আন্তর্জাতিক

ইরানকে কতটুকু বদলাতে পারবেন নতুন প্রেসিডেন্ট

প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংস্কারবাদী নেতা মাসুদ পেজেশকিয়ানকে বেছে নিলো ইরান। দ্বিতীয় দফায় অনুষ্ঠিত ভোটে কট্টরপন্থী সাইদ জালিলিকে হারিয়েছেন তিনি। ইরানের নির্বাচন কর্তৃপক্ষ জানায়, দ্বিতীয় দফায় ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন ৬৯ বছর বয়সী পেজেশকিয়ান। তিনি দেশটির নবম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। ৩০ দিনের মধ্যে ক্ষমতা বুঝে পাবেন তিনি।

ইরানের নির্বাচন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, তিন কোটির বেশি ভোট গণনা হয়েছে। এর মধ্যে মাসুদ পেজেশকিয়ান পেয়েছেন ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি ভোট। আর সাইদ জালিলি পেয়েছেন ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি ভোট।

কয়েক বছর ধরে ইরানে রক্ষণশীল ও অতি রক্ষণশীল শিবিরের আধিপত্যের পর পেজেশকিয়ানের জয় দেশটির সংস্কারপন্থীদের আশাবাদী করে তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইরানের প্রধান সংস্কারপন্থী জোট তাকে সমর্থন দিয়েছিল। সাবেক দুই সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ও হাসান রুহানিরও সমর্থন পেয়েছেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পেজেশকিয়ানের জয়লাভের পর প্রশ্ন ওঠেছে, ‘তার অধীনের ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে কি কোনো পরিবর্তন আসবে?’ বিশ্লেষকদের ধারণা, তেহরানের দ্রুত বিকাশমান পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের তীব্র টানাপোড়েনে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারেন তিনি।

পেজেশকিয়ান এমন লোকদের সমর্থন পেয়েছেন, যারা মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত ও তরুণ জনগোষ্ঠীর বলে মনে করা হচ্ছে। ইসলামি ভাবধারার বিপরীত কোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কয়েক বছর ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর চালানো অভিযানে ব্যাপকভাবে আশাহত হয়েছেন এই শ্রেণির ভোটাররা। মাসুদ পেজেশকিয়ান একজন স্বল্পপরিচিত মধ্যপন্থী রাজনীতিবিদ। ছিলেন ইরানের সংস্কারবাদী আইনপ্রণেতা। হৃদ্‌রোগবিষয়ক শল্যবিদ থেকে এখন তিনি দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তার এ জয় সামাজিক স্বাধীনতা ও আরও বাস্তবধর্মী পররাষ্ট্রনীতি–প্রত্যাশী ইরানের জনগণের।

পেজেশকিয়ান ইরানকে বাস্তবধর্মী পররাষ্ট্রনীতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। অঙ্গীকার করেছেন, ২০১৫ সালে সই করা আন্তর্জাতিক পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে চলা আলোচনা স্থবির হয়ে পড়ায় সৃষ্ট উত্তেজনা হ্রাস এবং সামাজিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক বহুত্ববাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার। জয় নিশ্চিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ইরানের জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘আপনাদের সাহচর্য, সহানুভূতি ও আস্থা ছাড়া সামনের কঠিন পথটি মসৃণ হবে না। আমি আপনাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম।’

রাজনৈতিকভাবে কয়েক বছর একঘরে হয়ে থাকার পর ইরানে সংস্কারপন্থী রাজনীতিকেরা নীরবতা ভেঙে জেগে ওঠেন। গত মে মাসে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হন কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। এ ঘটনার পর সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির নেতৃত্বাধীন সংস্কারপন্থী শিবির এ নির্বাচনে পেজেশকিয়ানকে সমর্থন দিয়েছে।

আয়াতুল্লাহ খামেনি–সমর্থিত সাবেক প্রেসিডেন্ট রাইসির সঙ্গে পেজেশকিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক রয়েছে। নারীদের পোশাকের স্বাধীনতায় লাগাম টানতে কড়াকড়িভাবে আইনের প্রয়োগ করেছিলেন রাইসি। পরমাণু চুক্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইরানের ঝিমিয়ে পড়া আলোচনায় গতি আনার বিষয়েও কঠোর অবস্থান নেন তিনি।  ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে সরে আসেন ও ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তার এ পদক্ষেপ চুক্তির শর্ত ভাঙতে তেহরানকে প্ররোচিত করেছে।

পেজেশকিয়ান তার দেশের ধর্মতাত্ত্বিক শাসনব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল। নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতাধর কর্তৃত্ব ও ধর্মীয় শাসকদের সঙ্গে বিবাদে জড়ানোর কোনো ইচ্ছা তার নেই। ইতিমধ্যে, বিভিন্ন টেলিভিশন বিতর্ক ও সাক্ষাৎকারে খামেনির নীতিকে চ্যালেঞ্জ না জানানোর অঙ্গীকার করেছেন তিনি।

নির্বাচনের আগে এক ভিডিও বার্তায় পেজেশকিয়ান ভোটারদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘চেষ্টা করেও আমি যদি আমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হই, তবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিদায় জানাব। তা আর চালিয়ে যাব না। আমাদের জীবনে ও প্রিয় জনগণের সেবা করার ক্ষেত্রে সময় নষ্টের সুযোগ নেই।’

