বগুড়ার পাপ্পু খন্দকার ও সাঈদ খন্দকার নামের দুই ভাই স্বপ্ন দেখেছিলেন লিবিয়ায় গিয়ে ভালো বেতনে চাকরি করার। এজন্য দালালদের ১১ লাখ টাকা দিয়েছিলেন তারা। দালালরা তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, লিবিয়ায় হাসপাতালে ভালো বেতনের চাকরি দেবেন। এরপর একে একে দুই ভাইকে লিবিয়ায় পাঠায় তারা। তবে, দুই ভাইয়ের ভাগ্যে চাকরি জোটেনি। উল্টো অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা। বাংলাদেশি মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের সদস্যরা নির্যাতন চালায় বলে জানিয়েছেন দেশে ফেরা সাঈদ খন্দকার।
গত ৮ জুন মুক্তিপণ আদায় চক্রের বগুড়ায় অবস্থানরত দুই জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর লিবিয়া থেকে অপহরণের শিকার সাঈদ খন্দকারকে মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
অপহৃত পাপ্পু খন্দকারের জন্য গতকাল সোমবার (১ জুলাই) মুক্তিপণ নিতে এসে চক্রের আরো দুই সদস্য গ্রেপ্তার হন। এরপর পাপ্পু খন্দকারকেও অপহরণকারী চক্রের কবল থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) স্নিগ্ধ আখতার।
গতকাল সোমবার গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার শিহিপুর গ্রামের আয়েন উদ্দিন প্রামানিকের ছেলে পান্নু মিয়া (৩৫) এবং একই উপজেলার নওদাবগা গ্রামের মৃত আব্দুস সাত্তারের ছেলে শিপলু সরকার (৪০)। গ্রেপ্তার হওয়া পান্নুর ভাই লিবিয়া প্রবাসী পায়েল অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় চক্রের সক্রিয় সদস্য। গত ৮ জুন গ্রেপ্তার হন- বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার উজ্জল হোসেন (৩৫) ও জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলা সাফাত মণ্ডল (৩২)।
অপহরণের শিকার পাপ্পু খন্দকার ও সাঈদ খন্দকার কাহালুর কাজীপাড়া গ্রামের আমিনুর রহমানের ছেলে।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্নিগ্ধ আখতার জানান, গত ৮ জুন বগুড়ার দুপচাঁচিয়া থানায় মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধ আইনে মামলা করেন কাহালু উপজেলার বাসিন্দা রাব্বী খন্দকার। তিনি অভিযোগ করেন- তার দুই ভাই পাপ্পু খন্দকার (২৭) ও সাঈদ খন্দকারকে (২৪) ভালো বেতনে লিবিয়ায় চাকরির প্রলোভন দেন উপজেলা সদরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার মোন্তাহা স্টোরের মালিক উজ্জল হোসেন। তার কথা মতো ১১ লাখ টাকা দিয়ে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর পাপ্পু খন্দকারকে এবং চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি সাঈদ খন্দকারকে লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেন। লিবিয়ায় অবস্থানরত উজ্জলের পূর্ব পরিচিত সাব্বির হোসেনের দুই ভাইকে লিবিয়ার হাসপাতালে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা ছিল।
লিবিয়ায় পৌঁছার পর ভাইদের চাকরি না দিয়ে বসিয়ে রাখেন সাব্বির। পরে চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে বলে গত ২৫ মার্চ দুই ভাইকে দেশটির পৃথক দুটি শহরে নিয়ে আটকে রাখেন তিনি। এরপর অপহৃতদের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। মুক্তিপণ না দিলে নির্যাতনের হুমকি দেওয়া হয়।
তিনি আরও জানান, ওই ঘটনায় ৮ জুন মামলা দায়েরের পরপরই ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে উজ্জল হোসেন (৩৫) ও সাফাত মণ্ডলকে (৩২) গ্রেপ্তার করে। এরপর সাঈদ খন্দকারকে উদ্ধার করা হয়। গত ২৩ জুন সাঈদকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ওই চক্রের হাতে আটক অপর ভাইয়ের সন্ধান মিলছিল না। সম্প্রতি অপহরণকারী চক্র পাপ্পু খন্দকারকে মুক্তি দিতে ৪ লাখ টাকা দাবি করে যোগাযোগ করে। এজন্য তারা একটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর দেয়। বাদী ওই নম্বরে এক লাখ টাকা দেওয়ার পর অবশিষ্ট টাকা দিতে চাপ দেয় চক্রটি। তখন পুলিশের পরামর্শে নগদ টাকা দিতে সম্মত হনপাপ্পুর পরিবার।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সেই টাকা নিতে এলে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন সোনাতলা উপজেলার পান্নু ও শিপলু। তাদের মাধ্যমে যোগাযোগ করে অপহৃত পাপ্পুকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। দ্রুতই পাপ্পু খন্দকারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাপ্পুর ভাইয়ের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার পান্নু ও শিপলুকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
অপহরণকারীদের জিম্মি দশা থেকে মুক্ত সাঈদ খন্দকার বলেন, ‘লিবিয়ায় গিয়ে ভালো বেতনে চাকরি করে বাকী জীবন সুখে থাকার ইচ্ছে ছিলো। সেখানে যাওয়ার পর চাকরি তো দূরের কথা, আমাদের ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না। তিন দিন পর খাবার দেওয়া হতো। মারধর করতো। ওরা (অপহরণ চক্র) সবাই বাংলাদেশি। আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি। আমাদের ওপর অনেক নির্যাতন করা হয়েছে।’