উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

কাঁচা চামড়ার দামের সঙ্গে তুলনা করে পণ্য দেওয়া সম্ভব না: তাসলিমা

‘অবশ্যই চামড়ার দাম বৃদ্ধি পাওয়া উচিৎ। কিন্তু দাম না বাড়ার কারণে কসাইরা খুব অযত্ন নিয়ে চামড়া ছাড়াইয়ের কাজ করে থাকেন। যারা কাঁচা চামড়া ক্রয় করেন, তাদের সবাই এক না। ট্যানারি মালিকরা কিন্তু ভালো চামড়া ঠিকই বেশি দামে ক্রয় করেন। পশু মালিকের পর চার থেকে পাঁচটা হাত বদল হয়ে ট্যানারি মালিকের কাছে আসে। তখন ভালো চামড়ার দাম অনেক বেড়ে যায়।’

এমনটাই বলছিলেন সফল নারী উদ্যোক্তা তাসলিমা মিজি। সম্প্রতি তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমই) উদ্যোক্তা পুরস্কার-২০২৩ পেয়েছেন। জাতীয় এসএমই পণ্যমেলা-২০২৪ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে তিনি ‘বর্ষসেরা নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার নেন। 

এসএসসি পাশের পরই শিক্ষার জন্য ঢাকাতে চলে আসেন চাঁদপুরের মেয়ে তাসলিমা। সর্বশেষ ২০০১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান থেকে মাস্টার্স শেষ করে সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

উদ্যোক্তা হিসেবে পথচলার গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি আসলে ওভাবে চিন্তা-ভাবনা করে উদ্যোক্তা হইনি। সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকা অবস্থায় আমার ছেলে হয়। তখন চাকরি করাটা একটু কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ছেলেকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি কাজ করতে পারবো এমন কিছু খুঁজছিলাম। তখন মনে হলো, আমি হয়তো উদ্যোক্তা হিসেবে ভালো করতে পারবো। তখন ২০০৮ সালে চাকরি ছেড়ে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে কম্পিউটার ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু সেটা ট্রেডিং ব্যবসা হওয়ায় আমার তেমন ভালো লাগছিল না। মনে হচ্ছিল, আমার কোনোকিছু নিজের মতো করে উৎপাদন করা দরকার। এরই মধ্যে আমার লেদারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপর লেদার নিয়ে অনেক পড়াশোনা করি। মোটামুটি ধারণা পাওয়ার পর ২০১৬ সালে কম্পিউটার ব্যবসা ছেড়ে সেটা নিয়ে কাজ শুরু করি। ২০১৬ সালের শেষের দিকে সাভারের হেমায়েতপুরে কারখানা প্রতিষ্ঠা করি।

নিজের চামড়ার কারখানা প্রতিষ্ঠার আগে ২০১৬ সালের শুরুতে বিভিন্ন কারখানা থেকে ডিজাইন দিয়ে পণ্য বানিয়ে নিতেন। তারপর নিজের কারখানা প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন ধরনের চামড়ার ব্যাগ তৈরি করে গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন। বর্তমানে তার কারখানায় অন্তত ৬০ জন স্টাফ রয়েছে।

তিনি বলেন, আমি খাঁটি চামড়া দিয়ে ব্যাগ তৈরি করি। এর মধ্যে ফ্যাশন ব্যাগ, কর্মজীবী নারী ও ব্যবসায়ীদের ব্যাগসহ বিভিন্ন ট্রেন্ড অনুসারে তৈরিকৃত ব্যাগও রয়েছে। এসব পণ্যগুলো বিক্রির জন্য ধানমন্ডি-২৭ এ শো-রুম ও ইউনিমার্টে একটা কর্নার আছে। এছাড়া আমার ওয়েবসাইট ‘গুটিপা ডটকম’ ও ফেসবুক পেজ ‘গুটিপা’র মাধ্যমে পণ্যগুলো বিক্রি বেশি করি।

