কতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত শুকনো মুখ। সেদিন সাইক্লোন রেমাল এদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। আবার শুরু করতে হবে শূন্য থেকে। পাইকগাছার ফুলবাড়ি বাজারে এলেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দেখা মেলে; নারী-পুরুষ এবং শিশু। বাইরে থেকে আসা আগন্তুক কাউকে দেখলে তারা অনেক কিছু বলতে চায়; জানাতে চায় কষ্টের কথা। খুলনা শহর থেকে দক্ষিণে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পিচঢালা সড়ক। ২৮ কিলোমিটার পথ পেরোলেই ফুলবাড়ি। সেখান থেকে আরো প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে দেলুটি ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের ভাঙন। যা গোটা ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার মানুষের জীবন তছনছ করে দিয়ে গেছে।
সাইক্লোন রেমাল বাংলাদেশের উপকূলের যতগুলো এলাকায় আঘাত করেছে তার মধ্যে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের এই এলাকাটি। ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দাকোপ এবং পাইকগাছা উপজেলার সীমানায় মাঙ্গা নদীর তীরে তেলিখালী এলাকায় নাজুক বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের প্রবল স্রোত ঢুকে পড়ে দেলুটি ইউনিয়নে। ফলে ঘটেছে বিপর্যয়।
ফুলবাড়ি বাজার থেকে খানিক সামনে এগোতেই দেখা মোশাররফ মোড়লের (৫৬) সাথে। বলছিলেন, এখনো ঘরে চুলা জ্বলেনি। স্বজনদের বাড়ি থেকে খাবার আসছে। কোনো বেলা চালিয়ে দিচ্ছেন শুকনো খাবার দিয়ে। এভাবেই চলেছে এক সপ্তাহ। কথা বলতে মোশাররফ হোসেনের পাশে এসে দাঁড়ান তার স্ত্রী আকিরুন নেছা। চোখের কোণে পানি গড়িয়ে পড়ছে। হাতে প্লাস্টিকের বস্তা। আমিরুন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সাহায্যের চাল আনতে যাচ্ছেন। কিন্তু ঘর এবং চুলার যে অবস্থা তাতে এই চাল কীভাবে রান্না হবে, তা নিয়ে চিন্তিত তিনি। কথা বলতে বলতেই ভিড় জমে; মোস্তফা শেখ, রিনা বিবি, আবদুল মজিদসহ আরো অনেকে নোটবুকে নাম লেখাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তাদের ধারণা, সাহায্যের জন্য নোটবুকে নাম ওঠানো জরুরি।
রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত রিনা বিবি ত্রাণের জন্য যাচ্ছেন
সারাজীবন অন্যের সাথে মজুর খেটে তিনবেলা খেয়ে পড়ে ছিলেন ভালোই মোশাররফ মোড়ল। এই প্রথমবার বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপদের মুখে পড়েছেন তিনি। এর আগের সাইক্লোনগুলোর ঝাপটাও লেগেছিল; তবে তাতে এতটা ক্ষতি হয়নি। সাইক্লোন রেমালের আঘাতে তার বাড়ি ডুবে যায়। রাস্তায় উঠে তারা প্রাণ রক্ষা করেছেন। ঝড় থেমে গেলেও বাড়িতে বসবাসের পরিবেশ তৈরি হয়নি। সাইক্লোনের পরের দিন থেকে পরিবারের সদস্যরা ভাগ করে স্বজনদের বাড়ি বাস করছেন। কোথায় থাকছেন, কী খাচ্ছেন— এ যেন তাদের অকল্পনীয় জীবন! গবাদিপশুগুলো পাঠিয়েছেন শ্যালকের বাড়িতে। এদিকে ঘর ঠিক করার চেষ্টা করছেন, যাতে দ্রুত ঘরে বসবাস শুরু করা সম্ভব হয়। মোশাররফ বলছিলেন সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া নতুন করে জীবন শুরু করা সম্ভব নয়।
তেলিখালী গ্রামের প্রয়াত জহুর শেখের স্ত্রী রিনা বিবি অন্যের বাড়িতে কাজ করে একাই জীবন টেনে নিচ্ছিলেন। কিন্তু রেমাল তার সব কেড়ে নিয়েছে। ঘরের মাটির দেয়াল ধ্বসে গেছে। ঘরের ভেতরে এখনো পানি জমে আছে। আকিরুন নেছার সাথে ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়া সহায়তা চাল আনতে যাচ্ছিলেন তিনিও। হয়তো চাল এনেও তারা বিপাকে পড়বেন। কেননা চাল রান্নার পরিবেশ নেই অধিকাংশ পরিবারে। খাদ্য, বাসবাসের স্থান, সুপেয় পানি, যাতায়াতসহ নানান সংকটে রয়েছেন রেমাল বিপন্ন এলাকার মানুষেরা।
জ্যৈষ্ঠের সকালে তাঁতিয়ে ওঠা রোদ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদের তাপ বাড়ছিল তীব্রতায়। কেউ গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিলেও অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তখন পরবর্তী জীবনজীবিকা টেনে নেওয়ার চিন্তায় বিভোর। কেউ ভেজা ধান রোদের তাপে শুকিয়ে নিচ্ছেন; যেগুলো খাবার হিসাবে তারা ঘরে সঞ্চয় করেছিলেন। কেউবা ধানের খড় শুকিয়ে নিচ্ছেন; যা গবাদিপশুর খাবার হিসাবে গচ্ছিত রাখা হয়েছিল। মে মাসের তীব্র লবণ পানিতে সবকিছু ভেসে গেছে। পুকুরের মাছ, ক্ষেতের ফসল, খামারের মুরগি, ঘরের ধান-চাল, সব কিছু হারিয়েছেন অনেকে। মে মাসে নদীর পানিতে সবচেয়ে বেশি লবণ থাকে। সেই লবণ পানি এসে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের একটি বড় অংশের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
রাস্তার পাশে ভাসমান ঘরে রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রাবন্তী সরদার
ফুলবাড়ি বাজার থেকে তেলিখালী প্রায় দুই কিলোমিটার পথ। এ পথে হেঁটে গেলে অসংখ্য মানুষের দেখা মেলে যারা রেমালের আঘাতে ক্ষতির মুখে পড়ে রাস্তার উপরে আশ্রয় নিয়েছেন। দেবাশীষ গাইন তার বাড়ির কাছে রাস্তার পাশে ঘর তুলছিলেন। সাইক্লোনের পরের দিনগুলো বিভিন্ন স্বজনদের বাড়িতে বাস করেছেন। কিন্তু আর কতদিন! অবশেষে নিজের ঘর হচ্ছে রাস্তার ঢালে। দেবাশীষ গাইন তর্জনী তুলে দেখাচ্ছিলেন, তার ঘরের একাংশ পানির তলায়। বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাও পানিতে ডুবে আছে। ঘর তৈরির কাজে সাহায্য করছেন দেবাশীষ গাইনের স্ত্রী শ্যামলী গাইন। এই দম্পতি হয়তো সাইক্লোনের প্রায় এক সপ্তাহ পরে রাস্তার ধারে ঘর তুলছেন। কিন্তু অনেক পরিবার আরো আগে রাস্তায় বসবাস শুরু করেছেন। এদের মধ্যে রঘুনাথ সরদারের স্ত্রী কল্যাণী সরদার এবং দীনবন্ধু সরদারের স্ত্রী শ্রাবন্তী সরদার বলছিলেন, তাদের ঘরে যাওয়ার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি।
অন্যান্যদের মতো রহিমা খাতুনও যাচ্ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়া ত্রাণের চাল নিতে। কিন্তু গলায় ক্যামেরা আর হাতে নোটবুক দেখে তিনি চললেন উল্টো পথে; বাড়িমুখো। নিজের ভাঙ্গা বাড়িখানা দেখিয়ে তবেই শান্ত হতে চান রহিমা। গোপী পাগলা গ্রামের শেষ মাথায় তার বাড়ি। স্বামী বাচ্চু শেখের মৃত্যুর পর থেকে একাই সংসার টানছেন তিনি। ছোট্ট একখন্ড ভূমিতে ছোট্ট একটি বাড়ি ছিল তার। কিন্তু সে ঘরে এখন আর বসবাসের সুযোগ নেই। খুলনার সোনাডাঙ্গায় বাসাবাড়িতে কাজ করে রহিমার সংসার চলছিল। কিন্তু এখন তার নতুন বিপদে পাশে কেউ নেই। রহিমা সে কথাগুলো বলার জন্যেই বাড়ির কাছে ছুটে যান। সাহায্যের জন্য ন্যায্য তালিকাটা তৈরির দাবি জানান তিনি। রহিমার সাথে থাকা রিপা সরদার এবং নুপুর সরদারও একই দাবি তোলেন।
