শিল্প ও সাহিত্য

সবুজ

১. : এতো সবুজ কেন? : সবুজে আপত্তি কেন? প্রশ্নটা করা সহজ নয়, উত্তরটাও সহজ নয়। ১৩ বছর পর শিল্পী সত্যেন রায় দেশে ফিরেছেন। ২৪ বছর আগে যখন তিনি দেশ ছেড়ে ছিলেন তখন তাকে কেউ চিনতো না। আজকে শুধু দেশে নয়, ইউরোপ, আমেরিকার বড় বড় আর্ট ক্রিটিকরা সত্যেন রায়কে এক নামে চেনে। বলা হয়ে থাকে তার স্বাক্ষর দেয়া খালি ক্যানভাসের দামও নাকি হাজার ডলার। বিশ্বের বড় বড় আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী হয়, তার ছবি নিয়ে সোদবে, ক্রিস্টির মতো নিলাম হাউজগুলো মুখর হয়ে ওঠে। সেই সত্যেন রায়, আমাদের ময়মনসিংহের সত্যেন, আমরা ডাকতাম সত্য, সে দেশে ফিরেছে। এই প্রথম তার চিত্র প্রদর্শনী হচ্ছে বাংলাদেশে। অবশ্য প্রথম বলাটা সঠিক নয়, সত্য যখন কলেজে পড়ে, আনন্দমোহনে তখনই ব্রহ্মপুত্রের পারে জয়নুল গ্যালারিতে তার দুটো ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল, আরো অনেকের সাথেই। কী যেন ছিল সেই এক্সিবিশনটার নাম! মনে নেই, সে অন্তত বছর তিরিশ আগের কথা হবে। সেই সত্য আর আজকের সত্যেন রায়ের ফারাকটা আসমান জমিন।

আমরা সত্যকে সবসময় ‘আটিস্ট’ বলতাম, ‘আর্টিস্ট’ না।  : দে তো আটিস্ট এই ফটোখান আইক্কা দে।  আমরা কোনো একটি মেয়ের ছবি টবি লুকিয়ে পেলে কিংবা ববিতা, সুচরিতার ভিউকার্ড পেলে সত্যর হাতে দিয়ে বলতাম, অখনই আইক্কা দে।  শুরুতে সত্য দিতো। হুবুহু আঁকতে পারতো। ছবিটার চেয়েও সত্যর আঁকাটা ভীষণ সুন্দর হতো। কিন্তু পরের দিকে আঁকতো না। আমরা বলতাম, হালার পোর ভাব হইছে!  মোখলেশ একদিন বললো, মালুর পুতের ভাব হইছে, আসমানের দিকে চাইয়া থাকে। আমি বললাম, মালু কস ক্যা, ফাজিল।  : ক্যা, ও মালু না? : না, ও আমাগোর বন্ধু, আমাগো সত্য। তোরে কি ও ম্লেচ্ছো কয়? কথায় কথায় হিন্দু-মুসলমান টানবি না। : তোর ইয়ে টানবো শালা।

আমি মোখলেশকে টেনে একটা চড় দিয়ে ছিলাম। চড়টা কড়া হয়ে ছিলো মনে হয়। মোখলেশ নাকি তারপর থেকে এক কানে কম শুনতো। আর লোকে মনে করতো আমি আর সত্য যুগ যুগের বন্ধু। কিন্তু বন্ধু ফন্দু কিছু না। সত্য ঢাকা চলে এলো। চারুকলায় পরলো। বড় বড় চুল রাখলো, দাড়ি রাখলো। দাড়িতে বেনি করলো। আমি একবার ঢাকা এসে ওরে চিনতে পারি না।  : কি রে সত্য, ভোল পাল্টায়া ফালাইছোস, তোরে তো দেখতে আটিস্ট লাগে রে। : আমি আর্টিস্ট, তোরা বুঝবি না।  : আলাপ দিতে আইছোস, তোরে আমরা বুঝমু না। কথা কিন্তু সত্যেন ঠিক বলেছিল। তাকে আমরা বুঝিনি। বিদেশিরা চিনেছে তাকে। জার্মানি চলে গেলো সত্যেন। মিউনিখে থাকে। কিন্তু ঘুরে বেড়ায় সারা ইউরোপ। গটমট-টাগেন-মাগেন করে সে ‘ডয়েচ’ বলে। জার্মান ভাষা বলে মাতৃভাষার মতো। স্প্যানিশ আর ফরাসিও জানে। দেশ বিদেশের টিভিতে তার ইন্টারভিউ হয়। আমি আমার স্কুলের বাচ্চাদের গুগল করে দেখিয়েছি এই সত্যেন হলো আমাদের বন্ধু। সে জেলা স্কুলের গর্ব, আনন্দমোহন কলেজের গর্ব। বাচ্চারাও এখন গুগল করতে পারে। একদিন শিউলি এসে বললো, স্যার, সত্যেন রায় আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সসেপ্ট করছে।  : মানে কী?  : মানে উনি ফেসবুকে আছেন। আমি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। ফলোয়ার ছিলাম, তারপর ম্যাসেঞ্জারে নক দিসি মেলাবার। শেষে দেখছে। আমি কইছি, আপনের দেশের মাইয়া, আপনের গল্প শুনি আমাগোর স্যারের কাছে। আপনে নাকি আসমানে উড়তে থাকা পাখিরেও হুবুহু আঁকতে পারেন! : কও কী! : হুম। আমারে কয়, হুবুহু আঁকতে পারা কঠিন কিছু না। তোমার মোবাইলে এক টিপে একটা হুবুহু ছবি তুমি তুলতে পারো। সেইটারে হুবুহু আঁকতে পারলে তুমি একজন ফটোগ্রাফার হইলা এর বেশি কিছু না। : শিউলি, তোর সাথে এতো কথা হইছে! : হ স্যার। তিনি বাংলাদেশে আসতেছেন। ঢাকায় তার বিরাট এক্সিবিশন হইবো। আমি যামু।  : কস কী! এর দুইমাস পরেই সত্যেনের প্রদর্শনী হলো। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আরো কী কী প্রতিষ্ঠান মিলেমিশে তাকে এনেছে। আমি খবর পাওয়া মাত্রই হাজির। শিউলিও আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার বাবা মা আসতে দেয় নাই। 

এখন আমি সত্যেনের ছবির সামনে। সত্যেন আমার থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে। আমি দূর থেকে তাকে দেখছি। ভাবছি, যাবো কি না, পরিচয় দেবো কি না। যদি বদলে গিয়ে থাকে! চেহারা তো বদলেই গেছে। ঝাকড়া চুলের সত্যেনেরে মাথায় বিশাল টাক। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। এক কানে একটা নাকফুলের মতো জিনিস। মনে হয় হীরার। ঝিকঝিক করছে। গ্যালারিতে বহু লোকজন। সত্যেন সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলছে। তার চোখে, মুখে সাফল্য আর সুখ। প্রদর্শনীর নাম রেখেছে ‘আমার সবুজ’। ছবিগুলোও সব সবুজ রঙের। আমি অবশ্য অধিকাংশ ছবিরই আগা-মাথা কিছু বুঝতেছি না। এতো ভালো ছবি আঁকতো সত্যেন এখন এইসব কি আঁকছে? সে কি বিখ্যাত হওয়ার পর আঁকা ভুলে গেছে? আমি ভাবছি এই সবুজ কি বাংলাদেশে। এরমধ্যেই এক নারী গিয়ে প্রশ্ন করলো, এতো সবুজ কেন? সত্যেন মিষ্টি করে হেসে পাল্টা প্রশ্ন করলো, সবুজে আপত্তি কেন?

আরে, এই তো আমাদের সত্যেন, প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করে উত্তর দেয়। তবে ভদ্রমহিলাও কম না, ভদ্রমহিলা নাকি নারী, নাকি তরুণী বোঝা মুশকিল। আগাগোড়া কালো গাউন বা বোরখা টাইপের কিছু পরা। মাথাতেও হিজাব বা স্কার্ফ টাইপের কিছু। পর্দা করছে নাকি ফ্যাশান বোঝা মুশকিল। আরো বোঝা মুশকিল তার বয়স। পুরো শরীর প্রায় ঢাকা। মুখ দেখে তো তরুণীই মনে হয়। শরীরও ছিমছাম। আমি শুনতে পাই তরুণি অথবা নারী বলছে, আপত্তির প্রশ্ন তো আসেনি। কৌতূহল। এতো রঙ থাকতে আপনি সবুজকেই বেছে নিলেন কেন? তারুণ্য, সতেজতা, প্রকৃতি, বাংলাদেশ, সবুজ কি বলে আপনার ছবিতে? : আপনি সাংবাদিক? : না। আমি ক্রেতা। : জ্বি? : আপনার ‘দ্য ড্রিম : ট্রিবিউট টু অঁরি রুশো’ ছবিটা আমি কিনেছি।  সত্যেন এবার ভালো করে নারীটিকে দেখে। শিল্পীর চোখে দেখা। আগাগোড়া এমনকি ভেতরটাও দেখা। আমিও দেখি। তবে জেলা স্কুলের অঙ্কের মাস্টারের চোখ দিয়ে। তাতে তেমন কিছু ধরা পড়ে না। এটুকু বুঝি, তিনি অনেক বড়লোক। তার পোশাক আশাক শুধু না, সত্যেনের ছবি কেনার ক্ষমতাও বলে দেয়, সে কত বড়লোক। 

