মতামত

বাংলাদেশ ক্রিকেট: শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় ও সাম্প্রতিক আলোচনা

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের জন্য বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন। ডি গ্রুপের দলগুলো হলো-দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, নেদারল্যান্ডস, বাংলাদেশ ও নেপাল। সুপার এইটে যেতে হলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশকে জিততেই হতো। না জিতলে সমীকরণ খুব কঠিন ছিল। হিসাব বলছে বাংলাদেশ হেরে গেলে নেদারল্যান্ডস অথবা শ্রীলঙ্কা–এ দুই দলের যেকোনো একটি দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গী হতো। যদিও চার-পাঁচ ওভার আগেই অন্তত ৬ উইকেট হাতে রেখে জয় পেলে ভালো লাগতো।

দলের একজন সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে সাকিবের ১৪ বলে ৮ রান করে আউট হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। রিশাদও তার অযৌক্তিক আউট হওয়ার দায় এড়াতে পারবেন না। আমাদের এখন নেদারল্যান্ডস এর বিপক্ষে জয়ের বিকল্প নেই। 

অনেকেই পত্রিকায় প্রকাশিত এসব মতামত বা আলোচনাকে গুরুত্ব দিতে চান না। আমার ক্ষেত্রেই ধরুন, মাঠে গিয়ে খেলতে গেলে আমার ব্যাটে বলই লাগবে না। এরপরও খেলার বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা অনেক গুরুত্ব বহন করে। এমনকি মাঠের বাইরের আলোচনাও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ১৫ সদস্যের যে দল সাজানো হয়েছিল তাতে মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর জায়গা হয়নি। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি এবং ক্রিকেটপ্রেমীদের সমালোচনা মুখে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তিনি সেরা একাদশে স্থান পান। দলে সুযোগ পাওয়া নান্নু প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি করেন। স্কটিশদের বিপক্ষে চাপের মুখে করা তার ফিফটিই মূলত বাংলাদেশকে জয় এনে দিয়েছিল। সে সময় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেছিল।

যদিও মিডিয়াতে এসব আলোচনা খেলোয়াড়দের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ তৈরি করে। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয় কারণ ছাড়াই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। যেমন, মায়ের দোয়া ক্রিকেট টিম এখন নেটিজনদের মুখে মুখে। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ স্টুয়ার্ট ল (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কোচ) বাংলাদেশের মিডিয়াকে এ কারণে দোষারোপ করেছেন। তবে সবকিছুর পর ইতিবাচক সমালোচনা দলের জন্য নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনা করতে চাই। যথারীতি সৌম্যের গোল্ডেন ডাক দিয়ে শুরু। আমি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি ফুটওয়ার্কবিহীন এক ব্যাটার যে দলে আছে সে দলের ব্যাটিং দৈন্যতা নিয়ে নতুন করে কিছু লিখতে হয় না। ফুটওয়ার্ক না থাকলে ইনিংসের শুরুতে নতুন বলের কারণে এলবিডাব্লিউ হওয়া কিংবা সহজ ক্যাচ দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। বড় টুর্নামেন্টে ‘বড়’ এবং ‘অভিজ্ঞ’ প্লেয়ার লাগে। তামিম ইকবাল প্রসঙ্গ বাদ দিলেও মিরাজ কেন নাই-এ কথাও ঘুরে ফিরে আসছে। হুটহাট জায়গা করে নেওয়া তানভীর ইসলামের স্থলে মিরাজ থাকতেই পারতেন। এক বিপিএল এর পারফরম্যান্স কীভাবে দলে জায়গা নেওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়? ফিজিক্যালি ফিট থাকা সাপেক্ষে মুশফিকের বিষয়টাও এখানে আলোচনায় থাকবে।

