মতামত

ক্ষুব্ধ প্রকৃতি, বিপদ দোরগোড়ায়, মানুষ তখন ঠেলাঠেলিতে 

সর্বত্রই গরমের বিভীষিকা! তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশের গ্রাম, শহরসহ প্রতিটি জনপদ। প্রচণ্ড গরমে পিচের রাস্তা নরম হওয়ায় রেললাইন বেঁকে যাওয়ার খবর আসছে। হিটস্ট্রোক ও তাপপ্রবাহজনিত মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। কৃষি উৎপাদনব্যবস্থার সর্বনাশ! আবহাওয়া অফিস দেশজুড়ে বার বার জারি করছে হিট অ্যালার্ট। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অসুস্থ হচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। 

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বেড়ে চলছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন এলাকা তাপে পুড়ে ছারখার হওয়ার অবস্থা। ভারতে ৫৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে। পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকার তাপমাত্রা ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। ফিলিপাইনে ৫০ ও মিয়ানমারে ৪৮ ডিগ্রি। 

গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে প্রখর হচ্ছে প্রতিটি গ্রীষ্ম। আর তাপমাত্রা নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি করছে। তাপপ্রবাহ রীতিমতো দুর্যোগে রূপ নিয়েছে। এবারের এপ্রিল/মে মাসজুড়ে ৪২/৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়মিত তাপমাত্রা। কংক্রিটের আধিক্যে প্রচণ্ড গরমে ঢাকা শহর যেন গনগন করছে। তাপশোষণকারী কংক্রিট উত্তাপ বাড়ানোর সাথে সাথে তাপমাত্রাও বেশি সময় ধরে রাখছে। তারপর শিল্প-কলকারখানা, অফিস আদালত, শপিং মল, যানবাহন ও এসির তাপমাত্রা- সবকিছু মিলিয়ে আমরা যেন গনগনে চুলার পাশে আছি। 

সমস্ত জীবকুল যেন মহাবিপদে আছে। জাতিসংঘের আবহাওয়া ও জলবায়ু সংস্থার মতে, ২০০০ সালের পর থেকে প্রতি বছর তাপমাত্রা চরমভাবে বৃদ্ধি অব্যাহত আছে এবং বর্তমানে গত ১৭৫ বছরের ইতিহাসে উষ্ণতার রেকর্ড অতিক্রম করছে। গবেষকদের মতে, জলবায়ুর এই পরিবর্তন মূলত মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক সমস্যা। এসবের মূল কারণ, নানান উৎস থেকে বাতাসে মিশে যাওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। 

গাছ বাতাস থেকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিকর কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস শুষে নিয়ে অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয় প্রকৃতিতে। যাকে বলা হয় ফটোসিন্থেসিস বা সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া। এর জন্য গাছের প্রয়োজন হয় কার্বন ডাইঅক্সাইড, পানি ও সূর্যালোক। তবে, তাপমাত্রা ১১৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ালে সালোকসংশ্লেষ পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মরছে গাছ, কমছে সবুজায়ন। আবার একইভাবে বাড়ছে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ও উষ্ণায়ন। বিশ্ব যেন এক দারুণ দুষ্টু চক্রে পড়েছে। 

১৭৫০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাতাসে তিন ধরনের ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ যথাক্রমে ১৫০, ২৬৪, ১২৪ শতাংশ বেড়েছে। শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে, যখন মানুষ মেশিন ও কারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াতে শুরু করে; তখন সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। অতি আধুনিকতা ও উন্নয়নের নামে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ বাড়িয়ে ওজোনস্তরের ক্ষয়, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, রাস্তাঘাট ও ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ এবং খাল, নদী ও জলাভূমি ভরাট, কি না হচ্ছে প্রকৃতির ওপর। আর আঘাতটা যখন সরাসরি প্রকৃতির ওপর আসে, সেক্ষেত্রে সে যে কত নিষ্ঠুর ও নির্মম হতে পারে সেটা এখন বিশ্ববাসী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করা শুরু করছে। 

মানবসৃষ্ট এই সমস্যা থেকে পৃথিবী ও জীবকুলকে বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য বিজ্ঞানী ও সচেতন মহল বার বার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বার বার হুঁশিয়ারি ও পীড়াপীড়িতে পৃথিবীর দেশগুলো ও নেতারা কয়েকবার জলবায়ু সম্মেলনে বসেছে। কত আলোচনা, নথিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ আর কত প্রতিশ্রুতি! প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা একমত হয়েছিলেন যে, এই শতাব্দীতে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দেড় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে ধরে রাখা। তবে, নীতিগত দড়ি-টানাটানি ও ঠেলাঠেলি শেষ নেই। এক দেশ সই করে তো অন্য দেশ করে না বা মানে না। একজন বলে অন্যরা আগে করুক তারপর আমরা করব। আসলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। 