আমি দ্রুত চলে যাই ‘দ্য ড্রিম : ট্রিবিউট টু অঁরি রুশো’ ছবিটার খোঁজে। বেশি দূর যেতে হয় না। পাশের দেয়ালেই রাখা ছবিটা। বিশাল আকারের। পুরো ক্যানভাসজুড়ে দলা দলা সবুজ রং, আশেপাশে ছড়িয়ে আছে থোকা থোকা কিছু নীল আর হলুদ। একদম উপরে কোণায় একটা সাদা গোল্লা, যেন চাঁদ আর নিচে গোলাপি আঁকাবাঁকা রেখা, নদী অথবা সাপ। আমি চিত্রকলা বুঝি না। এটাও বুঝিনি। অতএব সময় নষ্ট না করে আবার অচেনা লোকের মতো সত্যেনের ধারে কাছে যাই। কান পাতি। তারা কথা বলছে। : আমি কিন্তু অঁরি রুশোর ‘দ্য ড্রিম’ দেখেছি। : আপনি নিউ ইয়র্কে ছিলেন? : না। বেড়াতে গিয়েছিলাম। আসলে মোমাতে গিয়েছিলাম।  : মোমা কিন্তু আমার দুটো কাজ কিনেছে।  : জানি। আপনার সম্পর্কে আমার সামান্য পড়ালেখা আছে।  : আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আনন্দিত হলাম মিজ... : উম্মে সায়রা।  : শুধু সায়রা বলতে পারবো।  : ইয়াডভিগাও বলতে পারেন। : মাই গড, আপনার তো পড়ালেখা অনেক। এটাও জানেন অঁরি রুশোর ওই ছবিটার নগ্ন নারীর নাম ইয়াডভিগা।  : এটুকু জানা কঠিন না। যারাই মোমাতে যায়, গাইড তাদেরকে এটুকু বলে।  দুজনের কথা জমে উঠেছিলো। আমি যদিও এদের কথা কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তবু শুনে মজা পাচ্ছিলাম। ওদের কথা যেন কোন ধ্রুপদী সিনেমা বা গান, যার সব কিছু বোঝা না-গেলেও এক স্বাদ পাওয়া যায়। এর  মাঝেই রসভঙ্গ করলো এক সাংবাদিক। হুড়মুড় করে চলে এলো সে।  : এক্সকিউমি, আমি অমুক পত্রিকার তমুক, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। : জনাব তমুক আপনি ম্যাক্সের সঙ্গে কথা বলুন। সে আমার ম্যানেজার হিসেবে এখানে কাজ করছে। ওই ডেস্কের ওখানে সে আছে। সে আপনাকে এপোয়েন্টমেন্ট দিয়ে দেবে। 

লোকটা মুখ কালো করে চলে গেলো। নিশ্চয়ই সে এবার পত্রিকায় সত্যেনের সম্পর্কে দুটো বাজে কথা লিখে দেবে। না, দেবে না মনে হয়। সে ডেস্কের দিকেই যাচ্ছে। আমি তখনও কাচুমাচু করছি। যাবো সত্যেনেরে সামনে? এমন ভাববে না তো, বিখ্যাত লোকের বন্ধু হওয়ার সুবাদে সেলফি তুলতে এসেছি।  সত্যেন উম্মে সায়রাকে বললো, কিছু মনে করবেন না, ইয়াডভিগা, আমাকে যেতে হবে। বুঝতে পারছেন, আমার অনেকগুলো শিডিউল। ছবি কেনার জন্য ধন্যবাদ। আমি ইন্টারটেরিস্টাল হোটেলে আছি। ৩০৩ নাম্বার স্যুট। আপনার নাম বলা থাকবে কাউন্টারে। যদি আসেন আপনাকে ওরা এলাউ করবে। যদিও আমি গেস্ট এলাউ করবো না বলে রেখেছি। কাল দুপুরে আমার সঙ্গে লাঞ্চ করলে খুশি হবো।  : আমি জানাবো আপনাকে। আসি। 

