‘বাবরের মতো পিতৃস্নেহে কত রাত তুমি জেগেছো শিয়রে দেখেছি তোমার উদ্বিগ্ন আঁখি, চোখ মেলে নির্ঘুম রাতে।’
বাবা, আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা। বাবা এক মায়ার নাম, এক ছায়ার নাম, চোখের সামনে ভেসে ওঠা এক জীবনযোদ্ধার নাম। আমার কাছে বাবা মানে নতুন ভোরের আলো, মানে বেঁচে থাকার আলো। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন। তাই তো কবি বলেছেন, ‘বাবার হাতে খুললো মোদের জীবন পাখা, বিশ্বটাকে প্রথম মোদের বাবার চোখে দেখা।’
পৃথিবীর আলো দেখার পর থেকে যে মানুষটা আমাদের একটু সুখের জন্য, আমাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণের জন্য নিজের সব সুখ ও স্বপ্ন বিসর্জন দেন, তিনি হলেন বাবা। বাবা মানে মাথার ওপর ছায়া দেওয়া এক বটবৃক্ষের নাম, যা সব ঝড়-ঝাপটা নিজে মাথা পেতে নেয়। সন্তানকে একটু ভালো অবস্থানে রাখতে যিনি প্রতিনিয়ত সয়ে যান সব দুঃখ কষ্ট।
বাবাদের কাঁধ বোধ হয় অনেক শক্ত হয়। তা-না হলে সংসারের বোঝা কী করে বহন করেন তিনি? কিছুটা ভারী স্বভাবের বাবাকে অনেক সন্তানই ভয় পান। কিন্তু সেই ভারত্বের আড়ালে উঁকি দিলেই দেখা যায় ত্যাগের পাহাড়। নিজের কষ্ট সবার থেকে আড়াল করে রাখেন তিনি। তাই হয়তো অদৃশ্য দেয়ালে ঢাকা পড়ে বাবার ভালোবাসার গভীরতা। বাবার চিন্তা থাকে শুধু পরিবার আর সন্তান। কীভাবে সন্তানের চাহিদা পূরণ করবে, কীভাবে পরিবারের সব চাহিদা পূরণ করবে সেই চিন্তা নিয়েই বাবা নামক মানুষটির জীবন কাটে। মৃত্যুর আগেও বাবা নামক মানুষটি তার সন্তানের জন্য চিন্তা করে যাবে। হ্যাঁ, এটাই বাবা। বাবার চিন্তার ভাগ নেয়ার মতো কেউ থাকে না। বাবাকে একাই তার সব চিন্তার ভার নিয়ে চলতে হয়।
প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বজুড়ে বাবা দিবস উদযাপন করা হয়। সে হিসেবে রোববার (১৬ জুন) বিশ্ব বাবা দিবস। এ বাবা দিবস উদযাপনের পেছনে রয়েছে এক সুমহান ইতিহাস। পৃথিবীর সব বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে এ দিবসটির সূচনা।
ইতিহাস অনুযায়ী, ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জেনিয়ার ফেয়ারমন্ট এলাকার এক গির্জায় প্রথম ‘বাবা দিবস’ পালিত হয়। আবার, সনোরা স্মার্ট ডড নামের ওয়াশিংটনের এক ভদ্রমহিলার মাথাতেও বাবা দিবসের ভাবনা আসে ১৯০৯ সালে। ভার্জিনিয়ার বাবা দিবসের কথা একেবারেই জানতেন না তিনি। ডডের এই ভাবনার জন্ম হয় গির্জার এক পুরোহিতের বক্তব্য থেকে। সেই পুরোহিত মাকে নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলছিলেন। ডড আবার তার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তার কাছে মনে হলো, বাবাদের জন্যও কিছু করা দরকার। সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগেই পরের বছর ১৯১০ সালের ১৯ জুন থেকে বাবা দিবস পালন করা শুরু করেন।
তবে এই দিবস নিয়ে মানুষ মোটেও উৎসাহিত ছিলেন না। বরং তাদের কাছে বিষয়টি ছিল হাস্যকর। ধীরে ধীরে অবস্থা বদলায়। ১৯১৩ সালে আমেরিকান সংসদে বাবা দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করার জন্য একটা বিল উত্থাপন করা হয়। ১৯২৪ সালে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন। এরপর ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন বাবা দিবসকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে বর্তমানে বিশ্বের ৫২টি দেশে বাবা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
বাবাদের পছন্দের কথা জানা মুশকিল। কয়েকটি মাত্র পোশাকে তারা বছরের পর বছর পার করে দেন কোনো অনুশোচনা ছাড়া। নিজের প্রিয় খাবার কী, তা হয়তো ভুলে যান। কিন্তু সন্তানের প্রিয় পোশাক, খাবার কিংবা প্রয়োজন- সবটা থাকে নখদর্পণে। সন্তানের বেড়ে ওঠায় বাবার ভূমিকা অতুলনীয় হলেও তা পড়ে থাকে এক পাশে।
বাবাদেরকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থেই সন্তানকে তার বাবার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। পরম দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পিতার বুকফাটা আর্তনাদ না শোনার মতো সন্তানও এই সমাজে রয়েছে। আমাদের দেশে দেখা যায়— যে বয়সে একজন বাবা তার ছেলে-বৌ, নাতি-নাতনীর সঙ্গে কাটানোর কথা, জীবনের সে সময়টা তাকে কাটাতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।
এ বিষয়ে নচিকেতার জনপ্রিয় একটা গানের বাস্তবতা মনে পড়ে যায়—‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/সবচেয়ে কমদামি ছিলাম একমাত্র আমি/ছেলে আবার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’
বাবারা সব সময় ভালো থাকুক। বাবা দিবসে পৃথিবীর সকল বাবা'কে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়