কোথাও যেন পড়েছিলাম, ছেলেরা বড় হতে হতে ধীরে ধীরে তার বাবার মতো হয়। বাবা ছেলেবেলায় যেমন ছিলেন, ছেলেরা না চাইলেও তার মতো হয়ে বেড়ে উঠে। এখন আমার বয়স ২৫। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়েছি, কর্মজীবনে প্রবেশের অপেক্ষায় আছি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, যৌবনে বাবা যেমন ছিলেন, আমি যেন অবচেতন মনে তারই মতো হয়ে উঠছি।
আমি যখন খুব ছোট, বাবা তখন এমএ পরীক্ষা দিচ্ছেন। পাশাপাশি ঢাকার একটা কলেজে গ্রন্থাগারিক হিসেবে চাকরি করেন। আজিমপুরে এক রুমের ছোট একটা বাসা সাবলেট নিয়ে আমরা থাকি। খুব ছোট হলেও সে সময়ের স্মৃতি যেন মানসপটে আজও বেশ জীবন্ত। বাবা খুব করে ভালো একটা সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। নিয়মিত চাকরির খবর পত্রিকা রাখতেন বাসায়, খুঁজে খুঁজে আবেদনের চিঠি পাঠাতেন।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়তেন টিউশনে। আর আমি বায়না ধরতাম বাবার সঙ্গে যাওয়ার। মাঝে মাঝে বিরক্ত হতেন, লুকিয়ে বেরিয়ে যেতেন। শেষে নিয়ম হলো বৃহস্পতিবার যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যাবেন। টিউশন শেষে বাবার হাত ধরে চলে যেতাম শিশুপার্ক। আমি বাসে উঠতে চাইতাম না। বাধ্য হয়ে বাবাকে রিকশা নিতে হতো। রিকশায় করে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিগলি ঘুরতাম।
ঘুরতে ঘুরতে বাবা আমাকে চেনাতেন- এই যে এটা হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি, এটা অপরাজেয় বাংলা, এটা তিন নেতার মাজার, আর এই হলো কার্জন হল। ঘুরাঘুরি শেষে আমার জন্য বরাদ্দ থাকতো একটি বার্গার। শাহবাগের আজিজ মার্কেটে বা কাঁটাবনের দিকে ভালো বার্গারের দোকান ছিল। দোকানে বসে আমি বেশ আনন্দ নিয়ে খেতাম, আর বাবা তৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন। সেসময়ের ছাপোষা বাবার কাছে এভাবে বার্গারের বায়না ধরার জন্য আমার এখনো ভীষণ অনুশোচনা হয়।
ততোদিনে বাবার চাকরির সুবাদে আমরা চলে এসেছি নারায়ণগঞ্জ। আমাকে এখানেই একটা স্কুলে ভর্তি করানো হলো। তবে বৃহস্পতিবারের নিয়ম চললো আগের মতোই। বিকেলে বাবার নিয়মমাফিক টিউশন শেষে আমরা ঢাকা শহরে রিকশায় ঘুরে বেড়াতাম। সেসময় ছোট্ট আমার মনে যে জানার, আগ্রহের আর দেখার চোখ খুলে দিয়েছিলেন তিনি, সেটাই বোধহয় আমাকে এতদূর এগিয়ে দিয়েছে।
বাবার আর্থিক সঙ্গতি খুব বেশি ভালো ছিল না। শিক্ষকতা পেশায় আর কতটুকুই বা সৌখিন হওয়া যায়। তবুও আমাদের সুন্দরভাবে মানুষ করতে কোনোদিন বাবার চেষ্টার কমতি দেখিনি। চার বছর বয়সে আমার জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছিলেন ‘এক বেদুইনের গল্প’ আর ‘মহান মনীষী ইবনে সিনা’ এ দুটি বই।
বাবা-মা দুজনেই পড়তে ভালোবাসতেন বলে আমি গল্প দেখে দেখে পড়তে শিখে গিয়েছিলাম খুব দ্রুত। সামনে যা পাই, মনোযোগ দিয়ে পড়তে বসে যাই। বাসায় তখন নিয়মিত পত্রিকা রাখা হতো, দিনশেষে বাবার লাইব্রেরির পত্রিকার কড়চাগুলো জমা থাকতো আমার জন্য। আর ঈদের সময় সুন্দর মলাটের ঈদ সংখ্যা তো ছিলই। শিশু সাহিত্যের সুন্দর সব রচনাগুলোই বাবা আমাকে পড়িয়েছেন নিজের পরিকল্পনা মতো। এই পড়ার অভ্যাস আমার অদ্যবধি আছে।
বছর শেষে আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। বাবা চাইতেন গ্রামের সঙ্গে আমাদের সংযোগটা নিবিড়ভাবে থাকুক। আমরা হাঁটতে বেরিয়ে পড়তাম গ্রামের এমাথা থেকে ওমাথা। হাঁটতে হাঁটতে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে, গ্রামের প্রতিবেশিদের সঙ্গে। গ্রামের কেউ মারা গেলে বা বিয়ে-অনুষ্ঠানাদি থাকলে আমরা সবসময়ই যোগ দেওয়ার চেষ্টা করতাম। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারার গুণ আমি বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি।
মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে আমি চলে আসলাম ঢাকায়, হোস্টেলে। শত ব্যস্ততার মাঝেও নিয়মিত বিরতিতে বাবা দেখা করতে আসতেন। বাবার ছাত্রজীবনে লজিং থাকার গল্পগুলো এসময় আমার চোখের সামনে ভাসতো। এরপর কলেজ পেরিয়ে কখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েছি। নানা সংগঠনে যুক্ত হয়েছি, সাংবাদিকতা শিখেছি। প্রতিটি কাজের মাঝেই আমি বাবার জীবনের প্রভাব অনুভব করতে পারি। বাবা চাইতেন এমনভাবে বেড়ে উঠি, যেন নিজের চিন্তা আর কাজের পরিধি সবাইকে ছাপিয়ে যায়। গল্প আর ভ্রমণের ছলে চিন্তার দশ দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন তিনি। ঠিক বাবা যেমন চাইতেন, সেভাবেই চলছি আজও।
লেখক: শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়