বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আদর, স্নেহ, ভালোবাসা, আস্থা, ভরসা, বিশ্বস্ততা আর পরম নির্ভরতার নাম বাবা। বাবা এমন একজন, যার হাত ধরে হাঁটতে শেখা, পৃথিবীর কঠিন পথে চলতে শেখা। বাবা মানে যার কাছে কোন আবদারই ফেলনা নয়।
আমার বাবা ছিলেন একজন অক্ষরজ্ঞান শূন্য মানুষ। কিন্তু তার চিন্তা-ভাবনা ছিল সূদুরপ্রসারী। তিনি কোনোকিছু গভীরভাবে না ভেবে সিদ্ধান্ত নিতেন না। অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির ছিলেন। বাবার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটি তুলে ধরছি, যা আজও আমায় কাঁদায়।
সময়টা ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি। বাবা কয়েকদিন ধরে ভীষণ অসুস্থ। পানি ছাড়া তেমন কিছু মুখে নিচ্ছিলেন না। এর তিনমাস আগে হঠাৎ করে স্ট্রোক করে ডান হাত-পা অবশ হয়ে যায়। মধ্যবিত্ত পরিবার হওয়ায় সামর্থ্য অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়েও কোনো ফলাফল পাইনি। সেই অসুস্থতার চরম পর্যায় ছিল ২৩ জানুয়ারির রাতটি।
সন্ধ্যা থেকেই বাবার অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। হাসপাতালে নেওয়ার সিন্ধান্ত নিলে জ্যেষ্ঠরা মুখ গম্ভীর করে ‘না’ জবাব দিলেন। বুঝতে বাকি থাকে না, হয়তো বাবার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা থেকেই বাবাকে ঘিরে কুরআন তেলাওয়াত, তাজবিহ-তাহলিল করা হয়। পাড়ার প্রতিটি মুখেমুখে ছড়িয়ে পড়েছে বাবার কথা। সবাই ছুটে এসেছেন। যারা দেখতে এসেছেন সবাই আড়ালে জল গড়াচ্ছেন। সন্ধ্যা থেকে আমি শিউরে বসে চোখ বন্ধ করে শুধু আল্লাহর কাছে বাবার হায়াত বৃদ্ধির দোয়া করছি।
আমি তো এখনি আমার বাবাকে বিদায় দিতে চাই না। আমি যে তার জন্য এখনো কিছুই করতে পারিনি। অবিরত চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। অনেক চেষ্ট করেও আটকাতে পারছি না। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে কান্না করেন। কিছু বলতে চেয়েও বলেন না। আব্বার অবস্থাটা জানার জন্য একটু পর পর আমি ডাক দেই, আব্বা…আব্বা…।
আব্বা: (ছোট্ট শব্দে) 'অ্যা'।
আমি: এখন ক্যামন লাগছে?
আব্বা: ভালো না, বাজান।
কথার সঙ্গে সঙ্গে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি খুব যত্নে নিজের হাত দিয়ে নিজের চোখের জল আড়াল করে আব্বার জল মুছে দিচ্ছি।
রাত যত গভীর হচ্ছে বাড়ি জুড়ে কান্না ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিৎকার করতে পারছি না। চাপাস্বরে নয়নের জলে মনে পড়ছে কত স্মৃতি। সেদিন ক্যাম্পাসে যাবার সময় বাবা বললেন, ‘কিছু খাবার এনো বাজান।’ ফেরার সময় সেই খাবারগুলো নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেই আব্বা আমার কণ্ঠ শুনে বলে উঠলেন, ‘বাজান এসেছে, আমার বাজান এসেছে।’
অসুস্থতার পর এতো খুশি কোনোদিন হতে দেখিনি তাকে। আরও মনে পড়ল, আব্বাকে কতদিন নিজ হাতে গোসল করিয়েছি। শীতকাল হওয়ায় আব্বা গোসল করতে চাইতেন না। পানি গরম করে গোসল করাতাম। গোসল শেষ করে নিজ হাতে লোশন, তেল লাগিয়ে দিতাম। আমার হাতে ছাড়া অন্য কারো হাতে গোসল করতে চাইতেন না। আব্বা বলতেন, ‘ওরা পাজি, ওরা আমাকে হাতে-পায়ে ব্যথা দেয়। তুমি কতো সুন্দর করে গোসল করাও!’
আরও মনে পড়ে, বাবা হয়ত কখনো কঠোর পরিশ্রমের ফাঁকে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে কতো স্বপ্ন বুনেছিলেন, তার ছোট্ট সন্তান একদিন বড় হবে, বড় চাকরি করবে, আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হবে, সুখে-শান্তিতে দিন কাটবে, আমাদের ছোট্ট টিনচালার পরিবর্তে একটি সান বাঁধানো দোঁচালা উঠবে, দু-একটি ধানের জমি হবে। আবার অসুস্থ হলে বড় ডাক্তার দেখাবে, এরকম আরও কিছু ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন।
চোখ দিয়ে আজ আমার বন্যার স্রোত গড়িয়ে যাচ্ছে। মাথার উপরের ঘড়িটির কাটা টিকটিক করে ছুঁটে চলেছে। প্রচণ্ড শীতে গা ঠান্ডা হয়ে আসছে। বাবার চোখে আজ কি যেন পড়েছে! সব ঘুম বুঝি তার কাছ থেকে চলে গিয়েছে। পৃথিবীর সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, শুধু একটা শয্যাশয়ী মানুষের পাশে চারটি প্রাণ তখনো তাজবি জঁপছে। রাত ২টায় মেজো আন্টি চলে গেলেন।
রাত ৪টায় আব্বার শিউর থেকে ওঠে আব্বাকে বললাম, আব্বা আমি নামায পড়ে আসি। তিনি মাথা নেড়ে জবাব দিলেন। আমি নামাজ পড়লাম; দোয়া করলাম। একটু পর ফজরের সালাতের আযান ভোসে এলো। নতুন সূর্য এলো। বাবা তখনো যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছেন। সহ্য করতে পারছেন না। দিন বাড়তে থাকলে অবস্থা খারাপ থেকে বেশি খারাপ হতে লাগল। আমি শিউরে বসে তখনো আল্লাহকে ডাকছি। আল্লাহ আমার ডাক সেদিন শোনেননি। দুপুর ১২.৪০ মিনিটের দিকে বাবা বিদায় নিলেন। বুক ফেটে যাচ্ছিল। সত্যি সত্যিই বাবা বিদায় নিলেন! আমি কিছুতেই আব্বার বিদায় মেনে নিতে পারছিলাম না, আজও পারিনি..।
আজকের এই বিশ্ব বাব দিবসে শুধু এতটুকু বলতে পারি- আব্বা, অনেক কিছুইতো তোমাকে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, হয়ত পারিনি তার কানা কড়িও। সাধ, সাধ্য, পরিস্থিতি আর বাস্তবতা কোনটাই আমার অনুকূলে ছিল না। প্রতিকূলতার বিপরীতে সাঁতার কাটতে কাটতে আমি যে বড্ড পরিশ্রান্ত।
লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়