বাড়িটা তাঁর নিজের, স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার; সবাই তাঁকে ভালোবাসে, তিনিও বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে বুকে আগলে রাখেন স্নেহ ও মমতায়, এমনকি পোষা বিড়ালটিকেও; বয়সের কারণে শারীরিক কিছু জটিলতা তাঁর আছে, ও তেমন কিছু নয়, জীবনটা তো বেশ কেটে যাচ্ছে। নিজের সম্পর্কে এমনই ভাবেন মানুষটি, এতদিন তাই ভেবে এসেছেন; চাকরি থেকে রিটায়ার করা বিপত্নীক, সাদাসিধে সাতষট্টি বছরের রশীদ তালুকদার। কিন্তু তাঁর ভাবনা ও যাপনে ভুল ছিল, কখনো বুঝতে পারেননি। এমনও হয়?
অনেকদিন পর, একদিন তিনি আবিষ্কার করলেন, নিজের বাড়িঘর ও ছেলেমেয়ের সঙ্গে তিনি থাকেন, তবে কেউ তাঁকে বিশেষ পছন্দ করে না। আপদ মনে করে। প্রিয়জন নয়, তাঁকে গোপনে, কখনো প্রকাশ্যেও বুঝিয়ে দেয়— তাঁকে তারা কেবল প্রয়োজন ভাবে। প্রথম যেদিন তিনি ব্যাপারটা টের পেলেন, সারারাত ঘুমোতে পারেননি।
রশীদ তালুকদার হঠাৎ একদিন খেয়াল করলেন, সারা বাড়িতে ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ে প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে! তার মুখে হাসি। মনে আনন্দ। সে সবার কথা শুনছে। ফরমাশ খাটছে। মেয়েটির নাম মায়া। মাথায় ঘন কালো চুল। চুলগুলো ছোট ও কোঁকড়া। ফ্রগ ও হ্যাফপ্যান্ট পরা মেয়েটাকে দেখে বোঝার উপায় নেইÑ সে এ বাড়ির কেউ নয়। সন্ধ্যায়, খানিকটা ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে তিনি বাসায় ফিরলেন। বাইরে একটু কাজ ছিল। বেরিয়েছিলেন সেই দুপুরে। কাজ সেরে বিকেলেই বাসায় ফিরে আসবেন, ভেবেছিলেন। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা উৎরে গেল। বসার ঘরে ঢুকতেই মেয়েটাকে চোখে পড়লো। প্রথমে তাঁর একটু ধাক্কার মতোন লাগলো— কে মেয়েটি? অচেনা এবং বয়সও কম। তিনি আগে কখনো মেয়েটিকে দেখেছেন কি? মনে করতে পারলেন না। ফারিয়া এসে বলল, দাদু ফিরেছ? একটু দেরি হয়ে গেল, দাদুভাই। দাদু মেয়েটির দিকে অবাক নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন দেখে ফারিয়া নিজে থেকেই পরিচয় করিয়ে দিলো। দাদু, ওর নাম মায়া। সে এখন থেকে আমাদের এখানেই থাকবে। বাসার টুকটাক কাজ করবে। তুমি যাও। বাইরে থেকে এসেছ। হাতমুখ ধুয়ে নাও। রেস্ট করো। আমি তোমার চা নিয়ে আসছি। মেয়েটা তাহলে কাজের মেয়ে? অথবা, মেয়েটাকে বাসার কাজের জন্য আনা হয়েছে? বেশ। বাসায় একটা লোক থাকলে কত সুবিধে। ভালোই হয়েছে। নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবলেন রশীদ তালুকদার।
নামটা স্বার্থক বটে। চোখে ও মুখে আশ্চর্য নির্লিপ্তি মেয়েটার। আর মায়া। ফারিয়া ক্লাস এইটে পড়ে। মায়াও তার বয়সী। অথবা হতে পারে, দু’তিন বছরের বড়। অভাব ও অপুষ্টির ছাপ মেয়েটার সারা শরীরে। আর তার চোখ। কেমন দুঃখী ও করুণ ছায়া ওই চোখে। কোনো কারণ নেই, মেয়েটির চোখ ও পুষ্টিহীনতা নিয়ে ভাবার। প্রয়োজনও নেই কিছু। তবু কথাগুলো তাঁর মনে এলো। রশীদ তালুকদার কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন।
