পাতালে পানির অভাব। বৃষ্টিও কম। রুক্ষ বরেন্দ্র অঞ্চলে চাষাবাদে সেচ সংকট প্রকট। কৃষিবিদ আর কৃষকেরা খুঁজছিলেন এমন কোনো ফসল যা চাষে সেচের প্রয়োজন কম। খুঁজতে খুঁজতে তাঁরা চলে গেলেন বিদেশ বিভুঁইয়ে। এখন বরেন্দ্রের পোড়ামাটিতে ড্রাগন, স্ট্রবেরি, কমলা আর মাল্টার মতো বিদেশি ফলের সমাহার। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই ফল যাচ্ছে সারাদেশে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের কিছু কিছু এলাকা ‘হাই বারিন্ড’ অর্থাৎ উঁচু বরেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিত। প্রচণ্ড খরাপ্রবণ এই এলাকায় চাষিরা বছরে একবার শুধু বৃষ্টির পানিতে আমন ধানের চাষ করতেন। এসব এলাকায় শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্পের আওতায় কম সেচ লাগে এমন ফল ও ফসলের চাষাবাদ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। দিন দিন বিদেশি এই ফল চাষ বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৫ বছর ধরে বরেন্দ্র অঞ্চলে স্ট্রবেরি, ১০ বছর ধরে ড্রাগন এবং ৫ বছর ধরে মাল্টা ও কমলা চাষ হচ্ছে। রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২০২১-২২ মৌসুমে ড্রাগন চাষ হয়েছিল ১৬১ হেক্টর জমিতে। হেক্টরপ্রতি গড়ে ১০ দশমিক ৪৫ মেট্রিক টন হিসাবে উৎপাদন হয়েছিল ১ হাজার ৬৮৪ মেট্রিক টন ড্রাগন। চলতি ২০২৩-২৪ মৌসুমে ড্রাগন চাষের জমি বেড়ে ৪৪৮ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। হেক্টরপ্রতি গড়ে ১৫ দশমিক ৪২ টন ফলন ধরে এবার চার জেলায় ড্রাগন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৯০৮ মেট্রিক টন।
এই চার জেলায় ২০২১-২২ মৌসুমে স্ট্রবেরি চাষ হয়েছিল ৪৩ হেক্টর জমিতে। হেক্টরপ্রতি ৭ দশমিক ৪১ মেট্রিক টন হিসাবে উৎপাদন হয়েছিল ৩২০ মেট্রিক টন স্ট্রবেরি। এবার জমির পরিমাণ বেড়ে ১০১ হেক্টর হয়েছে। ১০ দশমিক ১২ মেট্রিক টন হিসাবে ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৩ মেট্রিক টন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার একটি ড্রাগন বাগান
২০২১-২২ মৌসুমে বরেন্দ্রের চার জেলায় মাল্টা চাষ হয়েছিল ৬৫৩ হেক্টর জমিতে। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন হয়েছিল ৭ দশমিক ৬০ মেট্রিক টন। মোট উৎপাদন ছিল ৪ হাজার ৯৬৭ মেট্রিক টন। এক মৌসুম পরই এবার মাল্টা বাগান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯৯ হেক্টর। এবার ৮ দশমিক ৯০ টন গড় ফলন ধরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭ হাজার ১০৮ মেট্রিক টন।
প্রতিবছর কমলার উৎপাদনও বাড়ছে বরেন্দ্রের চার জেলায়। ২০২১-২২ মৌসুমে চার জেলায় ৪৪ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ১৩৫ মেট্রিক টন কমলা। হেক্টর প্রতি গড় ফলন ছিল ৩ দশমিক ০৯ মেট্রিক টন। এবার ২০২৩-২৪ মৌসুমে গড় ফলনের লক্ষ্যামাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৯৭ মেট্রিক টন। এবার ৬৬ হেক্টর জমিতে কমলা বাগান আছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫২৬ মেট্রিক টন। এর পাশাপাশি আরও কিছু বিদেশি ফল অল্প পরিসরে চাষ হচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত অনেক তরুণ চাকরির পেছনে না ছুটে এসব ফল চাষ করছেন।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন প্রচুর ফল উৎপাদন হচ্ছে। বিদেশি ফল ড্রাগন, মাল্টা, কমলা ও স্ট্রবেরি ছাড়াও আম বাগান বাড়ছে। পেয়ারা, বরইসহ আরও বেশকিছু ফল প্রচুর উৎপাদন হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে আর কোন কোন ফল চাষে সফলতা পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে।’