আমি ওই নারীর দিকে বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলাম। সত্যেন রায় নিজ থেকে দাওয়াত দিলো আর সে কি না ‘জানাবো’ বললো। অবশ্য বলতেই পারে। সেও নিশ্চয়ই হেজিপেজি কেউ নয়। এই বাংলাদেশে ১৮ লাখ টাকা দিয়ে একটা ছবি কেনার লোক আছে আমি তো তাই জানতাম না। ‘দ্য ড্রিম : ট্রিবিউট টু অঁরি রুশো’ ছবিটার দাম ১৮ লাখ টাকা! : সত্যেন? : জ্বি।  : কেমন আছিস? : ভালো। : তুই বিখ্যাত না হলে আমিও চিনতে পারতাম না তোকে। নেটে দেখেছি তোর ছবি। : আপনি? : মুবিন, জেলা স্কুল, কাচিঝুলি। : ওরে শালার পুত মুবিন! কেমন আছিস! সত্যেন আমাকে জড়িয়ে ধরে। যে ভাবে ‘ওরে শালার পুত’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে আশেপাশের সবাই তাকায়। আমার চোখে পানি এসে যায়। সত্যেন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই স্কুলের দিনের একপ্লেটে চটপটির টক ভাগ করে খাওয়ার কথা মনে পড়ে।  : ছাড়, দম বন্ধ কইরা মারবি! : কতোদিন দেখা হয় না। তুই তো তেমনি আছিস? : হ। তুই বুড়া হয়া গেছিস। টাকলু হইছিস।  : পিকাসোও টাকলু ছিলো। তা বল, কই আছিস, কী করিস? : সেই কাচিঝুলিতেই। জানিস, আমি এখন জেলা স্কুলেই পড়াই। অঙ্কের মাস্টার। অঙ্কের ক্লাসে তোর কথা বলি। : আহারে, এই অঙ্কে যে তুই কী গাধা ছিলি! : হুম। খালেক স্যারের পিটানিতে গাধা এখন অঙ্কের মাস্টার। ময়মনসিং যাবি না।  : মনে হয় যেতে পারবো না রে। মাত্র তো সাতদিনের জন্য এসেছি। এই পোগ্রাম, সেই পোগ্রাম। কাল জাতীয় জাদুঘরে আমার সম্মানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিনারের আয়োজন করেছেন। আসবি তুই? : আমি! আরে নাহ! : না কেন, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। : ছাতার ফ্রেন্ড। যোগাযোগ রেখেছিস কোন? : দোস্ত, কী পরিমাণ ছোটাছুটির উপর থাকি তা নিজেও জানি না। আমারে চালায় আমার এজেন্ট, ম্যানেজার। লোকে ভাবে বিখ্যাত লোকদের অনেক মজা। অনেক মজার কী আছে জানি না, তবে এটা জানি যে, বিখ্যাত লোকের দম ফেলতে গেলেও শিডিউল করে নিতে হয়। আয় না দোস্ত, কাল, আমি ম্যাক্সকে বলে দেই।  আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না। সত্যেন রায় ঘাড়টা একটু কাত করে ডাকে ম্যাক্সকে। ম্যাক্স তরুণ। চটপটে। সে ছুটে আসে, সত্য বলে, Entschuldigen Sie, Max, haben Sie bitte Zeit? : natürlich. দেখো ম্যাক্স, এ আমার বন্ধু, স্কুল ফ্রেন্ড, সুলে ফ্রয়েন্ড, এয়া হাইস্ট মুবিন, কাল ডিনারে ওকে আমার টেবিলে রাখো। Hast du verstanden? জ্বি স্যার। Ich bringe eine Einladungskarte mit. warte bitte.

