বিগত কয়েক বছরে বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এতে জড়িত ছিলেন খোদ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কর্মকর্তারা। প্রশ্নফাঁস চক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির এবং পিএসসির কর্মচারী ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম। কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভেতরেও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বের করতেন তারা।
জানা গেছে, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ও পুলিশের হাতে গ্রেপ্তাকৃরত সৈয়দ আবেদ আলী জড়িত ছিলেন নগদ লেনদেন ও চাকরি প্রার্থী সংগ্রহের কাজে।
সিআইডি জানায়, গত ৬ জুলাই নিয়মিত সাইবার মনিটরিং করার সময় গোপন সংবাদে সিআইডি জানতে পারে, ১৭ আসামি ও পলাতক আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৫০/৬০ জন আসামি গত ৫ জুলাই পিএসসি কর্তৃক আয়োজিত রেলওয়ের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের (নন ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের আগে একদল নিয়োগ পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করে। পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই এই চক্রের সদস্যরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন। গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন তারা। চক্রের সদস্যরা ওই পরীক্ষার আগের রাতে তাদের চুক্তি করা শিক্ষার্থীদের বাসায় রেখে প্রশ্নপত্র ও তার উত্তর দিয়ে দেন। তদন্তে এখন পর্যন্ত আরও অনেকের নাম সামনে এসেছে। হাইপ্রোফাইল কিছু নামও পাওয়া গেছে।
সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)
গোপন সংবাদ ও প্রযুক্তির সহায়তায় রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল, বসুন্ধরাসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানের তথ্য পায় সিআইডি। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে একাধিক দল নিয়ে অভিযান পরিচালনা করে সিআইডি। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় প্রথমে লিটন সরকারকে রাজধানীর শ্যামলী এলাকা থেকে গত ৭ জুলাই রাতে আটক করা হয়। লিটন সিআইডিকে জানিয়েছে, তার সহযোগী প্রিয়নাথ ও জাহিদের কাছ থেকে তিনি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পেতেন। প্রশ্ন ও উত্তরের বিনিময়ে গ্রেপ্তার লিটন অভিযুক্ত প্রিয়নাথ ও জাহিদকে নিদিষ্ট হারে অর্থ দিতেন। মহাখালীর এসকেএস টাওয়ারের ফুড ভিলা হোটেল থেকে প্রিয়নাথ রায়কে ওই রাতেই আটক করা হয়। প্রিয়নাথ জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তিনি অভিযুক্ত জাহিদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পেতেন। প্রশ্ন ও উত্তরের বিনিময়ে তিনিও নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা জাহিদুল ইসলামকে দিতেন। প্রিয়নাথ রায়কে আটকের পর ওই রাতেই জাহিদুল ইসলামকে শ্যামলী এলাকা থেকে আটক করে সিআইডি।
অভিযুক্ত জাহিদ জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, রংপুর জেলার জনৈক সুমনের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র জোগাড় করতেন তিনি। জাহিদ নিজে যে পরিমাণ টাকা গ্রহণ করতো তার একটা বড় অংশ সুমনকে দিতো। এরপর চক্রের সক্রিয় সদস্য নোমান সিদ্দীকীকে রাজধানীর মিরপুর-১০ এলাকার নিজ ফ্ল্যাট থেকে আটক করা হয়। প্রশ্নফাঁসে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন সুমন। তার প্রাথমিক স্বীকারোক্তিতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আটক করা হয় পিএসসির উপ-পরিচালক (সিলেট) জাহাঙ্গীর আলমকে। এরপর পর্যায়ক্রমে শাহাদাত হোসেনকে মিরপুর থেকে, শেরেবাংলা নগর এলাকা থেকে মামুন ও নিয়ামুলকে আটক করা হয়। নিয়ামুলই প্রথম জিজ্ঞাসাবাদে জানান, প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের অন্যতম সক্রিয় সদস্য পিএসসির কর্মচারী ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান।
যেভাবে আসে আবেদ আলীর নাম: সিআইডির কাছে গ্রেপ্তারকৃত সাজেদুলের বক্তব্যে ওঠে আসে, চক্রের হোতা হিসেবে পিএসসি সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর নাম। সাজেদুল আরও জানান, সহযোগীদের মাধ্যমে চাকরি প্রত্যাশীদের সংগ্রহ করার পাশাপাশি নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে চক্রের অন্যতম সদস্য সৈয়দ আবেদ আলীর কাছে রেলওয়ের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন এবং উত্তর বিতরণ করা হয়। সাজেদুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাখাওয়াত হোসেন ও সাইম হোসেনকে সাজেদুলের বর্তমান বাসা থেকে ও সৈয়দ আবেদ আলীকে রাজধানীর মধ্য পশ্চিম শেওড়াপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে আটক করা হয়। একইসঙ্গে আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামকে জড়িত থাকার তথ্য পেয়ে আটক করে সিআইডি। সৈয়দ আবেদ আলীর বক্তব্যে ওঠে আসে, আবু সোলেমান মো. সোহেল রেলওয়ের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ পরীক্ষার জন্য প্রার্থী সরবরাহ করেছে। আর এজন্য আবেদ আলী নিজেই বুথ পরিচালনা করে। পরে সোহেলকেও আটক করা হয়।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, মামলায় এখন পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাবেক পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ৭ জন দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যাচাই-বাছাই চলছে।