দিন যায়। সময় বয়ে যেতে থাকে নিজের খেয়ালে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন জিনিস সামনে আসে। মানুষ এগিয়ে যায়। সুন্দর, কিংবা অভিজ্ঞ হয়। বদলে যায়। সেই মায়া।
শীত ফুরিয়ে গেলে ফাল্গুন আসতে আর সময় নেয় না, মায়াও তেমনিভাবে মিশে গেল পরিবারে। বাসার সবাইকে সে পরম আত্মীয়ের মতো আপন করে নিলো। কখনো কোনো কাজের কথা বললে সে এক মুহূর্ত অপেক্ষায় থাকে না। দায়িত্ব মনে করে, নিজের ঘরের কাজ ভেবেই সে সমস্ত কাজে জুড়ে যায়। কাজ ও কারিগরিতে আশ্চর্য গুণ মেয়েটার! কারিগরি? সে এক কারিগরি বুদ্ধির কৌশলই বটে। কিন্তু তাতে ওর আন্তরিকতাটুকু বোঝা যায়। বাসায় কার কখন কোন জিনিসটা চাই, কে কী পছন্দ করে এবং পছন্দ করে না— সব কিছুতেই ওর নীরব ও সতর্ক দৃষ্টি আছে। মায়া নামটা কে রেখেছিল মেয়েটার? রশীদ তালুকদার জানেন না। যে-ই রাখুক, তার নামটা স্বার্থকই বটে। কেননা তার চোখে ও মনে আশ্চর্য মায়া। যদিও প্রথমে মেয়েটাকে দেখে এসবের প্রায় কিছুই বোঝা যায়নি। একসময় সে এমনভাবে মিলেমিশে যায়, বাইরে থেকে কেউ এলে বুঝতেই পারে না, সে এই পরিবারের কেউ নয়। সময় কত দ্রুত গড়িয়ে যায়। মায়া এ বাড়িতে এসেছে পাঁচ বছর হয়ে গেল? রশীদ তালুকদারের জীবনের অনেক কিছু আগের মতো নেই। বাসার পরিবেশও বদলেছে। সময়ও বদলে গেছে সময়ের মতোন।
এক গভীর রাতে, বাসার সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। ফারিয়ার এইচএসসি পরীক্ষা সামনে। মেয়েটা রাত জেগে পড়ে। এমনিতেই ওর মাথা ভালো। মনোযোগও আছে। ভালো করবে মেয়েটা। সবার চাওয়া, সে পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাবে। সেই ফারিয়াও ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। চারপাশে সুনসান নীরবতা। একসময় নীরবতা খুব পছন্দ করতেন রশীদ তালুকদার। আর ভাবতে। তিনি ভাবতে কী যে ভালোবাসতেন! বিশেষ করে স্ত্রীকে নিয়ে। সেসব দিন গেছে। সময়ও আগের মতো নেই। এখন বেশি নীরবতা ভালো লাগে না। অসহ্য লাগে। নিজের দুঃখ ও গ্লানিগুলো নীরবতা পেলেই যেন জাঁকিয়ে বসে। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছেন রশীদ তালুকদার। তাঁর ঘুম আসছে না। হঠাৎ শুনতে পেলেন, ভেতরের ঘরের ওদিকে বেসিনে কেউ বমি করছে। এত রাতে কে বমি করতে পারে? বমি করছে যে, তার খাওয়াটা মনে হয় ভালো হয়নি। বেশি খেয়ে ফেলেছে। অথবা খাবারের পদ উল্টাপাল্টা হয়েছে। পেটে প্রচুর গ্যাস হয়েছে। সে জন্য বমি করতে পারে। এমন একটা কিছু ভেবে তিনি আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে শব্দটা তিনি আবার শুনতে পেলেন। আবার। আরও একবার। তাঁর সন্দেহ হলো। ব্যাপারটা কী? তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন। লাইট