একজন ডানহাতি ব্যাটার হওয়ার পাশাপাশি আমার দৃষ্টিতে মুশফিক অন্য একটি কারণেও প্রাসঙ্গিক। যুক্তরাষ্ট্রের মাঠ ছোট হওয়ায় মুশফিককে স্লগ ওভারে কাজে লাগানো যেত। সেক্ষেত্রে মাহমুদউল্লাহকে আরও উপরে উঠে খেলতে হতো। আমার মতে বাংলাদেশের ব্যাটারদের পারফরমেন্স এর মতো ব্যাটিং অর্ডারও ঠিক নেই। আমার ক্রিকেট জ্ঞান যতটুকু আছে তাতে মাহমুদউল্লাহকে তিন বা চারে খেলানোর বিকল্প নেই। তাকে যদি প্রতিবারই দলের হাল ধরতে হয় তাহলে কেন তিনি আগে থেকেই ব্যাট করবেন না? মুশফিক ও মিরাজের না থাকা আর সৌম্যের দলে থাকার বিষয়ে নির্বাচকগণ কিছুতেই দায় এড়াতে পারেন না। জাকের আলীকে দলে নিতে হলে লিটন বা মুশফিক এর মধ্যে একজনকে ব্যাটার হিসেবে বিবেচনায় নিলেই হতো।

উইকেটের চারপাশে শট খেলার যোগ্যতা থাকায় লিটন দাস আমাদের সেরা ব্যাটার; যদিও অনেকদিন ধরেই ফর্মহীন। তবে তাকে সুযোগ দিতে হবে। একটা ভালো ইনিংস কিংবা দলে ভালো কোনো অবদান তাকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।  শ্রীলঙ্কার ইনিংসে ধনঞ্জয়া ডি সিলভাকে লিটনের দুর্দান্ত স্ট্যাম্পিং এর সময় আমার মনে হয়েছিল যে তিনি উজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারেন। বিশেষ করে, স্ট্যাম্পিং শেষে তার আত্মবিশ্বাসী দেখে বেশ ভালো লেগেছিল। আমাদের ক্যাপ্টেনকে নিয়ে কী লিখবো বুঝতে পারছি না! একজন ক্যাপ্টেনকে কীভাবে দল থেকে বাদ দেওয়া যাবে? সত্যি বলতে, টি-টুয়েন্টি ফরম্যাটের সাথে তিনি কোনোভাবেই যান না। কারণগুলো এরকম। শান্ত উইকেটে সেট হতে সময় নেন। আবার তিনি স্ট্রোক প্লেয়ারও নন। ফলে টি-টুয়েন্টির মতো স্বল্প দৈর্ঘ্যের ম্যাচে তিনি বেমানান হয়ে উঠেন। ছোট ফরম্যাটের কারণে উইকেটে সেট হওয়ার আগে রান তোলার চাপ থেকে নাজমুল শান্ত বের হতে পারছেন না। জানি না কোন যুক্তিতে তিনি নির্বাচকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন! সাকিবকে নিয়ে লেখার কিছু নেই।

বিগত দিনে অনেকবার বিশ্বসেরার তকমা পাওয়া এ ক্রিকেটারকে তার নিজের সরূপে ফিরতে হবে। তিনিই ভালো জানবেন তাকে কী করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মুস্তাফিজকে দেশের মাটিতে সর্বশেষ সিরিজে না খেলিয়ে আইপিএল এর আরও ম্যাচ খেলানো যেত। লক্ষণীয় যে, মুস্তাফিজ এর বোলিংয়ে নতুন কৌশল যুক্ত হয়েছে। চেন্নাই সুপার কিংসে ধোনির নির্দেশনায় মুস্তাফিজকে অফস্টাম্পের বাইরে বল করতে দেখা গেছে যেখানে ধোনি উইকেটের পিছনে না থেকে অফস্টাম্পের বেশ বাইরে থেকে কিপিং করেছেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও মুস্তাফিজ এভাবে বল করে সফলতা পেয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র বা ওয়েস্টইন্ডিজের উইকেট বিবেচনায় আমাদের দলে সব ম্যাচেই তিনজন পেসার খেলানো যৌক্তিক হবে। এর কারণ মূলত দুটি। এক. মাঠ ব্যাটিং সহায়ক, দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে স্পিন নেই বললেই চলে। দুই. মাঠ বেশ ছোট, ভুল টাইমিং করেও স্পিনারদের উড়িয়ে মারা সহজ। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের মাঠে বেশ অসমান বাউন্স দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বল নিচু হয়ে আসছে।

