শিল্প ও সাহিত্য

রোদে ভিজে বাড়ি ফিরলেন মাকিদ হায়দার

জাতীয়তাবাদের ঢেউ দেখতে কেমন— একটু আলাপ তোলা যাক। সামরিক শাসন দিয়ে ১৯৫৮ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করলেন জেনারেল আইয়ুব খান। আইয়ুব শাহীর শাসন পূর্ব পাকিস্তানে অতটা সমর্থন পায়নি; সে তো স্বাভাবিক। সঙ্গত কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে আইয়ুববিরোধী মনোভাব জারি হয়। আইয়ুব খানই তখন এক কথায় পশ্চিম পাকিস্তান। আর সাড়ে বারোশো মাইল দূরে ভৌগলিকভাবে শতভাগ বিচ্ছিন্ন একটি জনপদ পূর্ব পাকিস্তান। দুই পাকিস্তানের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শাসন, শোষণ ও বৈষম্যের প্রশ্ন। 

তো যে কথা বলছিলাম— জাতীয়তাবাদের ঢেউ; সেই অবস্থায় এক দেশ হলেও পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ বা পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মনের জাতীয়তাবাদ বলতে যা বোঝায়, সেই জাতীয়তাবাদের ধাক্কা আঘাত করে পূর্ব পাকিস্তানকে। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে যা জাতীয়তাবাদ, পূর্ব পাকিস্তানের কাছে তা আগ্রাসন বটে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনের স্বাধিকার ভাবনা বা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মানসিক গঠনে যা জাতীয়তাবাদ হিসেবে প্রতিভাত তখন, পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে তা এক ধরনের বিচ্ছিনতাবাদের লক্ষণ। কিন্তু আলাপ তো আমি জাতীয়বাদ নিয়ে করতে বসিনি! আলাপ হবে একজন কবি ও কবিতা নিয়ে; কবির সময়কে নিয়ে। ১৯৬১-তে পূর্ব পাকিস্তানে বা সামগ্রিক অর্থে উভয় পাকিস্তানেই সরকারিভাবে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া চলবে না, বাজানো চলবে না, রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ্যতে থাকবে না। কারণ কী? রবীন্দ্রনাথ হিন্দু, কলকাতার জমিদার, কবি এবং ভারতীয়। 

১৯৪৭ এ দেশ ভাগের পর অলরেডি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ একটা হয়ে গেছে, সীমান্তে ঠোকাঠুকি চরমে। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের দ্বন্দ্ব দ্বৈরথ চলছেই। বিশেষ করে কাশ্মীর ভাগাভাগির ইস্যুটি তখনও অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং দগদগে অবস্থায় আছে। এখন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ডিক্রি জারি করলেও এবং তা পশ্চিম পাকিস্তানে কার্যকর করা সম্ভব হলেও, পূর্ব পাকিস্তানে অবশ্যই অসম্ভব। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা বাংলা। ঢাকায় ভাষা আন্দোলন বলেও একটা ইতিহাস তখন দাঁড়িয়ে গেছে পৃথিবীর ইতিহাসে। অতএব পূর্ব পাকিস্তানের তরুণেরা ১৯৬১ তে আইয়ুব খান সরকারের রবীন্দ্রবিরোধী ডিক্রিকে মোকাবিলা করতে চাইল। নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করতে চাওয়ার ইচ্ছার মধ্যে সুপ্ত জাতীয়তাবাদ লুকিয়ে ছিল। এ কারণে দেখা যায় ১৯৬১ তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছেন এমন সব ছাত্রছাত্রী, ভিন্ন সময় হলে তারা হয়তো পড়তেন ফার্মেসি, ক্যামেস্ট্রি, অর্থনীতি, ইংরেজি বিভাগে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী প্ররোচনায় যিনি উচ্চতর অর্থনৈতিক চাকরির সম্ভাবনার সাবজেক্ট হিসেবে ইংরেজি বা বাণিজ্য বিভাগের কোনো সাবজেক্টে পড়তেন, তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিবাদস্বরূপ পড়ছেন বাংলা বিভাগে। প্রতিবাদ থেকেই কিন্তু তখন ছায়ানটের জন্ম। কিন্তু  এই আসরে কথা বলার কথা একজন কবি ও কবিতাকে নিয়ে, আমি তাঁর কাছে ফিরে যাই। 