জ্বালতে গেলেন না। অন্ধকার বিছানায় বসে চোখ বন্ধ রেখেই শব্দটা আবার শোনার চেষ্টা করলেন। রশীদ তালুকদার একসময় বুঝতে পারলেন, যে মানুষটা বমি করছে বা বেসিনে দাঁড়িয়ে ওয়াক করছে, সে কোনো পুরষ নয়। নারী। কিন্তু কে সে? এটা বোঝা গেল না। রাত যেহেতু বেশ গভীর, ব্যাপারটাও সিরিয়াস নয়, তাই কেন ও কী হয়েছে, পরিষ্কার জানা গেল না। তিনিও চেপে গেলেন।
সকাল থেকেই বাসার পরিবেশ কেমন অচেনা। থমথমে ও গম্ভীর। প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাইরে থেকে ঘরে ফিরতেই বুঝতে পারলেন রশীদ তালুকদার। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। বাসার কোথাও কোনো শব্দ নেই। কথা নেই। ব্যস্ততা নেই। কথা ও কাজে নীরবতা এবং একইসঙ্গে সবাই সাবধানতা অবলম্বন করে চলাফেরা করছে। রশীদ তালুকদার বেশ অবাকই হলেন। তবে খুব একটা প্রকাশ করলেন না বা কৌতূহল দেখালেন না। কিছুক্ষণ পরেই আসল জিনিসটা জানা গেল— কাজের মেয়েটা প্রেগনেন্ট। বিয়ে হয়নি, মেয়েটার বয়সও বেশি নয় এবং এ বাসাতেই থাকে। কাজেই বিষয়টা স্বাভাবিক নয়। সন্দেহজনক। কিন্তু সে যেহেতু দিনে ও রাতে সারাক্ষণ এই বাসাতেই থাকে, বাসার লোকই এই কাজটা করেছে। এটা অন্যায়। অন্যায় এবং অপরাধ।
সকালের নাস্তাটা খুব সকালেই সেরে নেন রশীদ তালুকদার। এটা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। রুটিনও বলা যেতে পারে। আগে ফারিয়া নাস্তার প্লেট ও চায়ের কাপটা দিয়ে যেতো। মায়া এ বাড়িতে আসার পর, একরকম অলিখিত নিয়মে ফারিয়ার বদলে কাজের মেয়েটাই তাঁর ঘরে নাস্তা দিয়ে যায়। আজ মেয়েটা আসছে না। অন্য কেউও নাস্তা নিয়ে এলো না। সকালে নাস্তা সেরেই তাঁর একটা ওষুধ খেতে হয়। ডায়বেটিসের রোগী হাসান। প্রেসারের গোলমাল আছে। একটু নিয়ম করে চলতে হয়। নিয়ম মেনে জীবন নির্বাহ করা একটু কঠিন। এতে মানুষের উপকারই হয়। তবুও।
সময় গড়াচ্ছে। দৈনিক পত্রিকাটা হাতে নিয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে তিনি অনিচ্ছুকভাবে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আরও কিছু সময় চলে গেল। নাস্তা নিয়ে তাঁর ঘরে কেউ এলো না। একসময় তিনি বুঝতে পারলেন এবং তাঁকে জানানো হলো, মায়া যে প্রেগনেন্ট, সেটা এই বাসার লোকই করেছে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। লোকটি কে, সে বিষয়টিও পরিষ্কার। মানুষটি আর কেউ নয়, তার নাম রশীদ তালুকদার। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও বুঝি তিনি এতটা অবাক হতেন না। অবাক ও বিস্মিত, তিনি দুটোই হলেন। তাঁর চোখ ভরে জল এলো। গলা বুজে এলো কান্নায়। তাঁর ইচ্ছে করলো, বুক চিরে গলা ফাটিয়ে তিনি কেঁদে ফেলেন। এমন গোপন ও সন্দেহজনক ব্যাপারটা সবাই এত দ্রুত জেনে গেল? কীভাবে জানতে পারলো? মায়া কি নামটা বলে দিয়েছে? হায় আল্লাহ, কী সর্বনাশ! এখন কী হবে?
