ঋতু বৈচিত্র্যের পরিক্রমায় এখন বাংলাদেশে বর্ষার ভরা মৌসুম। ভারী বর্ষণে নদ-নদীতে থই থই জলের উচ্ছ্বলতা। বর্ষায় গ্রামবাংলায় নদী বা খাল-বিলের বুকে বিচরণের জন্য দারুণ কার্যকরী বাহন হলো নৌকা।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ঐতিহ্য রামচন্দ্রপুর বাজারে শত বছরের পুরানো নৌকার হাটে কোষা নৌকা বিক্রির ধুম পড়েছে। দেশে পর্যাপ্ত রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট তৈরি হওয়ায় এখন আর আগের মতো ডিঙি, ডোঙা, সাম্পান, বজরা, গয়না, বাইচ, বাতনাই, বাচারি, ময়ূরপঙ্খী, বালার, পানসি, পাতাম, একমালাই, মলার, ইলশা বা সওদাগরী নৌকা চোখে পড়ে না। বড় বড় পণ্যবাহী নৌকাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে শতবর্ষী রামচন্দ্রাপুর কোষা নৌকার হাট।
এই হাটে নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজার, নরসংদীর মাধবদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, কুমিল্লার হোমনা, তিতাস ও মুরাদনগর উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এই হাটে আসেন নৌকা কেনা বেচা করতে। খাল বিলে পানি যত বাড়ে, একই সাথে পাল্লা দিয়ে কদর বাড়ে ছোট কোষা নৌকার।
বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) রামচন্দ্রপুর বাজারে নৌকার হাটে গিয়ে সাজিয়ে রাখা নানা ঢংয়ের ছোট নৌকার দেখা পাওয়া গেল। সারিবদ্ধ শত শত কোষা নৌকার সারি যে কারো দৃষ্টি কাড়বে। ক্রেতাদের ভিড়ে জমে উঠেছে হাট। এখানে সাধ্যের মধ্যে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য পাওয়া যাচ্ছে নানা মাপের নৌকা। নৌকার কারিগররা নৌকা প্রস্তুত করে রাখেন। প্রতি হাটেই নিয়ে আসেন বেচা-বিক্রির আশায়। ভাটি অঞ্চলের মানুষ রামচন্দ্রপুর বাজার ও ডুমুরিয়া হাট থেকে নৌকা কিনে নিয়ে যান।
কৈজুরি গ্রামের নৌকার কারিগর রামপ্রসাদ সরকার ও বিক্রেতা বিমল সরকার বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে একেকজন কারিগর ১০ থেকে ১২টি করে নৌকা নিয়ে হাটে আসি। বর্তমানে কাঠ, লোহা ও অন্যান্য সাঞ্জামের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরিতে খরচ বেড়েছে। আমরা জামরুল, রেইনট্রি, আম, কদম ও শিমুল কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করি।’
নবীনগর উপজেলা রতনপুর ইউনিয়নের বাজে বিশাড়া গ্রাম থেকে নৌকা কিনতে এসেছেন মাহমুদুর রহমান সুমন। তিনি বলেন, ‘আমার মাছের প্রজেক্ট আছে। আমাদের গ্রামটি ছোট। খুবই নিচু এলাকা। সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যায়। বর্ষার সময় একমাত্র বাহন হচ্ছে নৌকা। তাই নৌকা কিনতে এলাম।’
নৌকা ঘাটের ইজারাদার মুশিদ মিয়া বলেন, ‘এই হাটে হাতে বাওয়া নৌকা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে ইঞ্জিনচালিত নৌকাও। ছোট নৌকা ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা, মাঝারি নৌকা ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং বড় নৌকা ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। তবে এখানে নামেমাত্র নৌকার ট্যাক্স নেওয়া হয়।’
আমিননগর গ্রামের ইউপি সদস্য মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বছরে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত এই অঞ্চলে কোষা নৌকার সবচেয়ে বড় হাট বসে। বর্ষার এই সময়ে রামচন্দ্রপুর নৌকার হাটে ভিড় লেগেই থাকে। নৌকার কারিগররা দিন-রাত নৌকা তৈরি করেন। এখন তাদের ব্যস্ত সময়। আয়ের সময়।’
রামচন্দ্রপুর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি মো. জীবন মিয়া মেম্বার বলেন, ‘রামচন্দ্রপুর বাজারের নৌকা বিক্রির প্রচলন শত বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। প্রতি মঙ্গলবার হাট বসে। বিভিন্ন জেলা থেকে নৌকা ক্রেতারা আসেন এই হাটে।’
রামচন্দ্রপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইকবাল হোসেন সরকার বলেন, ‘বর্ষার শুরু থেকেই আশপাশের উপজেলার সবকয়টি ইউনিয়নের লোকজন রামচন্দ্রপুর বাজারে নৌকা কিনতে আসেন। প্রতি মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০০ থেকে ৩০০টি নৌকা বেচাকেনা হয়। এঞ্চলের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের নৌকা পাওয়া যায়।’
মুরাদনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ড. আহসানুল আলম সরকার কিশোর বলেন, ‘তিতাস নদীর পাড়ে রামচন্দ্রপুর বাজারটি আমার ইউনিয়নে পড়েছে। রামচন্দ্রপুর বাজার নৌকা হাটটি কুমিল্লা জেলা ঐতিহ্যর সঙ্গে মিশে আছে। মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা জল ও স্থল পথে রয়েছে। ঐতিহাসিক রামচন্দ্রপুর বাজার সাপ্তাহিক হাটের সুনাম রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, নরসংদী, বাবুর হাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জুড়ে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাটে নৌকা কিনতে আসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।’
দিনদিন নদ-নদী মরে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে খাল-বিল। এখন বাণিজ্য বা দূরের ভ্রমণে নৌকার চলও আর নেই বললেই চলে। তাই উপযোগীতা হারিয়ে ধুঁকছে আবহমান বাংলার এই অতি আদরের, অতি প্রয়োজনীয়, অতি আপনজনের মতো নৌ শিল্প। এই শিল্পের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পীরাও। পেশা হিসেবে তারা বেছে নিচ্ছেন অন্য কোনো পন্থা। এ শিল্প এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বাঁচাতে আমাদের সবাইকে চেষ্টা করতে হবে।