ম্যাক্স চলে গেলো। সত্যেন বললো, তোকে অপেক্ষা করতে বললো, আইনলাডুঙ মানে দাওয়াতের কার্ড আনতে গেলো। খুব করিৎকর্মা ছেলে। ঠিক তোকে আমার পাশে বসানোর ব্যবস্থা করবে। ব্যাপারটা সোজা না। অনেক হোমড়া চোমড়াই বিখ্যাত শিল্পীর পাশে বসে ছবি তুলতে চায়। আদতে ছবি আঁকার প্রতি এদের কী দরদ সে তো তুই জানিসই! : জানি না আবার, ছবি আঁকার জন্য তোকে... : চুপ, ভুল করেও এ সব বলতে যাসনে। আমি সব ভুলে গেছি। চাই না, কোন সাংবাদিক নতুন করে কোনো গল্প বলুক।  নতুন গল্প! কিন্তু সত্যেন রায়ের গল্পটা পুরনো। এদেশের অনেক হিন্দুই তো দেশ ছেড়ে চলে গেছে। সত্যেন ময়মনসিং ছাড়তে চায়নি। তাদের দেড়শ বছরের পুরনো বাড়ি ফেলে মাসিরা চলে গেলো। সত্যেন একা রয়ে গেলো। সেই সত্যেন... থাক, ও যা মনে করতে চায় না, তা কেন আমি মনে করিয়ে দিবো। হয়তো কিছু স্মৃতি ভুলে যাওয়া ভালো। : তোদের বাড়িটা দেখতে যাবি না সত্যেন? সত্যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এতো এতো সবুজ রঙের ছবির মাঝখানে দীর্ঘশ্বাস বড়ো বেমানান। সত্যেন বললো, আমাকে একটু বেরুতে হবে দোস্ত। দুটো মিটিং আছে। কিছু মনে করিস না। ম্যাক্স তোর সাথে যোগাযোগ করবে। তোর নাম্বারটা ওকে দিয়ে যা। আর ও তোকে কার্ড দিয়ে দেবে। সময় পেলে তোর সাথে আড্ডা হবে।  সত্যেন যেন একটু তাড়াহুড়া করেই চলে গেলো। বাড়ির কথাটা বলা বোধহয় ঠিক হয়নি। পুরনো ঘায়ে খোঁচা দেয়া ভালো নয়। আমি অনেক সময় না-বুঝেই অন্যায় করে ফেলি।

২. আমি কে?  একটা সাধারণ স্কুল মাস্টার। আমার পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসা অকল্পনীয় ব্যাপার। ময়মনসিংহে একবার নির্বাচনের পরপরই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন। দূর থেকে তাকে দেখেছি। কাছ থেকে দেখার কপাল বা সুযোগ আমার নেই। কিন্তু সত্যেন আমাকে সুযোগ করে দিলো। ও নিজে ডিনার পার্টিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি ছবিও তুললাম। কতো বড় বড় মানুষেরা সত্যেনকে ঘিরে রইলো। অবাক হয়ে দেখলাম সেই উম্মে সায়রাও হাজির। আমি ফিসফিস করে বললাম, উনি এখানে? সত্যেন হেসে বললো, যারা যারা আমার ছবি কিনেছে, তারাও আমন্ত্রিত। আমার ছবির দাম জানিস তো? : দেখলাম! ওরে বাপরে! দশ লাখ টাকার নিচে কোনো ছবিই নাই। আর তোর যে সব ছবি ওগুলো টানাতেও তো বড় বড় দেয়াল লাগবে। : আমি একটু লার্জ ফর্মেটে কাজ করি তো। সবুজ রঙটা বড় ক্যানভাসে খেলে ভালো। যাহোক, হেলিকপ্টারে চড়েছিস কখনো? : না রে দোস্ত, আমি ছাপোষা মানুষ। স্কুলে পড়িয়ে আর টিউশনি করে চলি। বিমান, হেলিকপ্টার আমার জিনিস না। : কাল চড়বি। : মানে? : ম্যাক্স তোকে উঠিয়ে নিবে। বা এক কাজ কর, সকাল এগারোটায় আমার হোটেলে চলে আয়। এক সাথে যাবো। : কোথায়? : ময়মনসিং। : বলিস কি! : হুম, এতোদূর এলাম। দেখে যাই। কবে মরে যাই ঠিক তো নেই। 

ব্যস, সত্যেন আবার ব্যস্ত হয়ে গেলো। সে সমানে ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, বাংলা বলে যাচ্ছে। নানা রকম লোকের সাথে নানা রকম করে কথা বলছে। ছবি আঁকা ব্যাপারটা বর্ণিল জানতাম, কিন্তু ছবি আঁকে যারা তারা এতো বর্ণের মানুষের সাথে এতো ভাষায়, এতো রঙে, ঢঙে মিশতে পারে সত্যেনকে না দেখলে ধারণাই করতে পারতাম না। 