প্রথমে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। আরও পরে বুঝলেন, চোখের জল ও নিরপরাধ মুখ করে থেকে এখন লাভ নেই। তাঁকে পালাতে হবে। রশীদ তালুকদার বেশি সময় নিলেন না। মুহূর্তেই তিনি সাবধান হয়ে গেলেন। অপরাধী সবসময় নিজেকে নির্দোষ ও নিরপরাধী বলতে চায়। সে কারণে এখন তিনি যে কথাই বলুন আর যা কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করুন না কেন, বাসার লোক তার সবকিছুই ভাণ ও ভণিতা হিসেবে ধরে নেবে। এটাই হয়ত স্বাভাবিক। এই মুহূর্তে আর কিছু করারও নেই। আরও কিছুক্ষণ পর, কান্না ও করুণ মুখটা আড়াল করে তিনি ভাবলেন, নাহ, এখন কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়াই দেখানো যাবে না। কোনো কথা ও কৈফিয়তও নয়। আচ্ছা, বাইরে হোটেল থেকে নাস্তাটা সেরে এলে কেমন হয়? তিনি নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিলেন। না, এখন বাসা থেকে বের হওয়াটা কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। তাঁর ভাগ্য কিছুটা ভালো। কেননা, এখনো বড় ছেলে ও বৌমা কেউ তাঁর ঘরে আসেনি। কোনো কথা ও চোখরাঙানি নিয়ে শাসায়নি। বাবা, ছিঃ, এমন একটা কাজ তুমি করতে পারলে?— এসব বলেনি। ছোট ছেলেটাও তাঁর ঘরে আসেনি। সে এমনিতেই চুপচাপ। এই ঘটনার পর, সে আরও নীরব হয়ে গেছে।
দিন যায়। মায়ার চোখমুখ ও শরীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে তার পেটের আকারও বেড়ে চলে। প্রেগনেন্সি এমন কিছু খারাপ নয়। কিন্তু ও এমন জিনিস, একবার শুরু হলে তাকে থামানো মুশকিল। ক্রমশ আরও বাড়তে শুরু করে। রশীদকে নিয়ে বাড়ির লোকের সন্দেহও বাড়তে থাকে। দিনে দিনে মায়ার পেটের আকার বেড়ে চলে। আরও বাড়তে থাকে। বাড়ির সবার সন্দেহও বাড়তে থাকে। বড়ছেলের মেয়ে ফারিয়া, সে সবচেয়ে বেশি আন্তরিক মন নিয়ে দাদুকে বোঝে। যে কোনো পরিস্থিতিতে মানবিক চোখে এবং বন্ধুর মতো তাঁর পাশে থাকে। সেও কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।
ফারিয়ার সঙ্গে হুট করে ঘরের ভেতর, বারান্দায়, কিংবা কখনো ছাদে দেখা হয়। খাবার টেবিলে একসঙ্গে খেতে বসেছে। কিন্তু দেখা হলেই সে কেমন গম্ভীর হয়ে যায়। সে মুখটা নামিয়ে নেয়। দেখা হলে, পিছলে যাওয়ার মতো সে সটকে পড়ে, তা নয়। এমন অচেনা ও দুরূহ দৃষ্টিতে তাঁকে দেখে, খুব অস্বস্তি হয় রশীদ তালুকদারের। অচেনা ও সন্দেহজনক কোনো লোক, যাকে দেখলেই বিরক্তি আসে, রাগ হয়; তেমন কোনো লোক বাড়িতে এলে মানুষ রাগ করে। বিরক্ত হয়। ক্ষুব্ধ হয়। নীরব হয়ে যায়। মুখের ওপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করে ফেলে। মায়ার পেট যত বাড়ে, রশীদ তালুকদারের ওপর সন্দেহের তীর ও চোখ তীব্র হয়। সবাই তাঁর দিকে এমন চোখে তাকিয়ে থাকে, তাঁর ইচ্ছে হয়, মাটির ভেতর তিনি ঢুকে পড়েন।