পেজেশকিয়ানের এ জয়ের পেছনে ২০২০ সাল থেকে ইরান শাসন করে আসা কট্টরপন্থী সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তোষকে একটি কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এ অসন্তোষণের কারণেই নির্বাচনের প্রথম ধাপে মাত্র ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের অনেকের। ভোটের এই হার ছিল ১৯৭৯ সালের ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে সবচেয়ে কম। তবে নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে তুলনামূলক বেশি-৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। বলা হচ্ছে, প্রথম ধাপে যারা ভোটদানে বিরত ছিলেন, তাদের অনেকে পরে কট্টরপন্থী প্রার্থী সাইদ জালিলির ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে ভোট দিয়েছেন। কারণ, তারা চান না, রক্ষণশীলদের অধীনে ইরানের সঙ্গে বহির্বিশ্বের বিরোধ আরও বেড়ে যাক, আর নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে আরও একঘরে হয়ে পড়ুক ইরান।

তবে এমন কোনো ধারণা মেনে নিতে নারাজ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তিনি বলেছেন, কম ভোট পড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সেগুলো রাজনীতিবিদ ও সমাজবিদেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন। তবে কেউ যদি মনে করেন, যারা ভোট দেননি তারা রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, তাদের এ ধারণা ভুল।

২. ইরানে এমন সময় সংস্কারপন্থী পেজেশকিয়ান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, যখন আঞ্চলিকভাবে নানামুখী সমস্যার মধ্যে রয়েছে দেশটি। এর একটি গাজা যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ঘিরে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে ইরানপন্থী নানা সশস্ত্র সংগঠন। আবার ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়েও দিন দিন দেশটির ওপর পশ্চিমাদের চাপ বাড়ছে।

নির্বাচনে পেজেশকিয়ানের জয় একটি আশা দেখিয়েছে যে তার অধীনে হয়তো তেহরানের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্ক কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হবে। আর দেশটির পারমাণবিক প্রকল্পে লাগাম টানতে পশ্চিমাদের সঙ্গে ২০১৫ সালে তেহরানের যে চুক্তি হয়েছিল, সেটিও নবায়ন করা হবে। ওই চুক্তিটি নতুন করে সামনে এগিয়ে নেওয়ার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন সাইদ জালিলি।

এসব সমস্যা সমাধানে পেজেশকিয়ান কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, ইরানে রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বড় সিদ্ধান্তগুলো আয়াতুল্লাহ খামেনির পরামর্শে নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে পারমাণবিক চুক্তি বা মধ্যপ্রাচ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়া সংক্রান্ত নীতিতে পেজেশকিয়ান বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারবেন না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাদ্যম আল-জাজিরার সঙ্গে কথা বলেছেন ফারস মিডিয়া ফ্যাকাল্টির অধ্যাপক ও ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মোস্তফা খোশচেশম। তিনি বলেন, ইরানের পররাষ্ট্রবিষয়ক সিদ্ধান্তের পেছনে পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থার হাত থাকে। বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে দেশটির সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে সরকারের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি সামরিক বাহিনী, সর্বোচ্চ নেতা খামেনি ও পার্লামেন্ট সদস্যরা রয়েছেন। তাই বলতে গেলে ইরানের পররাষ্ট্রনীতি একই থাকবে। বলা চলে এই নীতি আগে মতোই এগোবে, তবে ভিন্ন গতিতে।

পেজেশকিয়ানের হাত ধরে ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তবে এরই মধ্যে নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে শুভেচ্ছা জানান বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর পেজেশকিয়ানকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, তার আশা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে ভূমিকা রাখবে নতুন সরকার।

মাসুদ পেজেশকিয়ান। ছবি: রয়টার্স

নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আশা প্রকাশ করে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘আমাদের উষ্ণ ও দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক থেকে দুই দেশের জনগণ ও অঞ্চল যাতে লাভবান হতে পারে, সেজন্য আমি আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চাই।’

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, দুই দেশের অভিন্ন স্বার্থ রক্ষায় সম্পর্ক মজবুত করতে আগ্রহী তিনি।

তেহরান-বেইজিংয়ের কৌশলগত সম্পর্ক আরও গভীর করতে পেজেশকিয়ানের সঙ্গে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।  পেজেশকিয়ানকে অভিবাদন জানানো অন্য বিশ্বনেতাদের মধ্যে রয়েছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুল লতিফ জামাল রশিদ, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কোসহ অনেকে।

৩. বিদেশি গণমাধ্যমে বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মতো মধ্যপ্রাচ্য ও দেশটির আশপাশের আঞ্চলিক রাজনীতি অনেকটা ঘোলাটে। একদিকে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও পশ্চিমা চাপ কাটিয়ে উঠতে দেশটি আঞ্চলিক স্থিতশীলতা চায়। অপরদিকে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ নামে পশ্চিমাবিরোধী সশস্ত্র লড়াইয়েও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই প্রতিরোধ অক্ষে আছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুতি, গাজার হামাস ও ইরাক-সিরিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠী। এই অক্ষ ইসরায়েলের বিনাশ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবমুক্তি চায়। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার অবসানও চায় তারা। পেজেশকিয়ান নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর প্রশ্ন ওঠেছে এমন অবস্থায় এসব ইস্যুতে কোন পথে হাটবে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট।  বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, আয়াতুল্লাহ খামেনি সমর্থিত সাবেক প্রেসিডেন্ট রাইসির সঙ্গে পেজেশকিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই ভিন্ন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নারীদের পোশাকের স্বাধীনতায় লাগাম টানতে কড়াকড়িভাবে আইনের প্রয়োগ করেছিলেন রাইসি। তবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান পেজেশকিয়ানের। পেজেশকিয়ান অব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইরানে কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারবেন নতুন প্রেসিডেন্ট তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, গার্ডিয়ান, আল জাজিরা