ভ্রমণ

আগর-আতরের আঁতুড়ঘরে

সুগন্ধি ভালোবাসেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ধর্মীয়-উৎসব থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আতর কিংবা সুগন্ধির ব্যবহার রয়েছে। পবিত্রতার আমেজ ছাড়াও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবেও এগুলো যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। চিরসবুজ বৃক্ষ আগর গাছ। এই গাছের নির্যাস থেকে তৈরি করা হয় আতর বা সুগন্ধি। কৃত্রিম এবং প্রাকৃতিক দুই উপায়েই আগর থেকে সুগন্ধি উৎপাদন করা হয়। 

সিলেটের মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলাকে বলা হয় আগর-আতরের আঁতুড়ঘর। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, এ এলাকায় আগর চাষের ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের। ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘হর্ষ চরিত’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, এ গ্রন্থের রচয়িতা আসামের মহারাজা বর্মণের কাছ থেকে মৌলভীবাজারের বড়লেখা থেকে সংগৃহীত আগর কাঠ ও তরল আতর উপহার পেয়েছিলেন। কথিত আছে, রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করার পর হজরত শাহজালাল (রা.) রাজভাণ্ডার থেকে মূল্যবান আগর কাঠ ও আতর পেয়েছিলেন। ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে আবুল ফজল আল্লামী রচিত ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে আগর কাঠ, আগর তেল এবং আগর থেকে আতর আহরণের বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বড়লেখায় আগর চাষের বিস্তার ও ব্যবসা সুসংগঠিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। সেসব কারণে মৌলভীবাজারকে আগর-আতরের জেলাও বলা হয়। আজকে আমাদের ভ্রমণ গন্তব্য আগর আতরের জন্য প্রসিদ্ধ সিলেটের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়ন। 

ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে আমাদের চার চাকার গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। দিনের দ্বিতীয় প্রহরে আমরা এসে পৌঁছলাম। এলাকার প্রবীণ তাজউদ্দিন শেখ ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। প্রথমে আমরা তাজউদ্দিন ভাইয়ের বাসায় গেলাম আগর কাঠ দেখার জন্য। তাজউদ্দিন ভাই প্লাস্টিকের বড় বাক্স থেকে আগর কাঠ দেখালেন। বললেন, কাঠগুলো শ্রমিক দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে তারপর বিদেশে পাঠানো হয়। আরব দেশের লোকেরা এই কাঠ পুড়িয়ে সুগন্ধি নেয়। বিদেশে এর চাহিদা খুব বেশি। তবে এটি পারফিউম না। এর ধোঁয়া নেন তারা। 

গাছের গায়ে পেরেক ঠুকে রাখা আছে

তাজউদ্দিন ভাই আগর কাঠের টুকরো পুড়িয়ে বললেন, সুবাস বুঝতে পারছেন? আমরা লক্ষ্য করলাম ঘরজুড়ে চমৎকার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। অবাক করা বিষয় হলো, প্রতিটি কাঠ থেকে একই রকম সুবাস পাওয়া যায় না। প্রতিটির ঘ্রাণ আলাদা। কাঠগুলো কীভাবে সংগ্রহ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুজানগরের ভেতরে মেঠোপথ কিংবা পাকা সড়ক ধরে এগোলে দু’পাশে চোখে পড়বে বাগানে সারি সারি আগর গাছ। বাড়ির আঙিনাতেও এ গাছ লাগিয়েছেন অনেকে।প্রতিটি পরিবার বংশ পরম্পরায় এই গাছের চাষ করছেন। তাছাড়া বড়লেখায় পাহাড়গুলোতেও আগর গাছ পাওয়া যায়। আগর গাছকে আরবিতে বলে ‘উদ’। আগর গাছ থেকে কাঠ বের করার পর তা থেকে যে আবর্জনা হয় সেখান থেকেও  আতর বের হয়। আবর্জনা থেকে বের হওয়া আতর বিক্রি হয় তোলা সাত হাজার টাকা। 