রাতের বেলায় বড়ছেলে রশীদ তালুকদারের ঘরে এলো। বাবা, অনেক তো হলো। এবার তো কাজটা শেষ করো। তিনি শুয়ে ছিলেন। ছেলের কথা শুনে বিছানায় বসলেন। বললেন, কী কাজ, বাবা? তোমার তো বয়স হয়েছে। শরীরও ভালো যাচ্ছে না। নানা রকম অসুখ বাঁধিয়েছ। কখন কী হয় কেউ কি বলতে পারে? বলছিলাম যে, তার আগে— রশীদ তালুকদার প্রশ্নচোখে তাকিয়ে রইলেন। সারাদিনের আয়োজন ও স্ত্রীর স্মৃতিভার রশীদকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সে কারণে তাঁর আসলে কোনোদিকেই মন ছিল না। মন এখনো নেই। শফিক বলল, বাবা, বলছিলাম যে— তুমি কী বলতে চাইছ, বাবা শফিক? না, মানে। পরে আসছি। বলেই ছেলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। রশীদ তালুকদার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কী যে অস্বস্তির ভেতরে তিনি পড়েছেন। কাউকে কিছু খুলে বলতেও পারেন না। কিছুক্ষণ পর, ছেলেটা ফিরে এসে বাবার বিছানায় বসলো। রশীদ তালুকদার আবার ফাঁপরে পড়লেন। ছেলে তাঁকে কী বলতে চায়? ভেবে বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো। বাবা— হ্যাঁ, বাবা, বলো। বাবা, তোমার ওই টিনশেডের বাড়িটা লিখে দিলে আমরা ওখানে একটা বহুতল ভবন তৈরি করতে পারতাম। আমরা আমরাই তো। বোঝোই তো। পরিবারে সদস্য বেড়েছে। বড় দুটো ফ্ল্যাট হলে সবারই তো সুবিধা। তুমিও থাকলে বড় ঘর নিয়ে নিজের মতো। ছোটরও একটা গতি হলো।
রশীদ তালুকদার লম্বা করে শ্বাস নিলেন। খুব নিঃশব্দে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ছেলেটা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলা উচিত। কীই-বা বলা যায়? তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবলেন। বললেন, দেখি, বাবা। একটু ভাবি। আচমকাই ছেলেটা রেগে গেল। তার গলা উঁচুতে উঠে গেল। সে বলতে লাগলো, তা দেবে কেন? আমাদেরকে না, অন্য কাউকে লিখে দাও। নিজের ছেলেপুলে কিছু পাবে না। বাইরের লোক এসে এখানে ভাগ বসাবে। বারো ভূতে লুটেপুটে খাবে তোমার সম্পদ। কথা শেষ করে ছেলেটা আর দাঁড়ালো না। হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বড় ছেলে বেরিয়ে যেতেই তিনি ভারমুক্ত হলেন। তাঁর হাসি পেলো। তিনি একা একা বিছানায় বসে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ হাসলেন। একবার মনে হলো, ছেলেটা কি তাঁর কাছে কোনো সুযোগ নিতে চায়?
রাতে, ঘুমানোর সময় একটা খটকা কিছুতেই মন থেকে নামলো না রশীদ তালুকদারের। মায়া মেয়েটা কোথায়? সে কি বাসাতেই আছে, নাকি তাকে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে? মায়ের মৃত্যু-পরবর্তী ছোট অনুষ্ঠান উপলক্ষে অনেকেই এসেছিল। প্রতিবেশীদেরও কয়েকজনকে দেখেছেন। দূরে থাকে যে মেয়েটা, সেও ছুটে এসেছে ছেলেপুলে নিয়ে। কিন্তু বাসার কোনো লোক, এমনকি প্রতিবেশীর কেউই রশীদকে মায়ার বিষয়টা নিয়ে খোঁচা দিলো না। টিটকারি মারলো না। চোখ বাঁকা করে তাকালো না। এমনকি আড়ালে ডেকে নিয়ে নীরবে বা চিবিয়ে চিবিয়ে কেউ তাঁকে ভর্ৎসনাও করলো না। সে কারণে মায়া-বিষয়ক খটকাটা তাঁর কিছুতেই কাটলো না।
অনেকদিন আগে, এক বন্ধুকে উপহার দেওয়ার জন্য রশীদ তালুকদার একটা বই কিনেছিলেন। বইটা ছিল গল্পের। লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে সারা ঘর তন্ন তন্ন করে বইটা খুঁজতে লাগলেন। না, বইটা কোথাও পেলেন না। তাঁর ঘরে বেশ কিছু বই, খবরের কাগজ ও পত্রিকা জমা আছে। বই ও নানা ধরনের জিনিপত্রের এলোমেলো ভাঁড়ারে কোথায় যে লুকিয়েছে সে বই। বইটা না পেয়ে মনটা খুব ভার হলো তাঁর। বাথরুম থেকে আরেকবার হাতমুখ ধুয়ে তিনি বিছানায় চলে এলেন। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের বইয়ের কথা মাথা থেকে কিছুতেই গেল না। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন গল্পের বইয়ের ‘সাক্ষী ডুমুরগাছ’ নামক গল্পের সেই বুড়ো লোকটির কথা। যিনি সংসারে গলগ্রহ এবং অপাঙ্কতেয় হয়ে দিনযাপন করছিলেন। লোকটার শরীরের এমনই অবস্থা, নিজে থেকে তিনি প্রায় কিছুই করতে পারেন না। একদিন ডাক্তার দেখানোর নাম করে লোকটিকে দূরগামী একটা ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। সে এক আশ্চর্য বুক বিদীর্ণ করা কাহিনি। রাতে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেই গল্পের লোকটির কথা খুব মনে পড়ে হাসানের। কোনো একদিন, বড়ছেলে ও বৌমা এবং আরও কেউ যুক্ত হয়ে ষড়যন্ত্র করে তাঁর শেষ সম্বলটুকু গ্রাস করে নেবে? তিনি এখনো সুস্থ ও সবল। কারো গলগ্রহ নন। তাঁর শরীর এখনো যথেষ্ট ভালো। এমন কি হতে পারে, সবাই মিলে রাতের অন্ধকারে তাঁর সবকিছু লিখে নিয়ে যাবে। তারপর তাঁকে খানিকটা পাগল করে দিয়ে দূরগামী কোনো ট্রেনে তুলে দেবে? এসব ভাবতে ভাবতে রাত বাড়তে লাগলো। রাত গভীর হলো। আরও গভীর। একসময় রাত ভোর হলো। সারা রাত নির্ঘুম কাটলো রশীদ তালুকদারের, এক ফোটা ঘুম হলো না।
ভোরের দিকে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলেন। তিনি, ঘর ও বারান্দায় ভীষণ পায়চারী করছেন। কী সব ভাবনা তাঁর মাথায় খেলে যেতে লাগলো। শরীর ভালো, কিন্তু তাঁর মনে অনেক দুঃখ ও যন্ত্রণা। দুঃখের সবটা তিনি জানেন বা তিনি অপরাধী, এমন নয়। কে অপরাধী? তিনি জানেন না। তাঁর দুঃখের ভারও কমে না। স্বপ্নের ভেতরেই টুকরো ও খসে পড়া ভাবনার মধ্যে তিনি ঘুরপাক খেতে লাগলেন। ঘর ও বাইরের প্রিয় ও চেনা মুখগুলো পাশ কাটিয়ে তিনি কি বাড়ি থেকে পালিয়ে বাঁচবেন? অচেনা কোনো গ্রামে বন্ধু বা দূরসসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে গা ঢাকা দেবেন?
একবার ভাবলেন, ভরসন্ধ্যায় পকেটে কিছু টাকাপয়সা নিয়ে একটা মদের দোকানে গিয়ে বসবেন। পান ও নিমজ্জন শেষে দুলতে থাকা শরীর ও পা ফেলে তিনি এলোমেলো হেঁটে রাস্তায় নেমে পড়বেন। গাড়ি ও মানুষ কাউকেই খেয়াল করবেন না; জরুরি হর্ন শুনে সরে যাবেন না। যেন তিনি কিছুই শুনছেন না, দেখতেও পাচ্ছেন না। এমন সময় হঠাৎ একটা ট্রাক কড়া ব্রেক করতে করতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছুটে আসতে থাকবে আর থেতলে দিয়ে প্রায় পালিয়ে যাবে। ভিড়ের ভেতর কে আর এতসব খেয়াল করবে। পরদিন খবরের কাগজে ছাপা হবে: ...পড়েছিল লোকটি, রাস্তার ঠিক মাঝখানে। চিত হয়ে। চোখদুটো খোলা ছিল। পাথরের চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলেন। যেন কতকাল তিনি আকাশ দেখেননি।
বাইরে দরজায় ধাক্কাচ্ছে কেউ। রশীদ তালুকদারের ঘুমটা হালকা হতে হতে আলগা হয়ে গেল। দাদু, দরজা খোলো। দরজা খোলো...। ফারিয়ার গলাটা টের পেলেন তিনি। কিন্তু মেয়েটা কাঁদছে কেন? দাদু দরজা খোলো। মায়ার সর্বনাশ করেছে যে, ওই লোকটাকে পাওয়া গেছে।
রশীদ তালুকদারের কান ভোঁ ভোঁ করতে লাগলো। বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে দেবার ফুরসত পেলেন না। সবকিছু ভুলে মাথার ওপরে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তেরচা চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন।