শিল্প ও সাহিত্য

চে’র লড়াইয়ের নিত্যসঙ্গী কবিতা 

আর্নেস্ত চে গেভারা বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী। মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে পৃথিবীর দেশে দেশে তিনি বিপ্লবের বার্তা নিয়ে গেছেন। মানুষের মুক্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন। ফ্যাসিস্ট শাসকের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ করেছেন। তিনি কোথাও সফল হয়েছেন, কোথাও হননি। জীবনের কোনো মুহূর্তকে তিনি অপচয় করেননি। যেখানে বুঝেছিলেন বিপ্লব সম্ভব নয়, সেখানে থেকে ফিরে গেছেন এক দেশ হয়ে আরেক দেশের প্রান্তরে। তাঁর মতো গণতন্ত্র ও সাম্যের আদর্শে অবিচল এমন মানুষ পৃথিবীতেই বিরল। নির্যাতিত আর বুভুক্ষু মানুষের মুখ তাঁকে পীড়িত করত। তাই মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় জীবন সঁপে দিয়েছিলেন তিনি।   

চে ছিলেন আইরিশ পিতা আর আর্হেন্তিয়ান মায়ের সন্তান। আর্হেন্তিয়ায় তাঁর পরিবার বামপন্থী রাজনীতিতে প্রভাবিত ছিল। সেখানেই কমিউনিস্ট নেতৃত্বের মাধ্যমে তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি। পড়েছেন চিকিৎসাবিদ্যায়। তবে তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল ইতিহাস ও সাহিত্য। রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য কবির কবিতা তাঁকে আলোড়িত করেছে। অসংখ্য কবির কবিতা তাঁর ঠোঁটস্থ ছিল। গেরিলা যুদ্ধের অবসরে কিংবা প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে তিনি প্রিয় কবিতা পড়ে শোনাতেন। কবিতার এই অনুপ্রেরণা তিনি রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম আর গেরিলা যুদ্ধে কাজে লাগিয়েছেন। 

কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম নায়ক তিনি। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতেই কিউবার বিপ্লবের পর চে কিছুদিন কাস্ত্রো সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। সে সময় পৃথিবীর দেশে দেশে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম জোরদার হচ্ছিল। চে কিউবা ছেড়ে চলে গেলেন আফ্রিকার কঙ্গোতে। কিন্তু সেখানে লড়াইয়ে সফল হননি। ফিরে আসেন লাতিন আমেরিকায়। চে প্রথম প্রবেশ করেন উরুগুয়েতে। তারপর বলিভিয়ায়। সেখানে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন একদল গেরিলা যোদ্ধার। কিন্তু সে যাত্রায় চে’র অভিযান সফল হয়নি। ফুরিয়ে এসেছিল জীবনের দিন।

১৯৬৭ সালে বিপ্লবী চে গেভারা আটক হন মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে। বাহিনী তাঁর কাছে পেয়েছিল একটি হাতব্যাগ। তাতে ছিল বারোখানা ফিল্মের রোল, দুটো ডায়েরি, আঁকাআঁকি করা বিশটির মতো ম্যাপ, একটি বহনযোগ্য রেডিও আর সবুজ নোটবই। উদ্ধার করা জিনিসের মধ্যে মার্কিন বাহিনীর কাছে সবচেয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল ডায়েরিগুলোই। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর, অনেক হাত ঘুরে চে’র সবুজ নোটবুক ফেরত দেয় বলিভিয়ার গোয়েন্দা দপ্তরে। আশির দশকে বলিভিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সরকারি কর্মকর্তা এটি পৌঁছে দেন কিউবায়। তারও আগে সবুজ নোটবুক নিয়ে চাঞ্চল্যকর এক ঘটনা ঘটেছিল। 

চিলির তৎকালীন স্বৈরশাসক লুইস মেসা চে’র নোট বিক্রি করে দিয়েছিলেন এক ব্রাজিলিয়ানের কাছে। সে আবার বিক্রি করেছিল ব্রিটিশ সংস্থা সথেবির কাছে। কারও কারও ধারণা, ওই ব্রাজিলিয়ান মেসা আর সথেবি নোটবুক বিক্রির দূতিয়ালি করেছিল। এ নিয়েও নানা বিতর্ক আছে। 

কাহিনি যা-ই থাকুক না কেন, তবে ’৮৪ সালের সেই চাঞ্চল্যকর ঘটনা প্রকাশ পায় ব্রিটিশ সংস্থা সথেবি ‘সবুজ নোটবুক’ নিলামে তোলার পর। সথেবি দর হাঁকিয়েছিল ২৫০ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং। অবশ্য বলিভিয়ার সরকার আর চে’র পরিবারের চাপের মুখে সংস্থাটি এটার নিলাম থেকে সরে আসে। বছরের পর বছর বিতর্ক চলেছিল সবুজ নোটবুক নিয়ে। বলা যায়, গবেষণার আগে সবুজ নোটবই নিয়ে রহস্যের অন্ত ছিল না!

২০০২ সালে এক বন্ধুর মারফতে মেহিকোর প্রখ্যাত বামপন্থী বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও অধ্যাপক পাকো তাইবোর হাতে আসে চে’র সবুজ নোটবুকের ফটোকপি। তাঁর মতে, ‘নোটবুকটি লেখা শুরু হয়েছিল দারাস সালামে থাকার শেষ দিকে। ১৯৬৫ সালের কঙ্গো অভিযানের পরে।’ আর ‘নোটবুকের শেষের কিছু অংশ লেখা হয়েছিল বলিভিয়ার অভিযানের সময়ে।’ নোটবুক নিয়ে তিনি প্রায় টানা ৫ বছর গবেষণা করেন। কারণ, এতে সমস্যা ছিল অন্য। বইয়ে লেয়ন ফেলিপের একটি কবিতার শুধু শিরোনাম ছিল। নোটবুকের পাতায় আর কোনো কবির নাম ও কবিতার শিরোনাম ছিল না। তবে হস্তাক্ষরের কারণে অধ্যাপক তাইবোর কাছে পরিষ্কার ছিল, এটি চে’রই নোটবুক।

সবুজ নোটবুকের প্রচ্ছদে ছিল আরবি হরফ। তাই ধারণা করা হয়, এটি ক্রয় করা হয়েছিল তানজানিয়ায়, ১৯৬৫ সালে। গবেষক তাইবো পাঁচ বছরের অক্লান্ত গবেষণার পর উদ্ধার করেন, নোটবুকে কবিতাগুলো কার লেখা। বইয়ের ৬৯টি কবিতা ছিল কিংবদন্তি চার স্প্যানিশ ভাষার কবির। দুনিয়াজাদা চার কবি হলেন স্পেনের লিয়ন ফেলিপ, পেরুর সেজার ভাইয়েহো, কিউবার নিকোলাস গ্যিয়েম আর চিলির পাবলো নেরুদা। এমনিতেই স্প্যানিশ ভাষায় চার কবি তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন তখন। তার ওপর চে’র হাতে লেখা কবিতাগুলো তাঁদের দিয়েছিল বিশ্বজুড়ে এক অবিস্মরণীয় মর্যাদা। স্মর্তব্য যে, তাইবোর সম্পাদিত চে’র সবুজ নোটবুক যখন প্রকাশিত হয়, তখন এটি বিক্রি হয়েছিল পাঁচ লাখের অধিক কপি।

কবিতার সাধারণ পাঠ থেকে এটা ছিল আলাদা। কেননা চে’র নির্বাচিত কবিতাগুলো হলো রাজনৈতিক অনুপ্রেরণার অংশ। আর সেটা দিয়েছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতির নতুন ভাষ্য। অধ্যাপক তাইবোর ভাষ্য, ১৯৫২ সালে, যখন তাঁর ২৪ বছর বয়স, বোগতায় দেখা হয় কলম্বিয়ার এক ছাত্রনেতার সঙ্গে। তাঁরা কথা বলেন রাজনীতি নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে। চে তাঁকে বলেন, তিনি নেরুদার সমস্ত প্রেমের কবিতা পড়ে ফেলেছেন।’ ছাত্রনেতা তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন একটি শব্দ দিয়ে। চে সঙ্গে সঙ্গে নেরুদার পুরো কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। বস্তুত কবিতাকে লড়াইয়ের নিত্যসঙ্গী করে নিয়েছিলেন তিনি। সংগ্রামের মাঠে রেখেছেন বন্দুকের পাশে কবিতা।

আমরা চে গেভারার সবুজ নোটবুকের কিছু কবিতা উপস্থাপন করছি। অনুবাদকৃত কবিতাগুলো নেওয়া হয়েছে স্প্যানিশ ও আমেরিকান বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে। কবিতাগুলো এত জনপ্রিয় যে, একেক ভাষায় একেক কবিতার একাধিক অনুবাদ আছে। খোদ ইংরেজি ভাষায় একেক কবিতার একাধিক অনুবাদ আছে। তাতে দেখা যায়, একই কবিতার একেকজনের ভাষায় একেক অনুবাদের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। তাতে কোথাও অর্থের স্বাধীনতা আছে, আবার কোথাও মূলের সঙ্গে মিলও আছে। তবে অনুবাদ নিয়ে যতই সমালোচনা থাকুক না কেন, প্রতিটি কবিতার নতুন অনুবাদ মানে আরেকট ভাষায় নতুন কবিতারই সম্পাদন। আমার অনুবাদের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন কিউবান বংশোদ্ভূত স্প্যানিশ কবি ও সম্পাদক অ্যালেইসা রিবাল্টা গুসমান। নোটবুক নিয়ে কিছু তথ্য নিয়েছি পরিমল বসুর অনূদিত লেখা থেকে। আমরা তাঁদের কাছে অসীম কৃতজ্ঞ।       

লেয়ন ফেলিপ [১৮৮৪-১৯৬৮]

যিশু

যিশু  আমি তোমাকে ভালোবাসি তুমি এক তারা থেকে এসেছো বলে নয় তুমি আমাকে আবিষ্কার করেছো বলেই যে লোকের আছে রক্ত, কান্না দুঃখ… চাবি কৌশল  আলোর জন্য বন্ধ দরোজা খোলার। হ্যাঁ… তুমি শেখালে আমাদের মানুষই ঈশ্বর…  আর এক ক্রুশবিদ্ধ গরিবও তোমার মতোই। আর গোরস্তানে* দাঁড়ানো তোমার বাঁ দিকের সে  এক দুষ্ট চোর… সেও একজন ঈশ্বর!

নোট: মূল কবিতায় ‘গোলগথা’ শব্দটি সমাধিস্থলের নাম। আমরা গোরস্তান অর্থে ব্যবহার করলাম।      সেজার ভাইয়েহো [১৮৯২-১৯৩৮]

ভাই মিগেলের প্রতি

ভাই গো, আজ আমি বসে আছি বাড়ির বাইরে দেউড়িতে, যেখানে তোমার অসীম শূন্যতা অনুভব করি।  মনে আছে আমরা তখন খেলছি, আর আম্মা  আমাদের আদরে ডাকতেন, ‘এখনো বাছারা...’ 

এখনো আমি আগের মতোই লুকিয়ে যাই, এই সব সন্ধ্যার  প্রার্থনা ছেড়ে, হয়তো আমাকে তুমি পাবে না খুঁজে। সিঁড়ির নিচে, কাচারিঘরে, চিলেকোঠায়।  পরে, তুমি লুকোতে, আর আমিও তোমায় পেতাম না খুঁজে।  ভাই গো, সে খেলায়, মনে আছে আমরা একে অন্যকে কাঁদিয়েছিলাম  সে খেলায়, ভাই গো। 

মিগেল, তুমি তোমাকে লুকালে  আগস্টের এক রাতে, ভোরের দিকে, তবে, লুকানো হাসির বদলে, দুখী ছিলে তুমি...  আর এই নিষ্প্রাণ বিকেলে তোমার হৃদয় জোড়া  তোমাকে না পেয়ে খুঁজে হয়রান। আর তার  ছায়া পড়েছে আত্মায়।

শোনো ভাই, দেরি করো না আর  দেখা দাও, ঠিক আছে? মা তো চিন্তা করবেন।         নিকোলাস গ্যিয়েন  [১৯০২-১৯৮৭]

বেত 

কৃষ্ণাঙ্গ   বেত বাগানের পাশে।

ইয়াঙ্কি বেতবাগানের ওপরে। 

জমি   বেতঝাড়ের নিচে।

রক্ত বেরোয় আমাদের! 

পাবলো নেরুদা [১৯০৪-১৯৭৩]

ভোলার কিছুই নেই 

যদি তুমি জিজ্ঞেস করো, কোথায় ছিলাম আমি বলা দরকার তবে, ‘এমন ঘটেই থাকে।’   আমাকে বলতেই হবে পাথরকে কালো করা মাটির কথা  যে নদী বহমানতাকে নিজেই ধ্বংস করেছিল: আমি শুধু সে সব বিষয় জানি পাখিরা হারায় যা, পেছনে ফেলা সমুদ্র, কিংবা আমার বোনের কান্না।

কেন এতশত অঞ্চল? কেন একদিন মিলে  আরেক দিনে? কেন কালো এক রাত জমে  মুখের ওপর? কেন মরা এত? 

যদি তুমি জিজ্ঞেস করো কোথা থেকে এসেছি আমি, আমাকে  বলতেই হবে ভাঙা জিনিসের সাথে কথা, খুব তিক্ত বাসনকোসনের সাথে,  পঁচে যাওয়া মস্তসমস্ত পশুদের সাথে, আর নিজের অসহায় হৃদয়ের সাথে। 

যারা সব অতিক্রম করছে তাদের কোনো স্মৃতিসৌধ নেই  না হয় হলুদ কবুতর যে স্মৃতির অতলে ঘুমায় শুধু চোখের জলে ভাসা মুখ কণ্ঠে জড়ানো আঙুলের স্পর্শ আর পাতা থেকে ঝরা নিঃশেষিত রূপ:  অন্ধকারে চলে যাওয়া দিনের কথা যেদিন আমাদের রক্ত পেয়েছে শোকের স্বাদ। 

এখানেই বেগুনি রঙেরা, আবাবিল পাখিরা সে সব আমাদের আনন্দে দোলায় আর লেজের সারি  দেখতে অবিকল যেন লম্বা রেলের মতোই  যেখানে বয়ে যায় সময় আর পেলবতা।  যেখানে প্রবেশ কঠিন সেখানে প্রতিরোধী হয় দাঁত   সে খোলস ভাঙতে পারি না যেখানে জমেছে নীরবতা তাই জানি না আমি কী জবাব তার:  সেখানে অসংখ্য মৃত আর অসংখ্য জলস্তম্ভ যে ভাঙে লাল সূর্যের আভা  আর অসংখ্য মাথা যে ঠোকে জাহাজের বেড়ে আর অসংখ্য হাত যে ঠেকায় চুম্বন আর আমি ভুলে যেতে চাই অনেক কিছু।