জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরে ঝড়, নিম্নচাপের মতো দুর্যোগ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক দশক আগেও কয়েক বছর পর দু’-একটি ঝড় বা নিম্নচাপ সৃষ্টি হতো। এখন প্রতিবছর কয়েকটি ঝড়ের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় জেলেরা মাছ ধরার জন্য গভীর সমুদ্রে যেতে পারছেন না। সাগরে জেলেদের মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে।
জেলেরা বলছেন, গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করা জেলেদের প্রাণহানির সংখ্যা বেশি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। অনেকে জীবন বাঁচাতে পেশা বদলেছেন। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ঘূর্ণিঝড় বেড়েছে।
গত ১৭ বছরে বাংলাদেশের উপকূলে ১৩টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এছাড়া, লঘুচাপ সৃষ্টি ও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে বহুবার জেলেদের সাগর থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। অথচ, ১৯৬০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৪৪ বছরে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে মাত্র ৮টি।
হঠাৎ করে কেন ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে, এ বিষয়ে আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেছেন, বায়ুমণ্ডল অস্থির হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের কারণ।
তিনি বলেন, সাগর ও নদীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। অতীতে এসব সমস্যা কম থাকায় ঘূর্ণিঝড়ও কম হতো। মানুষের কর্মকাণ্ড জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী।
গভীর বঙ্গোপসাগরে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে মাছ শিকার করেন বরগুনা সদর উপজেলার নলী এলাকার জেলে আবু তাহের (৭০)। তিনি বলেন, ‘২০ বছর আগেও এত বেশি ঘূর্ণিঝড় ছিল না। ৫-১০ বছরে একটা ঘূর্ণিঝড় হতো। কিন্তু, এখন প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় হয়। অনেক সময় বছরে দুই বার হয়। আমরা মাছ শিকারে গিয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকি। প্রতিবার সাগরের উদ্দেশে রওনা করার আগে যখন পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেই, তখন মনে হয়, এটিই শেষ বিদায়। আর হয়ত ফিরতে পারব না।’
তিনি বলেন, ‘গত বছর দুটি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। একবারও আমরা সাগরে গিয়ে তথ্য পাইনি ঘূর্ণিঝড় হবে। হঠাৎ করে দেখি সাগর উত্তাল। ঘূর্ণিঝড় মিধিলির সময় আমার ট্রলার ডুবে গিয়েছিল। দুই দিন ভাসমান অবস্থায় থাকার পর অন্য জেলেরা উদ্ধার করে। এই হঠাৎ হওয়া ঘূর্ণিঝড় এখন জেলেপল্লির আতঙ্ক।’
পাথরঘাটা উপজেলার মাছের খাল এলাকার এফ বি আল্লাহর দান ট্রলারের মালিক আবুল হোসেন ফরাজী রাইজিংবিডিকে বলেন, ৪৭ বছর ধরে মৎস্য ব্যবসায় জড়িত আমি। বিভিন্ন সময়ের ঘূর্ণিঝড়ে আমার ৬টি ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হয়েছে। এসব ট্রলারের ৯৬ জেলের মধ্যে মারা গেছেন ২২ জন। ৬টি ট্রলারের একটিরও সন্ধান মেলেনি। ৬টি ট্রলারের দাম ১৩ কোটি টাকার বেশি।
গত বছর ১৭ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কবলে পড়ে এফ বি এলাহী ভরসা ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হয় সদর উপজেলার ১৭ জেলে। একই দিনে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে এফ বি মায়ের দোয়া ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হন আরও ৮ জেলে।
এফ বি এলাহী ভরসা ট্রলারের মাঝি লিটন হাওলাদারের স্ত্রী সালমা বেগম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার স্বামী অভাবের তাড়নায় মাছ শিকার করতেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ৫ কেজি চাল রেখে মাছ শিকার করতে যান। যাওয়ার আগে বলে যান, তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত ধার করে সংসার চালাতে। ঘূর্ণিঝড় মিধিলিতে ট্রলার ডুবে নিখোঁজ রয়েছেন তিনি। ছয় মাস হয়ে গেলো, তার কোনো সন্ধান পাইনি। আমার স্বামীর লাশটা পর্যন্ত পেলাম না।’
গত বছরের ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোখায় ট্রলার ডুবি না হলেও মাছ শিকার করতে না পারায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় ট্রলার মালিকদের।
২০২৩ সালের মতো ২০২২ সালেও দুটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। অশনির কবলে পড়ে ২৩টি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে ১৭২ জেলে নিখোঁজ হন। ১৫৭ জেলেকে উদ্ধার করা গেলেও মারা যান ১৫ জন। ওই বছরে ২০ আগস্ট সাগরে হঠাৎ সৃষ্টি ঝড়ে ২৪ ঘণ্টায় ১১টি ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হন ৩৪ জেলে।
২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পান, ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ও ফণী, ২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় মোরা, ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর, ২০১৫ সালে ঘূর্ণিঝড় কোমেন, এর দুই বছর আগে ২০১৩ সালে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং ২০০৭ সালে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে বিংশ শতাব্দীর ভয়াবহ সুপার সাইক্লোন সিডর। এসব ঘূর্ণিঝড়ে গভীর বঙ্গোপসাগরে কয়েকশত ট্রলার নিখোঁজ হয়। কয়েক হাজার জেলে প্রাণ হারান।
বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, সাগরে ঘূর্ণিঝড় হলে জেলেদের প্রাণহানি হবেই। একটা সময় ১০ বছর পর একবার ঘূর্ণিঝড় হতো। আর এখন এক বছরে দুটি ঘূর্ণিঝড়ও হয়। এতে জেলেরা সাগরে বেশিদিন থাকতে পারে না। মাছ না ধরে ফিরে আসতে হয়। এতে ট্রলার মালিকেরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে।