মানুষের সবচেয়ে উপকারী পাখির মধ্যে শকুন অন্যতম। দূরদৃষ্টির অধিকারী এ পাখি প্রকৃতির ঝাড়ুদার। পশু মরে পড়ে থাকলে দল বেঁধে মাটিতে নেমে এসে সেটা খেয়ে ফেলে শকুন। এতে পরিবেশ জীবাণুমুক্ত এবং দুর্গন্ধমুক্ত থাকে। কিন্তু, প্রকৃতির অতিউপকারী পাখিটি এখন বিলুপ্তপ্রায়। দেশে এখন মাত্র কয়েকশত শকুন টিকে আছে।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে মৃত গবাদি পশু ভাগাড়ে ফেলার পর দল বেঁধে শকুন মাটিতে নেমে আসত। কিন্তু, এখন সে দৃশ্য আর দেখা যায় না। মৃত প্রাণী পড়ে থেকে পঁচে গেলেও এখন শকুনের দেখা মেলে না।
বাংলাদেশ সরকার প্রকাশিত ওয়েবপোর্টালে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে এক নিবন্ধে জানিয়েছেন, সারা পৃথিবীর ২৩ প্রজাতির শকুনের মধ্যে বাংলাদেশে ৬ প্রজাতির শকুন দেখা যেত। এর মধ্যে ৩ প্রজাতির শকুন স্থায়ীভাবে বসবাস করত। বাকি তিন প্রজাতি পরিযায়ী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ৫০ হাজার শকুন ছিল। বর্তমানে এদের সংখ্যা তিন শ’র নিচে।
আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) কয়েক বছর আগে গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, উপমহাদেশে একসময় ৪০ লাখ শকুন ছিল। সেই সংখ্যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১ হাজারে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৫-২০১৬ সালে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশের সিলেট ও সুন্দরবন অঞ্চলে মাত্র ২৬০টি শকুন টিকে আছে। এর পর আর শকুনশুমারি হয়নি। যদিও সরকার থেকে শকুন রক্ষায় বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট জানায়, শকুন তার পাকস্থলিতে প্রায় ৪০ প্রকার জীবাণু ধ্বংস করতে পারে, যা অন্য প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়। এনথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ গবাদিপশু মারা যায়। মৃত গবাদী পশুর শরীর থেকে এই জীবাণু ধ্বংস হয় না। ফলে, দ্রুত এই জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, শকুন এই মারাত্মক এনথ্রাক্স জীবাণু ধ্বংস করতে পারে। ফলে, এর বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়।
ড. তপন কুমার দে বলেন, গরু, মহিষ বা শক্ত ও মোট চামড়ার প্রাণী মারা গেলে তাতে কিছুটা পচন না ধরা পর্যন্ত কুকুর, ইঁদুর বা অন্য প্রাণী তা খায় না। মৃতদেহ পচে যাওয়ার ফলে তাতে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের উৎপত্তি হয়। কুকুর, ইঁদুর ও অন্য প্রাণী এসব খেয়ে বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং মানুষ ও প্রকৃতিকে আক্রান্ত করে। অথচ, শকুনের পরিপাকতন্ত্রে এনথ্রাক্সসহ বিভিন্ন ধরনের জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। বনাঞ্চলে মৃত বন্যপ্রাণী, লোকালয়ের মৃত গবাদি পশু, কুকুর, বিড়াল, হাঁস-মুরগির দেহাবশেষ শকুন খেয়ে প্রকৃতিকে জীবাণুমুক্ত করে রাখে।
শকুন প্রায় বিলুপ্ত হওয়ায় গবাদি পশুর মৃতদেহ থেকে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি যেমন: এনথ্রাক্স, খুরা রোগ, বুটুলিনাম, হগ, কলেরা ইত্যাদি মানুষ ও গবাদি পশু আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শকুনের অবর্তমানে কুকুর প্রাণীর মৃতদেহ খাচ্ছে। এতে কুকুর সহজে বেশি খাদ্য পাচ্ছে। ফলে, কুকুরের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে জলাতঙ্ক সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের গবেষক ড. লিন্ডসে ওক গবেষণায় প্রমাণ করেন, পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহার শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধ প্রয়োগের পর কোনো পশু মারা গেলে এবং সেই মৃত পশুর মাংস খেলে শকুন তিন দিনের মধ্যে মারা যায়। এ কারণে ভারতে প্রতি বছর ৩০ শতাংশ শকুন মারা যায়। উপমহাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার ২০০৩ সালে পশু চিকিৎসায় এই ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে। এতে শকুনের মৃত্যু অনেক কমেছে।
শকুন রক্ষায় বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হয়েছেন। ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ডের দুটি পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশেও তা পালিত হচ্ছে। ২০১৩ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় শকুন পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করা হয়েছে। মৌলভীবাজার ও সুন্দরবন অঞ্চলে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে।
২০১৪ সালে আইইউসিএন নাটোরের সিংড়ায় শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে এ ধরনের একটি পরিচর্যা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনও শকুন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।