৩. সত্যি বলতে দ্বিধা নেই, আমি কোনদিন কোনো ফাইভ স্টার হোটেলের ভেতরে ঢুকিনি। গেটের উর্দিপরা লোকজনও কেমন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি মাথা নিচু করে গুটি গুটি পায়ে এগুতে থাকি। ঠিক দশটায় আমি রিসিপশনের সামনে। সত্যেনের সঙ্গে দেখা করবো বলি। : স্যাতেন রেয়? ইউর নেমই স্যার। মিস্টার মোবিন। ইয়েস স্যার, হি ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।  বলেই মেয়েটা একটা বেয়াড়া গোছের কাউকে ডাকে। সে আমাকে সত্যেনের রুম পর্যন্ত নিয়ে যাবে। আমি বুঝতে পারি না, আমি তো বাঙালি, রিসিপসনিস্ট মেয়েটাও বাঙালি, তবু সে কেন সত্যেন আর মুবিন নাম দুটো এতো বেকিয়ে উচ্চারণ করলো। এটাও কি কোন ফাইভ স্টার তরিকা!

সত্যেনের ঘরের বেল বাজতেই ম্যাক্স দরজা খুলে দেয়। Guten Morgen Herr Mubin, Assalamulaikum.  আমি ম্যাক্সের ব্যবহারে মুগ্ধ হই। সুন্দর করে সালাম দিলো। তার আদব কায়দাও অনেক। সে মুবিন নামটা ঠিকঠাক উচ্চারণ করলো। সত্যেনের সামনে আমাকে রেখে সে সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলো।  : বোস। আমরা ১২টায় ফ্লাই করবো। হেলিকপ্টার এখানেই আসবে। আমাদের সঙ্গে আরেকজন যাবে। ইয়াডভিগা। সত্যেনের গলা ভারী। তার সামনে অদ্ভূত একটা বোতল। বড় একটা এনার্জি বাল্বের মতো দেখতে বোতলটা, কিংবা নাশপাতির মতো। বোতলটার ভেতরেও একটা নাশপাতি। নিশ্চয়ই কোন মদ হবে। সত্যেন পান করছে। ইতোমধ্যেই সে নেশাক্রান্ত। : খাবি? নাকি এ সব খাস না। : পাই না। তাছাড়া এখন মাস্টারি করি।  : আজ একটু খা। ভালো জিনিস। পোঁয়া উইলিয়ামস। পোঁয়া মানে পিয়ার মানে নাশপাশি। খারাপ কিছু না। নাশপাতির ব্রান্ডি। খেয়ে দেখ। টেস্ট ভালো।  সত্যেন আমাকে একটা গ্লাসে একটু ঢেলে দিলো। স্বাদটা বেশ। : কিন্তু এখন এ সব খাচ্ছিস। জার্নি করবি? : ধুর ব্যাটা। চপার রেডি আছে।  : চপার কি? : হেলিকপ্টার। যেতে লাগবে চল্লিশ মিনিট। এই হোটেলের ছাদ থেকে উঠবো ছাদেই নামবো।  : ময়মনসিং কই নামবি। : সার্কিট হাউস। তুই ওইসব ভাবিস না। সব রেডি আছে। কি খাবি বল? পেটিস দিতে বলি? এদের বিফ পেটিস ভালো। : তুই বিফ খাস? : না হ্যাম খাই। মানে শুয়োর। তোর জন্য বিফ। এই ড্রিঙ্কটার সঙ্গে রেড মিট ভালো যায়। খা একটা। 

এর মধ্যেই আবার বেল বাজে। দরজার খোলার শব্দ পাই। অপূর্ব সুন্দরী এক নারী প্রবেশ করে। সত্যেন উল্লসিত স্বরে বলে, Hier kommt Frau Yadwigha. চিনতে পারিসনি? উম্মে সায়েরা। আমি সত্যিই বিস্মিত হলাম। এ যেন অন্য এক নারী। সেদিনের গ্যালারিতে দেখা নারী নয়। আজ ইনি শাড়ি পরেছেন। এক রঙা। সবুজ শাড়ি, ব্লাউজটা হলুদ। কপালে হলুদ টিপ।  : পরিচয় করিয়ে দেই, এ হচ্ছে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, মুবিন, মুবিনুর রহমান আর ইনি হচ্ছেন ইয়াডভিগা ওরফে উম্মে সায়রা ওরফে সবুজ। : বুঝলাম না দোস্ত। : কেমনে বুঝবি। ওই যে অঁরি রুশো ফরাসী পেইন্টার। তিনি অনেকগুলো জাঙ্গল পেইন্টিং এঁকেছেন। তারমধ্যে জীবনে শেষ যে ছবিটা এঁকেছেন সেটার নাম ‘দ্য ড্রিম’। অদ্ভূত একটা ছবি। দাঁড়া ছবিটা তোকে দেখাই। 

সত্যেন তার মোবাইলে আমাকে ছবিটা দেখালো। সত্যিই ছবিটা অদ্ভূত টাইপের। একটা জঙ্গলে রাতের ছবি। এক কোণায় ধবধবে সাদা চাঁদ। অচেনা সব গাছপালা। চারিদিকে সবুজ। পুরো ছবিটার আশিভাগই সবুজ। নানা রঙের সবুজ। পেছনে কালো মানুষ, নারী না পুরুষ বোঝা কঠিন, কোন একটা বাঁশি বাজাচ্ছে, সাপুরে নাকি? সামনে একটা গোলাপী সাপ হেঁটে যাচ্ছে। আর সামনে বামপাশে প্রায় তিরিশভাগ জায়গা জুড়ে একটা সোফা, সেই সোফায় হলদে, সবুজ, বাদামী রঙের একজন নারী অর্ধশোয়া। একদম নগ্ন। তার চারপাশে গাছে নানা রঙের ফল, ফুল, জন্তু। পাখি, সিংহ, হাতি, বানর, সাপ আরো কতো কি!  : কি বুঝলি? : আমি তো ছবি বুঝি না। আমি অঙ্কের লোক। তবে দেখতে ভালো।  : এই যে নগ্ন নারীটা এর নাম ইয়াডভিগা। এ ছিলো শিল্পী অঁরি রুশোর বান্ধবী।  আমি উম্মে সায়রার দিকে তাকাই। বুঝলাম, উম্মে সায়রাই এখন ইয়াডভিগা।  : কিন্তু সবুজ? : ওটা আমার ডাক নাম। বাবা-মার দেয়া।  : সবুজ ছবি আঁকতো। : এখন আঁকেন না। : না। এখন ছবি কিনি। শিল্পীদের উৎসাহ দেই। : ও। তাহলে আমাদের সত্যেনের ছবি কিনেছেন ওকে উৎসাহ দিতে।  : না, নিজেকে উৎসাহ দিতে।  : কেমন? : আমি তো মরে গিয়েছিলাম। ভাবলাম জীবিত হই। আপনার বন্ধুর ছবিতে... থাক, সব একবারে বুঝে গেলে হবে? : নাও, এক সিপ ঢেলে নাও। গুড লিকার ইজ লাইক গুড উইম্যান। : স্যরি, আমি দিনের বেলা ড্রিঙ্ক করি না। লেটস গো।

৪. হেলিকপ্টারের সামনে পাইলটের পাশেই আমি। পেছনে ইয়াডভিগা অথবা উম্মে সায়রা অথবা সবুজ, তার পাশে সত্যেন। ম্যাক্সকে আনা হয়নি। সে সব গোছগাছ করে রাখবে। আমরা ফিরে গিয়ে লাঞ্চ করবো।  হেলিকপ্টার থেকে ব্রহ্মপুত্র, তার পার, পার্কের আশপাশ, ডিসির বাড়ি, এসপির বাড়ি, সার্কিট হাউজ দারূণ লাগে দেখতে। এই পথগুলো দিয়ে কতো সকাল সন্ধ্যা হেঁটেছি। সত্যেন আর আমি এক সময় এখানে সাইকেলও চালিয়েছি। কিন্তু উপর থেকে দেখবো কখনো ভাবিনি। নিজেকে কেমন পাখি মনে হচ্ছে।  সত্যেনকে বললাম, তোর বাড়িতে যাবি।  : হুম যাবো।  : বলিস কি! আমি উল্লসিত হলাম। সত্যেন তার পৈত্রিক ভিটায় যাবে। কিন্তু সাথে সাথে মন খারাপ হয়ে গেলো। গেলে কী দেখবে? কিচ্ছু নাই। দরজা-জানালাগুলোও খুলে নিয়ে গেছে কারা। পরিত্যক্ত, জংলা একটা বাড়ি। সত্যেনের নিশ্চয়ই অনেক মন খারাপ হবে। 