কৃষকেরা জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে বাগান থেকে মাল্টা ও কমলা উঠছে। সবুজ মাল্টা বাজারে ৭০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। কমলা বিক্রি হয় একটু বেশি দামে। স্ট্রবেরি ওঠে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে। কেজিতে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত দাম পাওয়া যায় স্ট্রবেরির। ড্রাগন ওঠে জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে। কৃষক ২৫০ টাকা পর্যন্ত দাম পান প্রতিকেজি ড্রাগনের। গ্রীষ্মকাল ছাড়াও কৃত্রিম উপায়ে শীতকালেও ড্রাগনের ফল আনেন অনেক কৃষক। এজন্য পুরো বাগানে রাতে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে রাখতে হয়। অসময়ের এ ড্রাগনের দাম পাওয়া যায় বেশি। তবে শীতে ফল আনলে গ্রীষ্মে ফলন কিছুটা কমে।
ড্রাগন বাগান
রাজশাহী নগরীর মহিষবাথান এলাকার বাসিন্দা মনিরুজ্জামান মনির পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পেছনে ছোটেননি। জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে জমি ইজারা নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিতে নানা ফল-ফসলের চাষ করছেন তিনি। ২০০৮ সালের দিকে তার হাত ধরেই দেশে স্ট্রবেরি চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশে স্ট্রবেরি চাষের উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. এম মনজুর হোসেনের তত্ত্বাবধানে মনিরুজ্জামানই প্রথম সফলভাবে স্ট্রবেরি চাষ করে ঢাকায় নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক মনিরুজ্জামানের ১৯ বিঘা জমিতে রয়েছে এখন ড্রাগনের বাগান। মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে বিদেশি ফলের চাষ বাড়ছে, এটা ভালো খবর। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে, কৃষিবিভাগকে বাদ দিয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে বাইরে থেকে চারা আনা হচ্ছে। কেউ আবার পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ছাড়াই ইউটিউব দেখে চাষাবাদে নেমে পড়ছেন। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষি বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী চাষ করলে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে।’
নওগাঁর বিভিন্ন এলাকায় এখন শুধু আমের পাশাপাশি বিভিন্ন ফলের বাগান রয়েছে। জেলার পোরশা উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের সৌখিন চাষি ওবায়দুল্লাহ শাহ ৫৫ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন মাল্টা, আম ও পেয়ারা বাগান। এর মধ্যে প্রায় ১৮ বিঘা জমিতেই আছে মাল্টা বাগান। ওবায়দুল্লাহ শাহ জানান, বাগান করে তিনি আর্থিক স্বচ্ছলতা পেয়েছেন। তাকে দেখে এলাকার অনেকেই এখন মিশ্র ফলের বাগান করছেন। তিনিও সবাইকে নানা পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক মাহমুদুল ফারুক বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে যে ফল উৎপাদন হচ্ছে তা এই অঞ্চলের মানুষ অল্প টাকায় কিনতে পারছেন। সতেজ ফলে তারা পুষ্টির চাহিদা মেটাচ্ছেন। পাশাপাশি যারা চাষ করছেন, তারাও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এখানকার ফল স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের নানাপ্রান্তে চলে যাচ্ছে।’
উৎপাদিত ফলের বাজারমূল্য হিসাব করা হয়নি জানিয়ে মাহমুদুল ফারুক বলেন, ‘একেক সময় দামটা একেক রকম থাকে। তাই বাজারমূল্য বলা কঠিন। আমরা এটুকু বলতে পারি, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির খুব সংকট। সে জায়গায় বিকল্প আবাদ হিসেবে ফলবাগান করা স্বস্তির। এটা লাভজনক। তাই ফলবাগান আরও সম্প্রসারণের চেষ্টা চলছে।’