কে বা কারা অধিক কার্বন নিঃসরণ ও জলবায়ুর ক্ষতির জন্য বেশি দায়ী, এ নিয়ে নিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ির শেষ নেই। ১৯৮৬ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উৎপাদন সমগ্র বিশ্বের উৎপাদনের ৭০ শতাংশ এবং ব্যবহারের ৫০ শতাংশ। এর ফলে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর ওজোনস্তরে ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণকারীর মধ্যে রয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভারত ও রাশিয়া। উন্নত দেশগুলো দুষছে চীন ও ভারতকে, আর তারা দুষছে উন্নত দেশগুলোকে। চীন-ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর বক্তব্য- তাদের শিল্পায়নের ইতিহাস ৫০-৬০ বছরের আর উন্নত দেশগুলোর কয়েক শ’ বছরের। শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে পরিবেশের ‘১২টা বাজিয়ে’ উন্নয়ন করার পর এখন তারা বড়বড় কথা বলছে। অতএব, পরিবেশ বিপর্যয়ের দায় তাদেরই অধিক নিতে হবে। 

উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোর ওপর এই পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্র শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ নিঃসরিত হয় বাংলাদেশে। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমিত রাখতে উন্নত বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। 

গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে ইনটেন্ড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কনট্রিবিউশন (INDC) প্রণয়ন করে এবং ২০২১ সালে তা হালনাগাদ করে UNFCCC-তে জমা দেয়। এতে বাংলাদেশ শর্তহীন ৬.৭৩% এবং শর্তযুক্ত ১৫.১২% গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৩ সালে Mujib Climate Prosperity Plan (MCPP) প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি যাতে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস পায়, সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন এবং বেশি উন্নত চুলা বিতরণের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। 

তবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ঘোষণা করছেন, কর্মপরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের প্রায় ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, আমরা Climate Vulnerable Forum (CVF) এর সভাপতি থাকাকালে অভিযোজন এবং প্রশমন কার্যক্রমে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের ব্যাপারে উন্নত দেশসমূহ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিল, অথচ এই প্রতিশ্রুতির কোন খবর নেই। 

জাতিসংঘ জলবায়ু অভিযোজন সম্মেলনের ‘অ্যাডভানসমেন্ট অব ন্যাশনাল ক্লাইমেট প্ল্যানস অব বাংলাদেশ’ সেশনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, দেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ২০৫০ সালের মধ্যে ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। বাংলাদেশের কর্মপরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য ধনী দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাওয়া যাবে সেটা একটা প্রশ্নের বিষয়। আর এসব কর্মপরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়ন না হলে আমাদের কী হবে, সেটাও চিন্তার বিষয়। 

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, এই বিপর্যয় পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব নয় এবং ভবিষ্যতে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। সেক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর আশায় অপেক্ষা না করে তীব্রতার মাত্রা কমানো ও খাপ খাওয়ানোর জন্য নিজেদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। কিন্তু, আমাদের নিজেদের ভেতরে যেন ঠেলাঠেলির শেষ নেই। আমরা সবাই বলছি ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। কিন্তু কে লাগাবে আর কে বাঁচাবে সেটা একটা প্রশ্নের বিষয়। বিষয়টি এমন, পলিথিন খুবই ক্ষতিকর এবং আমরা সবাই পলিথিনের বিপক্ষে কথা বলি; অথচ দেশে পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে এবং আমরা সবাই ব্যবহার করছি। এমনকি, বৃক্ষনিধন করে পরিবেশ ধ্বংসের জন্য আওয়ামীলীগ ও বিএনপির নেতারা একে-অপরকে অভিযোগও করে থাকে। 

সারা পৃথিবীতে যখন আন্দোলন চলছে ‘গাছ লাগান, গাছ বাঁচান’। সেখানে আমাদের গাছ নিধন ও সবুজ ধ্বংস যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে। উন্নয়ন কাজের জন্য গাছ কাটার প্রয়োজনয়ীতা দেখা যেতে পারে কিন্তু দেখা যায়, আমাদের শহরের সৌন্দর্যের নামে গাছ কাটা হয়। উন্নয়ন প্রকল্প মানে গাছ কাটা, কিছু গাছ কাটার প্রয়োজন হলে এই সুযোগে অন্য সব গাছ কাটা ফেলা। ডাল কাটার টেন্ডার পরিণত হয় গাছ কাটার টেন্ডারে। সুযোগ পেলেই সড়কের পাশের বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গাছ কেটে সাবাড় করে ফেলার খবর প্রায় আসে। এ যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের সাথে মানুষের গোলমাল হলে ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে অন্য গাছ কেটে দেওয়া হয়। শত্রুতা যেন গাছের সাথে। 