আয়োজক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কতটা সফল তা সময়ই বলে দিবে। তবে এর মাঝে অনেক বিষয় নেতিবাচকভাবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে, ক্রিকেট নিয়ে যারা ভাবেন তারা বলছেন যে বরাবরের মতো ভারতের প্রতি পক্ষপাত করা হয়েছে। যেমন ধরুন, সেমিফাইনালের ভেন্যু জেনে যাওয়ায় ভারত তাদের দলে বাড়তি স্পিনার রেখেছে। কারণ সেমিফাইনালের ভেন্যু গায়ানার পিচ অনেকটা উপমহাদেশের মতো; বেশ মন্থর এবং বল নিচু হয়ে আসার কারণে স্পিন হয়। এছাড়া, ভারতীয় দর্শকদের সময় বিবেচনায় নিয়ে তাদের খেলার সময়সূচি ঠিক করা হয়েছে। যদিও তা হতেই পারে। কারণ দর্শকদের জন্যই এ টুর্নামেন্ট। তবে ক্রিকেটের এ বৈশ্বিকীকরণের ফলে আমাদের উপমহাদেশের ক্রিকেটই বেশি উপকৃত হবে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের অনেক সাবেক এমনকি বর্তমান ক্রিকেটারগণ বিভিন্ন ভাবে এখন উত্তর আমেরিকার ক্রিকেটের সাথে যুক্ত হচ্ছেন। প্রকারান্তরে যা আমাদের জন্য লাভজনকই হবে। তাপস বৈশ্য, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানালিস্ট সালাউদ্দিন, জুনায়েদ সিদ্দিকিসহ অনেকেই এ তালিকায় রয়েছেন।

নির্বাচকদের দোষ মাথায় নিয়ে আরও কতিপয় বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পত্রিকায় দেখলাম অনুশীলন না করে খেলোয়াড়গণ এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে সময় কাটাচ্ছেন। খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে চাঙা রাখতে এগুলো প্রাসঙ্গিক। তবে টিম কন্ডিশনিং এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন। একটা টুর্নামেন্ট খেলতে আসা দলের সবকিছুই টুর্নামেন্টকেন্দ্রিক হওয়া আবশ্যক। গেম প্ল্যান সেট করা, বিপক্ষ দলের দুর্বলতা নিয়ে এনালাইসিস, নিজের সামর্থ্য নিয়ে টিমের সাথে বোঝাপড়া, প্রয়োজনে বাড়তি অনুশীলন, ইত্যাদি বিষয়গুলো এসব টুর্নামেন্টের জন্য খুবই জরুরি। সব মিলিয়ে একটা ‘আবেশের’ মধ্যে থাকাই বেশি দরকার। পাকিস্তানের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের জয়লাভের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ গেম প্ল্যান। বলতে দ্বিধা নেই, অনেকেই পাকিস্তানের পরাজয়ের পর বাংলাদেশের সিরিজ হেরে যাওয়াকে মেনে নিচ্ছেন। এটা পেশাদার একটা দলের জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ের পর অনেকে নিজের প্রত্যাশাকে বাড়তে দিতে চাচ্ছেন না। গ্রুপের অন্য নব্য শক্তিশালী দল নেদারল্যান্ডস এর বিপক্ষে জয় আসবে কি-না সেটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নেদারল্যান্ডস এর পেস আক্রমণ বেশ শক্তিশালী; যথেষ্ট এনালাইসিস না করলে বাংলাদেশ ঠকে যেতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়, কেউ বলছেন আমাদের বিগত দিনের পারফরম্যান্স বিবেচনায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এ জয় এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, ট্রমাটাইজড লাগছে। কেউ আবার নিজের উচ্চ রক্তচাপ আর হৃদরোগের সম্ভাবনা পরিহার করতে বাংলাদেশের প্রতি প্রত্যাশা বাড়াতে নারাজ। কথাগুলো কটু হলেও সত্যি এ কারণে যে বাংলাদেশের ক্রিকেটের বয়স এখন অনেক। দীর্ঘ সময় ধরে আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশ হিসেবে আরও অনেক সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ক্রিকেটপ্রেমীগণ আসলে নিজেদের কোনো ম্যাচেই হারতে চান না–এটা অযৌক্তিক কিছু নয়; এটাই হয়তো দেশপ্রেম।

লেখক: একজন ক্রিকেটপ্রেমী ও উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক