রাইজিংবিডি স্পেশাল

দৃষ্টি কাড়ছে চরফ্যাশন, পথে পথে সৌন্দর্যের মেলা

দেড় যুগ আগেও যে চরফ্যাশন উপজেলা ছিল দুর্বল অর্থনীতির অবহেলিত এলাকা, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে সেই চরফ্যাশন এখন উন্নয়নে সমৃদ্ধ এক জনপদ। এখন এর পথে পথে উঁকি দিচ্ছে সৌন্দর্যের মেলা। পুরো চরফ্যাশনই যেন পর্যটনের ক্ষেত্রে এক অপার সম্ভাবনার নাম।

ভোলার চরফ্যাশন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠেছে ‘জ্যাকব টাওয়ার’, ‘চরফ্যাশন কেন্দ্রীয় খাসমহল জামে মসজিদ’, ‘বেতুয়া লঞ্চ ঘাট’ প্রভৃতি। এসব জায়গা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে চিত্তবিনোদনের উৎস হয়ে উঠছে। 

ভোলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) আরিফুজ্জামান রাইজিংবিডিকে বলেছেন, ভোলা জেলা চারপাশে ১৯০ কিলোমিটার নদী দ্বারা বেষ্টিত। এই জেলার বিশেষত্ব অন্য জেলা থেকে স্বাতন্ত্র এনে দিয়েছে। নদীবেষ্টিত দ্বীপ জেলা হওয়ায় এর পরতে পরতে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পর্যটন স্পট হওয়ার জন্য যেসব বৈশিষ্ট দরকার, তার সবগুলো ভোলার বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটক এখানে আসছেন।

উপমহাদেশের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার জ্যাকব টাওয়ার উপমহাদেশের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার। এটি দেখতে অনেকটা কানাডার সিএন টাওয়ারের মতো। ভোলা জেলা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে এই টাওয়ারের অবস্থান। এই টাওয়ার থেকে পুরো ভোলার সৌন্দর্য বেশ ভালোভাবে উপভোগ করা যায়। ২২৫ ফুট উচ্চতার এই ‘ওয়াচ টাওয়ার’ তৈরিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। টাওয়ারটির নকশা করেছেন স্থপতি কামরুজ্জামান লিটন। মাটির ৭৫ ফুট নিচ থেকে ঢালাই-পাইলিং ফাউন্ডেশনের ওপর সম্পূর্ণ ইস্পাত দ্বারা নির্মিত এই টাওয়ার ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী থাকাকালে ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব তার উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় চরফ্যাশন পৌরসভায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন।

জ্যাকব টাওয়ারের চূড়া থেকে ভোলা দেখতে পরিবার নিয়ে ছুটে এসেছেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা জয়নাল মাসুদ। তিনি বলেন, আমি এর আগে নিজে এই টাওয়ারে উঠে ভোলার সৌন্দর্য দেখেছি। এবার পরিবার নিয়ে এলাম। আসলে এই টাওয়ারে ওঠা থেকে চূড়ায় পৌঁছানো পর্যন্ত এক অন্যরকম অ্যাডভেঞ্চার মনে হয়। এটা আজকে আমার পরিবার উপভোগ করতে পারবে।  

দৃষ্টিনন্দন এই টাওয়ার আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে একটি ভিন্ন পরিচিতি এনে দিয়েছে। ১৯ তলা বিশিষ্ট টাওয়ারটি ৮ মাত্রার ভূমিকম্পসহনীয়। চূড়ায় ওঠার জন্য সিঁড়ির সঙ্গে রয়েছে ১৩ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক ক্যাপসুল লিফট। ওয়াচ টাওয়ারটিতে স্থাপন করা হয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাইনোকুলার। এছাড়া, বিশ্রামাগার, প্রাথমিক চিকিৎসাসহ খাবারের আয়োজনও রয়েছে এখানে।

আকর্ষণ বাড়াতে জ্যাকব টাওয়ার পাশেই ২০ কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছে বৃহত্তম সুইমিংপুল। আছে ২০ হাজার জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ফ্যাশন স্কয়ার ও অত্যাধুনিক মানসম্পন্ন শেখ রাসেল শিশু ও বিনোদন পার্ক। পার্কের ভিতরে রয়েছে চারদিকে শানবাঁধানো পুকুর। ভ্রমনপিপাসুদের ভিড় লেগে যায় এখানে। 

বেতুয়া প্রশান্তি পার্ক সৌন্দর্যের এক উপাখ্যান মেঘনা নদীর পারে বেতুয়া প্রশান্তি পার্কও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য নদীর একেবারে ভেতরের দিকে রেলিং করে দেওয়া আছে। সিঁড়ি নামিয়ে দেওয়া হয়েছে নদীর ভেতরে, যাতে ভ্রমনপিপাসুরা বসে বসে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। জোয়ারের সময় এলাকাটি তলিয়ে যায়। ভাটার সময়ে আবার পানি নেমে যায়।

স্থানীয় মুনির হোসেন বলেন, এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। প্রায়ই এখানে আসি। জায়গাটি মনজুড়ানো। আসলেই মন ভালো হয়ে যায়। শুক্রবার এখানে ভিড় লেগে যায়। 

চরফ্যাশনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সালেক মূহিদ রাইজিংবিডিকে বলেন, এলাকাটি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আসলে প্রকৃতিগত কারণে চরফ্যাশনের বিভিন্ন স্থান পর্যটকদের কাছে ঘোরার মতো জায়গা হয়ে উঠছে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই উপজেলাকে পর্যটকদের কাছে আরো বেশি জনপ্রিয় করা সম্ভব।

দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন খাসমহল জামে মসজিদ শহরের প্রাণকেন্দ্রে জ্যাকব টাওয়ারের পাশেই আছে পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে গড়া খাসমহল জামে মসজিদ। মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোক্তা ও স্বপ্নদ্রষ্টা সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। এই মসজিদে একসঙ্গে ৪ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। আলাদা প্রবেশপথসহ ৫০০ নারীর নামাজ আদায়ের ব্যবস্থাও আছে এতে। মুসল্লিদের জন্য আছে প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা। পাঁচ বছর ধরে মসজিদটির নির্মাণকাজ চলেছে। খরচ হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা।

মসজিদের স্থাপত্যশৈলীতে আছে নানা বৈচিত্র্য। পরিবেশ সুরক্ষা বিবেচনায় উপকূলীয় এলাকায় সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে নির্মিত হয়েছে মসজিদটি। মসজিদের দেয়ালে সিরামিক ইটের গাঁথুনির ফাঁকে ফাঁকে ঢুকছে প্রকৃতির নির্মল বাতাস। ওপরে মাকড়সা আকৃতির কাঁচের গম্বুজ ভেদ করে সূর্যের আলোকরশ্মি ছড়াচ্ছে মসজিদজুড়ে। ভেতর-বাহিরে নান্দনিক এলইডি লাইটিং আর প্রকৃতিবান্ধব নির্মাণশৈলীর এই মসজিদ ধর্মপ্রাণ মানুষকে আকৃষ্ট করে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব রাইজিংবিডিকে বলেন, পর্যটকদের উন্নত সেবা দিতে এখানে আরো বড় বড় স্থাপনা হবে। একজন পর্যটক লঞ্চ থেকে নামার পর এখানে থাকা, খাওয়া, ঘোরা থেকে যাওয়া পর্যন্ত যে অর্থ তারা ব্যয় করে, সেই অর্থ কিন্তু এখানের গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে। আজ চরফ্যাশন অন্যতম উন্নত বাণিজ্যিক শহর। চরফ্যাশনকে প্রমোট করা হলে, আরো পরিকল্পনা করে এগিয়ে নিলে, ভবিষ্যতে সবদিক দিয়ে চরফ্যাশনের এই পর্যটন শিল্প বিকাশ লাভ করবে।