বিগত বছরগুলোতে ঢাকা শহরের এয়ারপোর্ট রোডের ও ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোডসহ বিভিন্ন এলাকার গাছ কাটার মর্মবিদারী দৃশ্য সাধারণ মানুষের মনে অনেক পীড়া দিয়েছিল। রাজধানীর এয়ারপোর্ট রোডে ছিল সারি সারি জারুল, সোনালু, কদম, শিমুল, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, কাঠ বাদাম, নাগেশ্বর, হিজলসহ অসংখ্য দেশি প্রজাতির গাছ। যাদের বাহারি ফুল, ফল, পাতা সবাইকে মুগ্ধ করতো। অভিযোগ উঠেছিল, শুধুমাত্র উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য গাছগুলো কাটা হয়নি। বরং দেশীয় গাছের স্থলে বিদেশি বনসাই লাগাবার জন্যে নির্মমভাবে এসব বৃক্ষ নিধন হয়েছিল। বৈশ্বিক কারণের সাথে সাথে আমাদের অযাচিতভাবে পরিবেশকে ব্যবহার বিশেষ করে বনভূমি ও কৃষি জমি গায়েব করে ও খাল-বিল-পুকুর-নদ-নদী ভরাট করে আমরা দেশটাকেও একটা ইটভাটা বানিয়ে তুলছি। এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৯২ সালে ঢাকার উত্তর অংশে গাছপালায় আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ছিল ৯২.২১ বর্গ কিলোমিটার, ২০২২ সালে তার পরিমাণ ৬৬ শতাংশ কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৩১.৪০ বর্গ কিলোমিটার। 

অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিফ হিট অফিসার (সিএইচও)-এর সমালোচনায় ব্যস্ত। কাজের ত্রুটি ও সমালোচনা থাকতে পারে। তবে আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে। জলবায়ুর এই পরিবর্তন বৈশ্বিক ব্যাপার, ওজোনস্তর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। হাজারও হিট অফিসার নিয়োগ দিলেও কাজ হবে না। আমরা সবাই যদি এগিয়ে না আসি। গত বছর নিয়োগ পাওয়ার পর সিএইচও ঘোষণা দিয়ে ছিলেন তাপমাত্রা কমাতে শহরব্যাপী স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী নানা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। ঢাকা শহরে ছোট ছোট বন বা বৃক্ষ আচ্ছাদিত পার্ক তৈরির জন্য দুই লাখ গাছের চারা রোপণ করা হবে। এসব কিছুর দৃশ্যমান বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। 

দাবদাহের কারণে সর্বনাশ ঘটে চলেছে কৃষির। দেশের স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রা, কৃষি ও উৎপাদন ব্যবস্থার উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কমে যাচ্ছে ফলের উৎপাদন। প্রচণ্ড গরম ডেইরি ও পোলট্রি খাতে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। মৃত্যু হচ্ছে গবাদি পশুর। প্রচণ্ড গরমে প্রতিদিনই মুরগি হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছে। এসব কারণে ডিমের উৎপাদনও কমছে। উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন খাদ্য অনিশ্চয়তার শিকার হচ্ছে। 

এবার বড় ধরনের প্রভাব পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশেও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, ধান চাষের জন্য ১৮ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন। সেখানে ৪২/৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুধু ধান নয়, অন্যান্য ফসল ও কৃষির সর্বনাশ হতে চলেছে। অতিরিক্ত গরমে বোরো ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। সার্বক্ষণিক সেচের পানি দিতে গিয়ে কৃষকদের বোরো ধান উৎপাদনে বাড়তি খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

এদিকে চলমান দাবদাহে শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কৃষি, নির্মাণ, পরিবহন খাতের মতো বাইরে কাজ করা কর্মীরা অতিরিক্ত গরমের কারণে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে পড়ছেন। তারা হিটস্ট্রেস, হিটস্ট্রোক, হিটক্র্যাম্পস, র‍্যাশ, ত্বকে ক্যানসার, হৃদরোগ, শ্বাসজনিত অসুস্থতা, কিডনির রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা নানা জটিলতায় পড়ছেন।

ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ুর পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যদ্বাণী নয়, বাস্তবতা। তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে, সমুদ্রের পানির স্তর উঁচু হচ্ছে। চাইলেই হঠাৎ করে বা রাতারাতি পরিবেশ উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। তবে কাজ করলে, পদক্ষেপ নিলে সবই ব্যর্থ হবে এমনও নয়, সফলতা আসবে। এড়িয়ে যাওয়া বা দায়সারাভাবে কাজ করলে বিরাট সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। 

শুধু বড় বড় শহর নয়, দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ ও সবুজায়ন কর্মসূচিকে আরও গুরুত্ব দিয়ে, কীভাবে ছোট ছোট বন বা বৃক্ষ আচ্ছাদিত পার্ক তৈরি করা যায় ও জলাধার সংরক্ষণসহ কীভাবে নতুন নতুন জলাধার সৃষ্টি করা যায় তার সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও সক্রিয় হতে হবে। শিল্প, পরিবহন ও গৃহস্থালিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো এক কঠিন চ্যালেঞ্জ কিন্তু অসম্ভব নয়। পরিবেশের স্বার্থে আমাদের জীবনযাত্রায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। 

বিপদ এখন দোরগোড়ায়, পরিবেশই সবার আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়া ও পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়েই উন্নয়নের জোয়ারে শামিল হওয়া এখন সময়ের দাবি।

লেখক: সাংবাদিক