পিএসসির ৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৭ আসামিকে মঙ্গলবার আদালতে নেওয়া হয়
গ্রেপ্তারকৃতদের পরিচয় ও পেশা: মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে সৈয়দ আবেদ আলীকে। তার পেশা রেন্ট এ কারের। তবে তিনি দীর্ঘদিন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মামলায় দুই নম্বর আসামি নোমান সিদ্দিক। লক্ষ্মীপুর রামগতিরের বাসিন্দা নোমান থাকতেন রাজধানীর মিরপুর-১০ সেনপাড়া পর্বতা এলাকায়। তার পেশা পোশাক কারখানার শ্রমিক। তিন নম্বর আসামি খলিলুর রহমান (৩৮)। তিনি পিএসসির ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান। ৪ নম্বর আসামি মো. সাজেদুল ইসলাম (৪১)। রিনি পিএসসির অফিস সহায়ক। ৫ নম্বর আসামি মিরপুর ইসিবি চত্বরের ডেভেলপার ব্যবসায়ী আবু সোলেমান মো. সোহেল। ৬ নম্বর আসামি পিএসসির উপ-পরিচালক (সিলেট) জাহাঙ্গীর আলম, পিএসসির সহকারী পরিচালক এসএম আলমগীর কবীর, গাজীপুর সেনানিবাসের অডিটর প্রিয়নাথ রায়, মিরপুরের জাহিদুল ইসলাম, পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর।
বাকি আসামিরা হলেন-নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিক্যাল টেকনিসিয়ান মো. নিয়ামুল হাসান, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন ও ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিটন সরকার এবং সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম।
এখনও পলাতক যারা: পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, শরীফুল ইসলাম ভূইয়া, দীপক বনিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, এ কে এম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ।
চক্রের সন্ধান: গ্রেপ্তারকৃত খলিল গত ৫ জুলাই বাংলাদেশ রেলওয়ের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের (নন ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দীর্ঘদিন ধরে ফাঁস করে আসছিলেন। এমন তথ্যের ভিত্তিতে মিরপুর পীরেরবাগে অভিযান চালিয়ে খলিলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। খলিল জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তাকে এসব পরীক্ষার জন্য প্রার্থী সরবরাহ করতো পিএসসির সহকারী পরিচালক আলমগীর। আলমগীর রেলওয়ের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের (নন ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দীর্ঘদিন ধরে ফাঁস করেছেন।
মিরপুর এলাকার সরকারি আবাসন থেকে ৮ জুলাই ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আলমগীরকে আটক করা হয়। তার কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাইয়ে চক্রের অন্যতম হোতা পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলামের নাম ওঠে আসে। এরপর সাজেদুল ইসলামকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডিকে সে জানান, বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করতেন পিএসসির উপ-পরিচালক আবু জাফর। তার মাধ্যমে ফাঁসকৃত প্রশ্ন সংগ্রহ করতেন তিনি। এরপর সহযোগী সাখাওয়াত ও সিদ্ধেশ্বরী কলজের শিক্ষার্থী সাইম হোসেনের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করে ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় ভাড়া করা বাসা বা হোটেলে চাকরি প্রার্থীদের জড়ো করতো সাজেদুল।
নিয়োগ পরীক্ষার এক-দুদিন আগে পরীক্ষার্থীদের মাঝে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করতেন সাজেদুল। একই কায়দায় গত ৫ জুলাই পিএসসি কর্তৃক আয়োজিত রেলওয়ের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ পরীক্ষার জন্য নিয়ামুল পল্টন এবং খিলগাঁও এলাকার ভাড়া বাসায় নিয়ে প্রার্থীদের ডেকে পড়ানো ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। রেলওয়ের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের আগেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং বিতরণ কাজে জড়িত ছিলেন পলাতক ১৪ আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৫০/৬০ জন।
প্রশ্নফাঁসে পিএসসির অভিযুক্ত উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর, জাফর ও সহকারী পরিচালক আলমগীর নিজেরা প্রশ্ন ফাঁস করতেন। এরপর সাজেদুল, খলিলদের মাধ্যমে প্রার্থী সরবরাহ করে ফাঁসকৃত প্রশ্ন সরবরাহ করা হতো।
এদিকে, সোমবার (৮ জুলাই) রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় সরকারি কর্ম কমিশন আইনে মামলা করেন সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) নিপ্পন চন্দ্র চন্দ। ওই মামলায় ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৫০/৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত ১৭ আসামিকে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) আদালতে সোপর্দ করা হয়।