হেলিকপ্টার সার্কিটহাউজ মাঠে নামলো। ছেলেরা ক্রিকেট খেলা রেখে হেলিকপ্টারের নামা দেখলো। সত্যেন খুব বুদ্ধিমান, দ্রুত এক হাতে আলগোছে সবুজকে ধরলো, আমাকে চোখের ইশারা করলো। জোরে হাঁটা দিলো। সাহেব পার্কের একটু পরেই সত্যেনদের বাড়ি। আমরা দশ মিনিটে চলে এলাম।  বাড়ির গেট ভাঙা, সীমানা দেয়ালের ইট খসে পড়েছে। চারিদিকে জঙলা হয়ে গেছে। সাপখোপ থাকতে পারে। আমি একবার বাড়ির দিকে তাকাই একবার সত্যেনের দিকে। সত্যেনের চোখে কি বেদনা? আমি পড়তে পারি না সত্যেনের চোখ। আমি অঙ্কের মাস্টার, মানুষের চোখ আর কতটুকুর পড়বো। হোক সে এক কালের প্রাণের বন্ধু। : তুই একটু দাঁড়া এইখানে। চা সিগারেট খা। আমার ঘণ্টা খানেক লাগবে। সত্যেন আমার হাতে লাইটার, সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে সবুজকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম না ওরা কী করবে? ওরা আমাকে বাইরে রেখে কেন ভেতরে ঢুকলো। এ বাড়ির ভেতরটা আমার চেয়ে কে বেশি জানে? বাড়ির ভেতরে বড় একটা আঙিনা আছে। সেখানে সিমেন্টে বাধাই করা চত্বর। বড় তুলসি, করবি, হাস্নাহেনা গাছ ছিলো। সিমেন্ট ঠান্ডা হয়ে থাকতো গাছের ছায়ায়।  সেইসব গাছ কি আর আছে?  আমি নিজেও এ বাড়িতে ঢুকিনি কতো বছর!

৫.  হেলিকপ্টার ঢাকার দিকে যাচ্ছে। সত্যেন ঠিক এক ঘণ্টা পরেই ফিরে এসেছে। সে কোন কথা বলেনি। সবুজও নিরব। তারা আবার হাত ধরাধরি করে হেলিকপ্টারে উঠেছে। আমি চুপ থাকতে পারিনি। : কি রে সত্য? মন খারাপ। : নাহ, মন খুব ভালো। : বাড়ি দেখে মন খারাপ হয়নি?  : মানুষ না-থাকলে বাড়ি আর কি! আমি তো বাড়ির মায়া ছেড়ে দিসি। তুই পারলে বাড়িটার সংষ্কার করা। আমি টাকা পাঠাবো। কোন একটা আর্ট স্কুল বা এমনিতেই একটা স্কুল দিতে পারিস। খরচ নিয়ে ভাবিস না। আমার মনে হলো সত্যেনের মন খুব ভালো হয়ে গেছে। খুব একটা খুশি ভাব। সবুজকে দেখলাম তার হাত ধরে আছে।  : মন ভালোর কারণ কি এটাই? বাড়িটার একটা গতি করতে পারলি? : হুম বাড়িটাকে অমর করে দিলাম। : কীভাবে? স্কুল করে? আমি তো ফেইল করতেও পারি। : আমি তো ফেইল করিনি।  : কেমন হেয়ালি লাগছে তোর কথা। : শোন মুবিন, আমি আমার জীবনের সেরা ছবিটার স্কেচ করেছি এই বাড়িতে। : দেখি? : না। কাজ শেষ করি। দুনিয়ার সবাই দেখার আগে তুই দেখতে পাবি কথা দিলাম। অঁরি রুশো জঙ্গলের মধ্যে একে ছিলো ইয়াডভিগাকে আর আমি সত্যেন রায় আঁকবো সবুজকে, এক পরিত্যক্ত জঙ্গলা বাড়ির প্রেক্ষিতে। সবুজের আরেকটা অদ্বিতীয় ছবি পাবে এই বিশ্ব। যে সবুজ ভ্যাগ গঘ ধরেছিলো তার সবুজ গম ক্ষেত আর সাইপ্রাস গাছে, যে সবুজ এল গ্রেকো ধরেছিলো ভিউ অব টলেডোতে, যে সবুজ আলবার্ট ড্যুরা ব্যবহার করেছিলেন তরুণ ভেনিসিয়ানের ছবিতে তেমনি এক অমর সবুজ ছবি আমি আঁকবো। তারই স্কেচ করেনিলাম আজ, নিজের পরিত্যক্ত জঙলা বাড়িতে। এই বাড়ি থেকে সবাইকে তাড়িয়ে দিলেও, এ বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেলেও এ বাড়ি অমর হবে, সেই অমরত্বের সঙ্গী হবে উম্মে সায়রা, ওরফে সবুজ।

আমার হঠাৎ মনে হয়, এই হেলিকপ্টারটা ঢাকায় দিকে নয়, অমরত্বে দিকে যাচ্ছে!