দেলুটির অধিকাংশ বাড়ির দেয়াল তৈরি হয়েছে মাটি দিয়ে। এই মাটির দেয়ালগুলো পানির প্রবল স্রোতে ধ্বসে গেছে। তেলিখালীর ফাতেমা বেগম এবং পিয়া বেগম ভেঙে পড়া দেওয়ালের মাটি সরিয়ে অন্যান্য মালামাল খুঁজছিলেন। এদের দু’জনের কোলেই ছিল ছোট শিশু। ঘর সামাল দেওয়ার পরে সন্তানদের লালনপালন যেন তাদের কাছে অনেক কঠিন। পাশের বাড়ির খাদিজা বেগম তার চার মাসের শিশু আশরাফুলকে নিয়ে বিপাকে। তাহমিনা বেগম তার দুই বছরের শিশু ইরান মোড়লের জন্যও ব্যবস্থা করতে পারছেন না প্রয়োজনীয় খাবারের। রেমালের আঘাত নারী ও শিশুদের উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। তেলিখালীর বটতলার বাসিন্দা তাহরিন বেগম তার হাত-পা দেখিয়ে বলছিলেন, লবণ পানির মধ্যে যারা কিছুক্ষণ ছিল, তাদের প্রত্যেকের শরীরে ফোসকা পড়েছে। এজন্য এলাকাবাসী জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা সেবা চালু করার দাবি জানিয়েছেন।
প্রাকৃতিক বিপদের সাথে লড়াই করছে এই শিশুরা
ভর দুপুরে রাস্তার উপরে ভাসমান চুলায় রান্না করছিলেন কুলসুম বিবি। নিকটেই ছয়জন মানুষের বসবাসের জন্য তাদের ছিল দুটি ঘর। কিন্তু ঘরদুটো পানিতে তছনছ হয়ে গেছে। এখন নতুন করে ঘর তুলতে হবে। কুলসুম বিবির ছেলে আবদুল মান্নান এ বাড়িতেই থাকেন। তার ভাই মোশাররফ হোসেনের বাড়ি রাস্তা থেকে খানিক দূরে। কিন্তু বাড়ির মাটির দেয়াল ধ্বসে পড়ায় বাড়িটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সাইক্লোনের পরে মোশাররফ হোসেন ছোটভাইয়ের সাথে রাস্তার ধারে বসবাস করছেন। একটি ঘরে থাকার জায়গা হচ্ছে না বলে রাস্তার উপরে খাট পেতে রাত্রিযাপন করতে হচ্ছে। কয়েকটি পরিবার মিলে একসঙ্গে রান্না করছেন একবেলা। তা দিয়েই চালিয়ে নিচ্ছেন পুরো দিন। রান্নার জন্য জ্বালানি সংকট থেকে শুরু করে অন্যান্য সংকট তো আছেই।
বাইরে থেকে গ্রামগুলোর ভেতরের চিত্র বোঝা মুশকিল। ভেতরের অবস্থা বোঝার জন্য তেলিখালী বটতলা থেকে ইটের রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু। ইট বিছানো রাস্তা অনেক স্থানে ধ্বসে গেছে। অনেক স্থান এখনো পানির তলায় ডুবে আছে। পুকুর-ডোবায় পচা বিষাক্ত পানি। লবণ পানির সাথে যোগ হয়েছে মরা মাছ। দুর্গন্ধের কারণে অনেক স্থান দিয়ে হাঁটাই যায় না। বহু ঘরবাড়ি কাত হয়ে পড়ে আছে। অনেকগুলো ডুবে আছে পানিতে। অনেক ঘরের চালা উড়ে গেছে। অধিকাংশ ঘরে বসবাসের পরিবেশ নেই। তবুও নিরুপায় অনেক মানুষ ঘরের পানি-কাদা সরিয়ে, খাট উঁচু করে বসবাসের চেষ্টা করছেন।
কৃষিপ্রধান এই এলাকাটি এখন লবণ পানির তলায় ডুবে আছে। আশপাশের এলাকাগুলো চিংড়ির ঘেরের দখলে চলে গেলেও এই এলাকাটি ছিল লবণপানি মুক্ত। সে কারণে এখানে মাঠভরা ফসল ছিল। বহু মানুষ কৃষিকাজেই তাদের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পেতেন। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে তারা কীভাবে সংকট কাটিয়ে এগোবেন, তা কেউ জানে না। এলাকার মানুষ জানে না, লবণের গ্রাস থেকে আবার কবে মাথা তুলবে কৃষি, আবার কবে ফিরবে প্রাণচাঞ্চল্য!