ রাখা হয় না। পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বাজেটে কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। আমরা মনে করি, এটা বৈষম্যমূলক আচরণ। আমরা সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাবো, সমতল অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনমান ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা হোক।
শেরপুর নাগরিক প্লাটফর্ম জনউদ্যোগের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আসলে তাদের (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী) দাবি যৌক্তিক। আমাদের দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু, পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী উন্নয়নের স্রোতে আসতে পারেনি। এরা দিনদিন আরও পিছিয়ে যাচ্ছে। এদের পিছিয়ে যাওয়ার অন্যমত কারণ রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। এদের মূল সমস্যা হচ্ছে শিক্ষা ও কাজের অভাব। এই বিষয়গুলোতে রাষ্ট্রের আলাদাভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। তাদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের আলাদা বাজেট প্রয়োজন। যাতে তারা সামনের দিকে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।
শেরপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য এডিএম শহিদুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য এলাকাগুলোতে আলাদা বরাদ্দ থাকলেও আমাদের এখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগণের জন্য তেমন কোনো বরাদ্দ নেই। সমতলের এই জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে বাজেটে আলাদা বরাদ্দের ব্যাপারে অবশ্যই জাতীয় সংসদে কথা বলবো।