দেশের মার্কেটে বিক্রির পাশাপাশি তিনি তার পণ্যগুলো সরাসরি নেদারল্যান্ড, জার্মানি, দুবাই, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে সরাসারি রপ্তানি করেন। তবে তার এ পর্যন্ত আসাটা খুব সহজ ছিল না। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করতে হয়েছে। তবে তার প্রতিবন্ধকতা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য কাজ করাটা একটু কঠিন। ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করা আরও কঠিন। তারপরও যারা কাজ করে, তাদের একটা বড় অংশ বুটিক ও বিউটি ব্যবসার সঙ্গে আছেন। আর চামড়া পণ্য তৈরি ও বিক্রির এ ব্যবসাটা এমনিতেই কঠিন, সেখানে মেয়েদের কাজ করাটা আরও কঠিন। সামাজিকতারও একটা বিষয় আছে। সবমিলিয়ে আমার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্টেকহোল্ডাদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় অনেক সময় সমস্যা হয়। তারা মেয়েদের খুব একটা নির্ভরযোগ্য মনে করে না। লোন আনতে গেলে পরিশোধ করতে পারবো কিনা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সন্দেহ প্রকাশ করে। আবার একজন নারী যদি নিজের মতো ব্যবসা করতে চায় বা একটা পুঁজি চায়, সাধারণত ছেলেদের তুলনায় তার আর্থিক সাপোর্টটা পরিবার থেকে কম থাকে। পরিবার অনেকক্ষেত্রে আর্থিক সাপোর্ট দিতে চায় না।

তাসলিমা বলেন, মেয়েদের চলাচলে সামাজিক বাধা আছে, সময়ের দিকদিয়েও বাধ্যবাধকতা আছে। চাইলেই যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় যাওয়া যায় না। এর মধ্যে আবার বিশাল একটা পারিবারিক দায়িত্বও আছে। ছেলেরা তাদের স্বাধীনতার কারণে কাজের জন্য লম্বা সময় পায়, মেয়েদের জন্য সেটা সম্ভব হয় না। সবমিলিয়ে দেখা যায়, পরিবার সামলিয়ে মেয়েদের কাজ করা কঠিন।

তবে এসব সমস্যার চেয়ে দেশের মানুষের সচেতনতা ও মানসিকতাতে বড় সমস্যা হিসেবে দেখেন তাসলিমা মিজি। তিনি বলে, আমরা দেশি পণ্য তৈরি করি। এ পণ্যটা যত ভালো করেই তৈরি করি না কেনো, সবার বিদেশি পণ্যের প্রতি ঝোঁক রয়েছে। দেশের মার্কেট আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত না। এ বিষয়ে আমাদের সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। তারা যেন নিজের দিক থেকে দেশি পণ্য ব্যবহারে আগ্রহী হয়। তবে এটা সত্য যে, দিনদিন দেশি পণ্য ব্যবহারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, সেটা আরও বেশি হওয়া উচিৎ। 

উদ্যোগের শুরুতে কত টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চামড়া নিয়ে কাজ করতে গেলে মোটামুটি বড় মাপের একটা বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। আবার কত ধরনের পণ্য তৈরি করা হবে তার উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ আরও বেশি দরকার পড়ে। আমি শুরু করেছিলাম প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে। তবে একবারে এতো টাকা নিয়ে শুরু করিনি। অল্প অল্প করে বিনিয়োগ করেছি।

তিনি ভবিষ্যতে খুবই উচ্চমানের পণ্য উৎপাদন করতে চান। সবাইকে দেখাতে চান, দেশেও অনেক ভালো মানের চামড়ার পণ্য তৈরি হয় এবং সেটা নিয়ে আন্তার্জাতিক মার্কেটেও প্রতিযোগিতা করা যায়।

