অভিধানের হাজার হাজার শব্দের মাঝে বাবা শব্দটি আমার কাছে ভিষণ প্রিয় এক শব্দ। আমার কল্পনায় বাবা শব্দটি অন্যরকম এক দ্যোতনা সৃষ্টি করে। ছোটবেলা থেকেই বাবার স্নেহ-মমতা আর কড়া শাসনের জালে বন্দি ছিলাম। তার শাসনগুলো যদিও মন খারাপের কারণ হতো। কিন্তু এর মাধ্যমে সর্বদাই তিনি যে বার্তাটি দিতে চাইতেন সেটি হলো, ‘চাইলেই মহাপুরুষ হওয়া সম্ভব। তবে এজন্যে অলসতা ঝেড়ে ফেলে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তবেই সাফল্যের শিখরে পৌঁছানো সম্ভব। আর নৈতিকতা হবে তোমার প্রধান অস্ত্র।’
তাই বলে আমাকে মহাপুরুষ বানাতে গিয়ে তিনি মোটেও হুমায়ুন আহমেদের হিমু চরিত্রের বাবার মত অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করেননি। তার প্রচেষ্টাগুলো ছিল খুবই সাদামাটা, কিন্তু প্রচণ্ড রকমের অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন। তার আদরও ছিল একদম দিলখোলা।
ছোটবেলায় বাবা রাতে ফিরতে ফিরতে আমরা ঘুমিয়ে যেতাম। ঘুম থেকে উঠে প্রত্যেকদিনই মশারির উপরে বিস্কুট-চানাচুরসহ মজার মজার খাবার পেতাম। এভাবেই আমাদের খেয়াল রাখতেন বাবা।
আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি বড় ছেলে হিসেবে বাবা সবসময় নিজের স্ত্রী-সন্তানদের পাশাপাশি তার ছোট ভাই-বোনদেরও আগলে রেখেছিলেন। ছোট বোনের সন্তানদেরও বাড়িতে রেখে সমান আদর-যত্ন দিয়ে লালনপালন করেছেন। কখনো কারো মনে এতটুকু আঁচ লাগতে দেননি। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় অল্প বয়সেই সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল তাকে। সেজন্য ইচ্ছা থাকার পরেও খুব বেশি পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি তার। নিজের এ স্বপ্নবীজকে আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে বুনে দিতে দিনের পর দিন সংগ্রাম করে গেছেন তিনি।
বাবার সঙ্গে হাজারো স্মৃতির ভিড়ে আমার প্রথম সাইকেল কেনার স্মৃতিটি আজও মনকে নাড়া দেয়। প্রাইমারি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় মেধাতালিকায় উপজেলার মধ্যে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে সবে ষষ্ঠ শ্রেণিতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। বাড়ি থেকে বেশ দূরেই আমার নতুন স্কুল। নিয়মিত ক্লাস করার জন্য আমার একটা সাইকেল প্রয়োজন। বাবাকে বলবো বলবো করে বলা হচ্ছিল না। সেদিন সাপ্তাহিক হাটবার ছিল। ঠিক করলাম, আজ বাবাকে সাইকেলের কথাটি স্মরণ করিয়ে দেব। কিন্তু রাতে বাবার ফিরতে দেরি হচ্ছিল।
সারাদিন খেলাধুলার পরে ক্লান্ত অবসন্ন আমি রাতের ভাত খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানিনা, হঠাৎ কানের কাছে সাইকেলের ক্রিংক্রিং শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমার। ঘুমের ঘোরে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চোখ কচলে প্রথমে বাবার হাসি মুখের দিকে চোখ গেল। তাকিয়ে দেখি বাবা টুকটুকে লাল রঙের একটি সাইকেল কিনে এনে আমার বিছানার কাছে নিয়ে এসেছেন। বললেন, ‘সাইকেলটা তোর সঙ্গে ভালোই মানাবে। রোজ সাইকেলে করে স্কুলে যাবি, আর সাইকেলের যত্ন নিবি ঠিকঠাক। যন্ত্র হলেও এদেরও আদর-যত্ন করতে হয়, বুঝলি?’
আমি তখন আনন্দে আপ্লুত। সাইকেলটা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলাম। সেদিন রাতে সাইকেল নিয়ে মজার মজার স্বপ্ন দেখেছি। যেমন- পঙ্খিরাজ ঘোড়ার মত দুটি ডানা গঁজিয়েছে আমার সাইকেলে। সাইকেলের ক্যারিয়ারে ছোট ভাইকে নিয়ে আমি আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছি এ রকম। পরদিন স্বপ্নের আলোকে সাইকেলের নাম রাখি লাল পঙ্খিরাজ। আমার হাইস্কুল জীবনটি রঙিন হওয়ার পিছনে বাবার দেওয়া সাইকেলটির ভূমিকা আমি কখনই ভুলতে পারবো না।
আমার কাছে বাবা একজন শ্রেষ্ঠ পথ প্রদর্শক। যখনই জীবনের জটিল চক্রে নিজেকে হারিয়ে ফেলার উপক্রম ঘটে, তখনই আলোর দিশা হিসেবে পিঠে বাবার শক্ত হাতের ছোঁয়া আমাকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা যোগায়। কোনো দিবসে নয়, যতদিন বেঁচে আছি বাবার প্রতি সীমাহীন শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিয়েই বাঁচতে চাই।
লেখক: শিক্ষার্থী, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়