১৯ মে মধ্যরাত থেকে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে বেকার হয়ে পড়েছে বরগুনা উপকূলের লক্ষাধিক জেলে। জেলেরা বলছেন, উপার্জন বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটছে তাদের। সরকার চাল সহায়তা দিলেও সেই চাল নিয়ে নয়-ছয় করছেন জনপ্রতিনিধিরা।
দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের লক্ষ্যে ১৯ মে মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। সাগর দাপিয়ে বেড়ানো জেলেরা এখন বেকার সময় পার করছেন।
বুধবার (১৯ জুন) পাথরঘাটার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, শত-শত ট্রলার নোঙর করে আছে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাট ও মাছের খাল এলাকায়। এফ বি রিজভী ট্রলারের মাঝির সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। ট্রলারের মাঝি জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমিসহ ট্রলারের ১৮ জেলে একমাস ধরে বেকার। সাগরে এমনিতেই মাছ কম, তার উপরে আবার নিষেধাজ্ঞা আমাদের অসহায় অবস্থায় রেখেছে। বছরের শুরুতে ট্রলার মালিকের থেকে দাদন নিয়েছি। ট্রলার মালিকও লোকসানে। তার মধ্যে ইলিশের ভরা মৌসুমে নিষেধাজ্ঞায় আমরা পথে বসেছি। দুই ছেলে ও এক মেয়ের লেখাপড়ার খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই আমার।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্ত্রী ও সন্তানদের দুই বেলা খাবার দেওয়ার সামর্থ্যও আমার নেই। আমরা দিন আনি দিন খাই। এতদিন মাছ ধরা বন্ধ থাকায় আয় রোজগার বন্ধ।’
এফ বি শ্রেয়া ট্রলারের জেলে বিনয় শীল বলেন, ‘সরকারের নিষেধাজ্ঞা মেনে আমরা পরিবার নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছি। প্রকৃত জেলে হয়েও কোনো সহায়তা পাইনি। সহায়তা পাচ্ছে অন্যান্য শ্রেণিপেশার মানুষ।’
পাথরঘাটা লঞ্চঘাটে জাল বুনছিলেন এফবি আল-আমিন ট্রলারের জেলে তরিকুল, মিরাজ, রাসেল, সানাউল্লাহসহ ১৭ জেলে। এসব জেলেরা বলেন, সরকার সহায়তা দিলেও চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা সহায়তা নিয়ে করছেন স্বজনপ্রীতি। সহায়তা বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত জেলেরা।
৩৭ বছর ধরে সাগরে মাছ শিকার করেন বরগুনা সদরের ৭নং ঢলুয়া ইউনিয়নের মোল্লার হোরা এলাকার জাকির হোসেন (৫০)। তিনি পাথরঘাটার আবুল হোসেনের মালিকানাধীন এফবি ফরাজী-২ ট্রলারের মাঝি। জাকির হোসেন রাইজিংবিডি-কে বলেন, ‘জীবন-যৌবন গভীর সাগরে মাছ শিকার করে কাটিয়েছি। জেলে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছি ৬ বছর আগে। এক প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলাম, তিনি হেরে গেছেন। চেয়ারম্যান হয়েছে আজিজুল হক স্বপন। তাকে ভোট দেইনি, তাই আমাকে জেলেদের জন্য বরাদ্দের চাল দেয় না।’
একই অভিযোগ করেন মাছেরখাল এলাকার অসংখ্য জেলেরা। জেলেরা অভিযোগ করে বলেন, ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানদের টাকা দিতে হয় সরকারি বরাদ্দের বিনামূল্যের চাল পেতে। টাকা দিলে চাল পাওয়া যায়, টাকা না দিলে আর চাল পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে ঢলুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজুল হক স্বপন বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। যখন চাল বিতরণ করা হয়েছে, তখন জেলে জাকির হোসেন অনুপস্থিত ছিলেন। আমি খোঁজ নিয়েছি, তিনি তখন পাথরঘাটায়। আরও যে কয়জন জেলে অনুপস্থিত ছিলেন, তাদের চাল পরিষদে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তারা আসলে চাল বিতরণ করে দেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধূরী রাইজিংবিডি-কে বলেন, জেলেদের সংখ্যা বেড়েছে। তাই সহায়তার পরিমাণও বাড়াতে হবে। ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় জেলেরা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন রাইজিংবিডি-কে বলেন, জেলেদের সহায়তার বিষয়ে নজরদারি করছে মৎস্য অধিদপ্তর। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জেলে অভিযোগ করলেও বিগত দিনের থেকে চাল বিতরণে মৎস্য অধিদপ্তর ও প্রশাসনের তৎপরতায় অভিযোগের সংখ্যা খুবই কম।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা সফল করতে তৎপর রয়েছে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর। পাশাপাশি আমরা চাল সহায়তার বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা চাল বিতরণের সময় খোঁজ-খবর রাখছেন। তারপরও কোনো লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাদের বিরুদ্ধে।’
নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে নিবন্ধিত ২৭ হাজার ২৫০ জন জেলের জন্য ২ কিস্তিতে ৮৬ কেজি করে চাল সহায়তা করবে সরকার। ইতিমধ্যে প্রথম কিস্তির ৪০ কেজি চাল বিতরণ করা হয়েছে। যদিও উপকূলীয় এ জেলায় জেলে সংখ্যা প্রায় এক লাখ।