অর্থনীতি

পুঁজিবাজারের জন্য সুখবর নেই বাজেটে

আগামী ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো সুখবর নেই। মন্দা পুঁজিবাজার এবারের বাজেটে কোনো প্রণোদনা তো পেলই না, বরং মূলধনী মুনাফার (ক্যাপিটাল গেইন) ওপর কর বসানো হয়েছে। এছাড়া, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি বা তহবিলের সিকিউরিটিজ বা শেয়ার হস্তান্তরের জন্য ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। পাশাপাশি প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার অপরিবর্তিত থাকলেও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্র ২.৫০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজার গতিশীল করার লক্ষ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ (ডিবিএ) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কর ছাড়, নীতি সহায়তাসহ বেশকিছু দাবি জানিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে। তবে, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দাবি ছিল, ব্যক্তি শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে নতুন করে যেন কর আরোপ করা না হয়। কিন্তু, সেই দাবি শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। বরং, শেয়ার কেনাবেচায় নির্দিষ্ট অর্থবছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি যত টাকা মুনাফা হবে, তার ওপর সরকারকে ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

গত দুই সপ্তাহ ধরে পুঁজিবাজারে গুঞ্জন ছিল যে, আগামী বাজেটে মূলধনী মুনাফার ওপর কর বসাতে যাচ্ছে সরকার। এর ফলে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন পরিলক্ষিত হয়েছে। যেটা এবার তা সত্যি হলো।

আগামী বাজেটে মূলধনী মুনাফার ওপর কর আরোপ করা হচ্ছে, এমন খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকে বিষয়টি আলোচনায় আসে। ডিএসই ও সিএসই কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে, এই করারোপ না করার দাবি জানায়। তবে, শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্টদের সে দাবি শেষ পর্যন্ত শোনেননি অর্থমন্ত্রী।

অর্থমন্ত্রী বাজেটে প্রস্তাব করেছেন, ব্যক্তি শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত মূলধনী মুনাফায় কোনো কর বসবে না। তবে, ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করলে তার ওপর কর দিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, সেকেন্ডারি বাজারে শেয়ার লেনদেন করে কোনো বিনিয়োগকারী এক বছরে ৫৫ লাখ টাকা মুনাফা করেছেন। সে ক্ষেত্রে মুনাফার ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত সুবিধার আওতায় থাকবে। বাকি ৫ লাখ টাকা মুনাফা ওই বিনিয়োগকারীর মোট আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। তাতে ওই বিনিয়োগকারীর নির্দিষ্ট একটি অর্থবছরে তার মোট আয়ের ওপর যে হারে কর প্রযোজ্য হবে, সেই হারে কর দিতে হবে। তবে, কোনো বিনিয়োগকারী যদি কোনো শেয়ার একটানা ৫ বছর ধরে রেখে ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করেন, সে ক্ষেত্রে ওই মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে।

বাজেটে আরও প্রস্তাব করা হয়েছে, ব্যক্তি শ্রেণির বিনিয়োগকারীর বাইরে কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে যে মুনাফাই করুক, সেই মুনাফার ওপর কর আরোপ হবে।

এদিকে, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট কর হারে কোনো পরিবর্তন আনেননি অর্থমন্ত্রী। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি যদি তাদের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারবাজারে ছাড়ে, তাহলে ওই কোম্পানির ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে করপোরেট কর আগের মতোই ২০ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। শর্ত পূরণ না করলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে এ করহার হবে ২২.৫০ শতাংশ। আর যেসব কোম্পানি পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের কম শেয়ারবাজারে ছাড়বে, তাদের ক্ষেত্রে শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে করপোরেট করহার হবে ২২.৫০ শতাংশ। এ ধরনের কোম্পানির ক্ষেত্রে যারা শর্ত পালন করবে না, তাদের ক্ষেত্রে এ করহার হবে ২৫ শতাংশ।

তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ কম করপোরেট করের সুবিধা পেতে যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেটি হলো—৫ লাখ টাকার বেশি একক লেনদেন ও বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকার বেশি লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে। এ শর্ত পালন না করলে কোম্পানিগুলো কম করপোরেট করের সুবিধা পাবেন না।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। তাদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক, প্লেসমেন্ট শেয়ারধারী, স্টক ব্রোকার ও ডিলার। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সবাই মূলধনী মুনাফার ওপর সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হারে কর দেন। মূলধনী মুনাফার ওপর কর দেন না শুধু ব্যক্তি শ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, যা পুঁজিবাজারের মোট বিনিয়োগকারীর মাত্র ১০ শতাংশ। এছাড়া, নতুন বাজেটে শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তি উৎসাহিত করতে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করহারের ব্যবধান বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কমিয়ে সাড়ে ১৭ শতাংশ করার দাবি করেছিল ডিএসই কর্তৃপক্ষ। আর অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে সাড়ে ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ করার দাবি করা হয়। কিন্তু, অর্থমন্ত্রী এই দাবিও আমলে নেননি। বরং, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত করহার ব্যবধান কমানো হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজার থেকে ক্যাপিটাল গেইনের ওপর কর আরোপ করা একেবারেই যুক্তিযুক্ত হয়নি। এখন বাজারের যে অবস্থা, তাতে বিনিয়োগকারীরা ক্যাপিটাল গেইন তো দূরের কথা, লোকসান গুনতে হিমশিম খাচ্ছে। এছাড়া, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত করহার ব্যবধান কমানো হয়েছে। এতে নতুন করে কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হতে আরও নিরুৎসাহিত হবে। সরকারের এই নীতির ফলে পুঁজিবাজার সার্বিক অর্থনীতির তুলনায় আরও পিছিয়ে পড়বে ও সংকুচিত হবে। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আমি খুবই হতাশ।

ডিবিএ প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম গণমাধ‌্যমকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত বিমাতাসুলভ আচরণ। পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে আমরা সরকারের কাছে নীতি-সহায়তা চেয়েছিলাম। সরকার উল্টো করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে, মূলধনী মুনাফার ওপর করারোপ না করার জন‌্য অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত করতে করপোরেট করহার ব্যবধান বাড়ানো এবং সিকিউরিটিজ লেনদেনের ওপর অগ্রিম আয়কর কমানোর জন‌্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু, বাজেটে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি।