চালচলন এবং আচরণ দশজনের মতো। স্বাভাবিক মানুষের মতো তাদের চলাফেরা। তারা ভিনদেশিও নন। তবে তাদের ভাষা স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে ভিন্ন। তারা কথা বলেন ইশারায়। কারণ তারা জন্মগতভাবে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী।
প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা পাঁচ জনের গল্প কিছুটা ব্যতিক্রম। তারা একে অপরের বন্ধু। একেকজনের বাড়ি একেক জায়গায় হলেও বন্ধন বেশ পোক্ত। কোথাও বেড়াতে কিংবা ঘুরতে গেলে একত্রিত হন তারা। তাদের ভাষা অন্যরা তেমন না বুঝলেও নিজেরা ঠিকই বোঝেন। ছোটখাটো বিষয়ে ঝগড়াতেও জড়ান তারা, হয় মান-অভিমানও। তাদের এই বন্ধুত্ব উপভোগ করেন স্থানীয়রাও।
বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী এই পাঁচ বন্ধুর নাম, এনামুল, সাজু, ফিরোজ, রায়হান ও ফারদিন হাসান শাকিল। তারা সমবয়সী। এনামুলের বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের ভোলা পাড়া গ্রামে। একই ইউনিয়নের দলুয়াপাড়ায় বাড়ি সাজুর। ফিরোজের বাড়িও এই ইউনিয়নের প্রধানপাড়ায়। রায়হানের বাড়ি জেলা শহরের কামাত পাড়ায় এবং শাকিলের কায়েতপাড়ায়।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সবাই স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন। রয়েছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমো অ্যাকাউন্ট। তাদের যোগাযোগের মাধ্যম এগুলো। ভিডিও কলে কথা হয় তাদের। তারা বিশেষ দিনগুলোতে সবাই একত্রিত হন। মাঝে মধ্যে তাদের টিমে যোগ হয় একই সমস্যার আরও দু-একজন।
শুক্রবার (২২ জুন) রাতে প্রতিবেদকের সঙ্গে সাক্ষাত হয় তাদের টিমের চার জনের। এ দিন অনুপস্থিত ছিলেন ফিরোজ। ইশারায় তারা জানালেন, অভিমান করে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন ফিরোজ। ম্যাসেঞ্জারে একটিভ থাকলেও তাদের সঙ্গে কথা হয় না ঈদের দিন থেকে। অভিমানের কারণ হিসেবে জানা গেল, ঈদের দিন ফিরোজকে রেখেই বাকিরা ঘুরতে বের হন। দেখা করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গেও। ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেন, সেসব ছবি দেখে মনক্ষুন্ন হন তিনি।
তবে এনামুল ও সাজুর দাবি, সেদিন তাকে ভিডিও কলে পাওয়া যায়নি। এই অভিমান বেশিদিন থাকবে না বলেও জানান তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা সবাই সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা পান। এছাড়া সবাই কাজ করে উপার্জন করেন। দিনভর কাজ করে তারা একত্র হন সন্ধ্যার পর। প্রতিদিন সবাই একত্রে হতে না পারলেও একই ইউনিয়নের পাশাপাশি গ্রামে বাড়ি হওয়ায় এনামুল, সাজু এবং ফিরোজকে একসঙ্গে দেখা যায় প্রায় প্রতিদিনই। তালমা নামক বাজারে তাদের আড্ডা চলে মধ্যরাত অবধি।
তালমা বাজারের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘তাদের চালচলন সবাইকে আনন্দ দেয়। মানুষের সঙ্গে খুব সহজে মিশতে পারে তারা। অপরিচিত কেউ তাদের দেখলে মনযোগসহকারে তাদের কাণ্ড উপভোগ করেন। তাদের কথা বুঝার চেষ্টা করেন। আমরাও তাদের সঙ্গে মজা করি।’
হাফিজাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মাহাতাব প্রধান মারিফ বলেন, ‘আমার সঙ্গে তাদের দারুণ সম্পর্ক। মাঝে মধ্যে আমার বাড়িতে এসেও আনন্দ উল্লাস করে। ছোটখাট আবদার করে। তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হলে আমার কাছে অভিযোগ দেয়। বুঝিয়ে বললে সহজেই বুঝে যায়। এরা উপহার পেলে ভীষণ খুশি হয়।’
সংরক্ষিত মহিলা সদস্য রুমানা খানম বলেন, ‘এনামুল, সাজু, ফিরোজ- এ তিনজন আমার ওয়ার্ডের। তাদের দেখে কেউ প্রতিবন্ধী বলবে না। বেশ পরিপাটি হয়ে চলে। দেখতেও সুদর্শন। বর্তমান তারা প্রতিবন্ধী হিসেবে সরকারি ভাতা পায়। এছাড়া তাদের ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়।’