বাবা, শব্দটার মাঝেই অদ্ভুত এক আবেগ কাজ করে। কথিত আছে, মেয়েরা বরাবরই বাবাকে বেশি ভালোবাসে। জানি না, আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি বাবাকে। কিন্তু এটা সত্যিই যে, বাবার একটা ছোট্ট কথাই চোখে জল নিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট।
ছোটবেলাটা খুব ধরা-বাধা নিয়মের মধ্য দিয়ে পার হয়েছে। জন্মের পর থেকে বাবাকে খুব কমই কাছে পেয়েছি। কারণ বাবা চাকরি শেষে বাড়ি ফিরে কোনো বিশ্রাম না নিয়েই আমাদের ফার্মেসিতে বসতেন। এতো পরিশ্রম করতেন শুধু আমাদের জন্য, যাতে আমরা কোনো কিছুর অভাববোধ না করি। এরপর যখন আস্তে আস্তে একটু বয়স বাড়তে থাকলো, বাবা তখন ফার্মেসিটা বন্ধ করে দিলেন এবং বিকেলের ওই সময়টা আমাকে পড়তে বসাতেন।
আমি মাধ্যমিকের আগে কখনো কোনো প্রাইভেট পড়িনি বা কোচিং করিনি। আসলে করার প্রয়োজনই হয়নি। কারণ বাবা সবটা ম্যানেজ করে দিতেন। যদি কখনো কিছু খেতে ইচ্ছে করতো এবং কোনোভাবে সেটি বাবার কানে যায়, তাহলে বাবা সেদিন এনে না দিতে পারলেও পরদিন ঠিকই আনতেন। বাবা সবসময় যে আদর করতেন তা একদমই নয়; বেশ শাসনও করতেন। আমার অনেকগুলো খারাপ অভ্যাসের একটি হচ্ছে, আমি পড়তে পড়তে পড়ার টেবিলেই ঝিমিয়ে পড়ি বিশেষ করে রাতে। আর বাবা প্রতিদিনই সেটা ধরে ফেলতেন। ফলে আর কি! বকাও শুনতে হতো আমাকে।
বাবার সঙ্গে দেওয়া আড্ডাগুলো এখন বড্ড মিস করি। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠায় সবাই যখন একসঙ্গে হতাম তখন বড় গানের আসর বসতো বাড়িতে। সেখানেই বাবার কন্ঠে প্রথম নজরুল সংগীত শোনা। বাবা খুব আবেগ নিয়ে গান গেতেন বরাবরই। ছোটোবেলা থেকে হয়তো গান শেখার ইচ্ছে ছিলো বাবার কিন্তু টানাপোড়নের সংসারে সেই ইচ্ছে হয়তো চাপা পড়ে গেছে।
তিনি মাঝেমাঝেই তার ছোটবেলার গল্প করতেন। সে সময়ের অভাব-অনটন, আশা-আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি শোনাতো। তখন আরও বেশি উপলব্ধি করতাম, বাবা কত কিছু ত্যাগ করেছে আমাদের জন্য। নিজের কথা একবারও ভাবেননি, এখন আর ভাবেনও না। আমাদের হাজারো চাহিদার কাছে তিনি তার নিজেকে সময় দেওয়াটাই ভুলে যান। তার হাজারো স্বপ্ন চাপা পড়ে যায়। হাজারো কষ্ট চুপ করে সহ্য করে যান।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর প্রথম কল বাবাকেই করেছিলাম এবং সে সময়ের অনুভূতি আমি ভাষায় হয়তো প্রকাশ করতে পারবো না। আসলে আমাদের কোনো সফলতার জন্য বাবা যখন খুশি হন, অন্য সবকিছু তখন তুচ্ছ মনে হয়। এতো শান্তভাবে পরিস্থিতি সামলাতে খুব কম মানুষকেই দেখেছি। কোনো চাওয়া যে মানুষটি কখনো অপূর্ণ রাখেনি, সে মানুষটি হচ্ছেন বাবা।
গত চারদিন থেকে জন্ডিসে আক্রান্ত আমি। মাকে চাকরিতে যেতে হয়। আর বাবা যেহেতু এখন অবসরে গিয়েছেন। তাই আমার দেখভালের দায়িত্ব পুরোপুরি এখন তার কাঁধেই। আমার বাইশ বছর জীবনে বাবাকে এতো কাছে এর আগে কখনো পায়নি। আমার কখন কি লাগবে, স্যালাইন চলাকালে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, ফল কেটে দেওয়া সবকিছুর পাশাপাশি চলে আমাদের ব্যাপক আড্ডা। ফলে সময় কখন পেরিয়ে যায় বুঝতে পারি না।
বাবা আমার কাছে বটগাছের মতো, যার ছায়াতলে থাকার চেষ্টা আমার বরাবরই। বাবা সঙ্গে থাকলেই নিজেকে নিরাপদ মনে হয়। আর এক ধরনের অসম্ভব মানসিক শক্তি পাওয়া যায়। মন খারাপ অথবা কিছু ভালো লাগলে সবার আগে যে মানুষটির কথা মনে পড়ে, তিনি হচ্ছেন বাবা।
সারাজীবন তো শুধু বাবাই করে গেলো। জানি, বাবার এ ঋণ কখনো মেটাতে পারবো না। কিন্তু তাঁর জীবনের কিছু অপূর্ণতা তো মেটানোর চেষ্টা করতেই পারি। ছোটবেলা থেকেই অনেক স্বপ্নের মধ্যে অন্যতম স্বপ্ন হলো নিজের টাকায় বাবার জন্য একটা বেতের চেয়ার ও একটা চাদর কিনবো। এরপর বাবা শীতের সকালে হালকা রোদে সেই চাদর গায়ে জড়িয়ে বেতের চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়বেন আর আমি দূর থেকে সেটি দেখবো।
বাবা দিবসটি আমার কাছে আরও বেশি প্রিয়। কারণ আমি আমার বাবাকে আবারও নতুন করে খুঁজে পেয়েছি। সব অনুভূতি হয়তো লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে বাবা, জেনে রেখো। তোমার মেয়ে একদিন অবশ্যই তোমার মান রাখবে। সারাজীবন এভাবেই পাশে থেকো, অনেক ভালোবাসি তোমায়। বাবা দিবসে পৃথিবীর সব বাবাকে আমার পক্ষ থেকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রইলো।
লেখক: শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়