তিনি আরো বললেন, পৃথিবীতে পবিত্র কিছু থাকলে তা হলো ফুল আর আতর। আতর গাছের গোড়াও দেশের বাইরে রপ্তানি হয়। এই গাছের গোড়া আরবের মানুষ শোপিস হিসেবে ব্যবহার করেন। এরপর আমরা তাজউদ্দিন ভাইয়ের বাসা থেকে গেলাম তার আতরের কারখানার দিকে। আমরা বাঁশের সাঁকো পেড়িয়ে এগিয়ে চলছি। কারখানার সামনে দেখতে পেলাম আগর গাছের কাঠ টুকরো করে কেটে রোদে ফেলে রাখা হয়েছে। এই কাঠগুলোই বিদেশে রপ্তানি করা হয়।

আমরা কারখানার ভেতর প্রবেশ করলাম। তাজউদ্দীন ভাই  জানালেন, প্রথমে বাগান থেকে গাছ সংগ্রহ করা হয়। পরে লোহাগুলো সরিয়ে লাকড়ির মতো কেটে তা কুচি কুচি করে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। ১৫ থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত ভিজিয়ে সেগুলো নির্দিষ্ট পাত্রে জ্বাল দেওয়া হয়। একই তাপমাত্রায় জ্বাল দেওয়া হয় অন্তত ৮ থেকে ১২ দিন। এরপর আরেকটি সিলিন্ডারে নেয়া হয়। সিলিন্ডারটিকে আরেকটি বড় প্রবহমান পানি ভর্তি পিপার মধ্যে রাখা হয়। এখানে আগর তেলমিশ্রিত বাষ্প পানি অন্য পাত্রে গিয়ে জমা হয়। আর পানি থেকে আগর তেল আলাদা হয়ে ওপরে ভেসে থাকে। অপর একটি পাইপ দিয়ে অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়া হয়। প্ল্যান্টটিতে জ্বাল দেওয়া শেষ হলে ওই পিপা থেকে সংগ্রহ করা হয় আতর। 

গাছ থেকে সংগৃহীত আগর কাঠ

আমরা হেঁটে আতর তৈরির পুরো প্রক্রিয়া দেখলাম। এরপর আমরা বের হলাম পদব্রজে গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য। চলতি পথে চোখে পড়লো গ্রামীণ রাস্তার দুপাশে সারি সারি আগরগাছ। সচ্ছলতার ছাপ রয়েছে ঘরবাড়ির চেহারায়। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই গড়ে উঠেছে কারখানা। বাড়ির উঠানের এক পাশে ফালি করে কাটা হচ্ছে আগরগাছ, আরেক পাশে চলছে কাটা টুকরো থেকে পেরেক খোলার কাজ। ঘরের বারান্দায় বসে নারীরা গাছের ফালি কেটে ছোট টুকরো করছেন। কারখানায় শ্রমিকরা সারি বাঁধা ডেকচিতে আগর জ্বাল দিচ্ছেন। দেখতে দেখতে সময় আমাদের জানিয়ে দিলো এবার বিদায় নেবার পালা। 

কীভাবে যাবেন

মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নে যেতে পারেন বাসে বা ট্রেনে। বাস সরাসরি ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে ছাড়ে। রূপসী বাংলা ও শ্যামলী পরিবহন আপনাকে নিয়ে যাবে বড়লেখা। বাস আছে এসি এবং নন এসি। ট্রেন যায় উপবন ও জয়ন্তিকা। ট্রেন থেকে নামতে হবে কুলাউড়া ষ্টেশনে। সেখান থেকে বাসে বা প্রাইভেট গাড়িতে যেতে পারেন বড়লেখা। সময় লাগবে এক ঘণ্টা। বড়লেখা সদর থেকে সুজানগর যেতে পারেন টেক্সি, টেম্পো ও নিজস্ব গাড়িতে।