কাঁচা চামড়া ও চামড়ার তৈরি পণ্যের দামে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফিনিশিং চামড়া আর কাঁচা চামড়া মধ্যে পার্থক্য আছে। কাঁচা চামড়াকে এ পর্যন্ত আনতে অনেকগুলো ধাপ পার করতে হয়। এর সঙ্গে নানা দ্রব্যের সংযুক্তি থাকে। এখানে শুধু কাঁচা চামড়ার দামটাই মুল বিনিয়োগ না। এর সঙ্গে শ্রমিক, লবন, কেমিক্যাল, চুন, পানি, গুদাম ভাড়াসহ নানা খাতে প্রচুর খরচ আছে। একটা নিখুঁত চামড়া প্রস্তুত করতে বিভিন্ন ধরনের প্রচুর কেমিক্যাল প্রয়োজন হয়। আগের চেয়ে এখন শ্রমিকদের বেতন, কেমিক্যালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এসব কেমিক্যাল সম্পূর্ণ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আগের চেয়ে শিপিং খরচ বেড়েছে, গুদামজাত বাবদ খরচ বেড়েছে। ট্যানারি মালিকরা কাঁচা চামড়াটা হয়তো একটু সস্তায় পান, কিন্তু এটা মোট খরচের সামান্য একটা অংশ।

তিনি আরও বলেন, আবার কাঁচা চামড়ায় যেহেতু পর্যাপ্ত দাম পাচ্ছে না, অনভিজ্ঞ কসাই দিয়ে যে পদ্ধতিতে চামড়া সংগ্রহ করা হয়, সেখানে খুবই অযত্ন থাকে। অনভিজ্ঞ কসাইরা খুবই অযত্ন নিয়ে চামড়া সংগ্রহ করেন। ফলে দেখা যায়, চামড়াগুলো নষ্ট হয়ে যায়। অযত্ন নিয়ে সংগ্রহ করার কারণে স্পট পড়ে গেলে ব্যবহারযোগ্য অংশটা কমে যায়। আবার কাঁচা চামড়া থেকে চামড়ার পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত একটা দীর্ঘ চেইন অতিক্রম করতে হয়। সেখানেই দামের একটা বড় পার্থক্য তৈরি করে।

কাঁচা চামড়ার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত না এবং ট্যানারি করারও ইচ্ছে নেই এমনটা জানিয়ে এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, আমি প্রক্রিয়াজাত করার পর ব্যবহার উপযোগী চামড়া কিনি। এটা কিন্তু আমাদের বেশি দামেই কিনতে হয়। মানে আন্তার্জাতিক বাজারে যে দাম নির্ধারণ করা থাকে, সে দামেই কিনতে হয়। সেক্ষেত্রে কেউ যদি আশা করেন কাঁচা চামড়ার দামের সঙ্গে তুলনা করে আমরা পণ্য দিব, সেটা সম্ভব না।

উদ্যোগ পরিচালনার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উদ্যোক্তাদের অনেক সহযোগিতা করছে বলে মনে করেন তাসলিমা মিজি। তিনি বলেন, এটা আমাদের অনেক বড় প্লাটফর্ম দিচ্ছে। যে কেউ চাইলে, খুব সহজেই একটা অ্যাকাউন্ট বা পেজ খুলে, দুই-একটা ছবি আপলোড দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারে। আবার ‍খুব সহজেই বন্ধুদের বা কাছে মানুষের পেজ ফলো, লাইক দিতে বলতে পারি। সেখানে অনকে বড় মার্কেটপ্লেস আছে। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাছে আমরা অনেক ঋণী।

নতুন করে যারা উদ্যোক্তা হতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে এ সফল নারী উদ্যোক্তা বলেন, কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইলে আগে এসব প্রযু্ক্তি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আর সে যে পোডাক্ট নিয়ে কাজ করতে চায়, তার ওই বিষয় নিয়ে পর্যাপ্ত ধারণা থাকতে হবে। ওমুক চামড়ার ব্যাগ নিয়ে কাজ করছে, আমিও করবো; ওমুক বুটিক নিয়ে করছে, তমুক রেস্টুরেন্ট নিয়ে কাজ করছে, আমিও করবো। এমন করলে হবে না। আমি ওই বিষয়টি নিয়ে বুঝি কিনা, সেটা আগে দেখতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করেই উদ্যোগ শুরু করা উচিৎ। আমি চামড়া নিয়ে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। একদিনে এ জায়গায় আসিনি।