গত শতাব্দীর ষাটের দশকের এই রকম বাঙালি জাতীয়তাবাদমুখোর হাওয়ায় প্রচুর বাংলা কবিতার ওড়াওড়ি ছিল এবং প্রচুর সৃষ্টিশীল তরুণ তখন কবিতাও লিখতে আসেন সাজাত্যবোধে। কবি মাকিদ হায়দার সে হাওয়াতেই বেড়ে ওঠা একজন তরুণ কবি। যাদের তারুণ্যের দোলায় দশকের শেষে একটি যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয় বাঙালিদের এবং অনেক ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশ। সেসব এসেছে মাকিদ হায়দারের কবিতায়। 

তবে জাতীয়তাবাদও যে ঘাড়ে চেপে বসা ভয়ঙ্কর ভূত হয়ে উঠতে পারে, তা দেখছে স্বাধীন বাংলাদেশের তরুণেরা। অতএব মুক্তি জাতীয়তবাদেও নেই! 

কথা হচ্ছে কার মুক্তি নিয়ে, কাদের মুক্তি নিয়ে। কবিই-বা তাঁর কবিতায় চাওয়া-পাওয়ার নিরীখে হাজির রাখছেন কোন শ্রেণিকে? কবি কি বসন্তের দিনে কুড়িল বস্তির উঠতি কিশোরীর প্রেমানুভূতিকে ক্যাপচার করছেন, নাকি মধ্যবিত্তদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিশোরী-যুবতীদের দিকেই কলম চষে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে চাইছেন নিম্ন মধ্যবিত্তের ছাতার নিচে বাস করা বাঙালি তরুণ কবি। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ বাংলা কবিতায় প্রবেশ করেছে বটে কিন্তু শ্রেণি বৈষম্য সেভাবে জায়গা পায়নি। নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় কবিরাও জীবন যাপনে শ্রেণি বৈষম্যকে আত্মস্থ করতে থাকে। এসব বিষয়ে কথা বলব পরে। কিন্তু কথা এখন শুধু কবি মাকিদ হায়দারকে নিয়ে, বলব দু’এক পশলা স্মৃতি। বাংলাদেশে এক মায়ের পেটের পাঁচ সন্তানই কবি ও সাহিত্যিক— এমন ঘটনা খুব সচরাচর নয়। জিয়া হায়দার নাট্যকার, নাট্যসংগঠক। রশীদ হায়দার কথাসাহিত্যিক। মাকিদ হায়দার কবি। দাউদ হায়দার কবি। জাহিদ হায়দার কবি। দু’দিন আগেই মাকিদ ভাই চিরকালের জন্য চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, এটি বাংলা সাহিত্যের জন্যও শোকসংবাদ বটে। সমালোচকরা হয়তো লিখবেন— মাকিদ হায়দার ষাটের দশকের, মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পুষ্ট কবি। 

স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের কবিতার একজন নিবিড় পাঠক হিসেবে আমি মাকিদ হায়দারকে নৈকট্যে পেয়েছি নিবিড়ভাবেই। অগ্রজ মাকিদ হায়দার আমাকে ডাকতেন ‘তুই’ সম্বোধন করে। দেখা হলেই বলতেন, ‘ওই পত্রিকায় তোর ওই লেখাটায় তুই স্ট্রাকচার নিয়ে ভাঙাভাঙি করিছিস, খেয়াল করলাম।’ 

হয়তো মাকিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশি দেখা হয়েছে বইমেলায়, বাংলা একাডেমিতে, শাহবাগ, আজিজ মার্কেট-কনকর্ডে। কবি মাকিদ হায়দারের সঙ্গে আমার সাহিত্যসূত্রে আড্ডা হয়েছে পাঁচতারকা হোটেলে যেমন, আড্ডা হয়েছে ঢাকা ক্লাবে বা বিদেশী দূতাবাসের সাংস্কৃতিক আসরে কবিতা পাঠেও। একেবারেই হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুূষ তিনি। কিছুটা পাবনার কলোক্যাল ল্যাঙ্গুুয়েজেই তিনি কথা বলতেন আমার সঙ্গে। কারণ, মাকিদ ভাই জানতেন আমার বাড়ি ঝিনাইদহ। অত্যন্ত আন্তরিক ও দরদমাখা সম্পর্ক নিয়ে তিনি কথা বলতেন তরুণ কবিদের সঙ্গে। বছরে একবার বা দু’বার দেখা হলেও যেভাবে কথা বলতেন, মনে হতো যেন সারাবছর প্রতিদিনই আমাদের কথা হচ্ছে। 

কবিতাই বাঁচিয়ে রাখে কবিকে। সেক্ষেত্রে পাঠকই হচ্ছেন কবিতার প্রাণ। প্রাণে প্রাণ মিলে যায়। কবি লাভ করেন অমরত্ব। কবি মরে গেলেও কবিতারা বেঁচে থাকে। কবি মাকিদ হায়দারের প্রয়াণের পর তাঁর সাথে কমবেশি তিন দশকের স্মৃতি ঝাপটানি দিচ্ছে আমার মস্তিষ্কে। 

একবার বেঙ্গল সাহিত্য উৎসবে আমরা সিলেটে গিয়েছিলাম। দু’দিন, দু’রাত ছিলাম সুরমার পাড়ে। হঠাৎ মধ্যরাতে মাকিদ ভাই বললেন, ‘কিরে ঢুলুঢুলু করছিস কেন?’  ‘নেশা হয়ে গেছে খুব বেশি।’ ‘কী খাইছিস যে নেশা হয়ে গেল?’ ‘সুরমার জল।’ ‘সুরমার নদীর জলে নেশা হয়?’  ‘হয়।’

হয়তো আমরা সুরমা নদীর পাড়ে সে রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। নদীজল কলকল করে বয়ে যাচ্ছিল। নদীজলই বাংলা কবিতা- বয়ে চলেছে নিরন্তর। বারবার বাঁক বদল করতে ভালোবাসে। বাঁক বদলের স্মৃতি আমাদের কারই-বা নেই? কোন নারী কোন  প্রেমিকের সামনে নিজের বাঁক বদল ঘটিয়ে প্রমাণ করেনি, সে নদী? আলোচনা অন্যদিকে যাচ্ছে। কবিতার বাঁক বদলের নাম করে আমি নারীর বাঁক বদলের কাহিনী বলার একটা সুযোগ নিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু হুঁশ ফিরল, ওদিকে গেলাম না। একটু বরেন্দ্র অঞ্চলে যাওয়া যাক।  

রাজশাহী সার্কিট হাউসে মাঝরাতে আড্ডা জমে গেল। ওখানকার বিভাগীয় কমিশনার তখন কবি আসাদ মান্নান। কমিশনারের আমন্ত্রণেই পদ্মার তীরে কবিতা পড়তে যাওয়া। ২০১২ সালের সে রাতে রাজশাহীর সার্কিট হাউসের কয়েকটি রুমে ঢাকা থেকে যাওয়া কবিদের দলে ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক; এখন তিনি নেই। ছিলেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। ছিলেন কবি হায়াৎ সাইফ। হায়াৎ সাইফের সঙ্গে ঢাকায় আমার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি। রাজশাহী থেকে ফেরার পরও হায়াৎ সাইফের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। কারণ তার কিছুদিন পরই তিনি প্রয়াত হন। ওখানে ছিলেন কবি ফারুক মাহমুদ, বিমল গুহ, নাসির আহমেদ, শিহাব সরকার; ছিলেন কবি অসীম সাহা ও মাকিদ হায়দার। ক’দিন আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন কবি অসীম সাহা— কী প্রাণবন্ত একজন মানুষ, শুশ্রুমণ্ডিত সৌম্যকান্তি মুখ ও তারুণ্যে ভরা মন তাঁর। অধ্যাপকদের ভাষায় অসীম সাহা গত শতাব্দীর লেইট সিক্সটিজে আবির্ভূত কবি। অসীমদার জন্য চিরকালের শ্রদ্ধা রইল আমার। 

রাজশাহী সার্কিট হাউসে অসীমদা মাঝরাতে আসন গেড়ে প্রাণায়ামে বসলেন, সে অবস্থায় আমি কিছু ছবি তুললাম। মাকিদ ভাইয়ের সঙ্গে জমে গেল তুমুল আড্ডা। মাকিদ ভাই তো আড্ডারই মানুষ, আবার আমার সাথেও তাঁর জমত ভালো। ‘সমকাল’ পত্রিকার ‘কালের খেয়া’তে তিনি একটি কবিতা উৎসর্গ করেছেন আমাকে; নিজে ফোন করে শোনালেন একদিন। 

হঠাৎ হঠাৎ ভোরবেলা যখন আমি সারারাত না-ঘুমিয়ে ঘুমের দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি, ফোনে সেই ঘুুম ভাঙাতেন মাকিদ ভাই।  ফোন করেই বলতেন, ‘কিরে ঘুমাচ্ছিস?’  আমি হয়তো ঘুম ভাঙা কণ্ঠেই উত্তর দিলাম, ‘জি মাকিদ ভাই।’ ‘আজকে প্রথম আলোতে যে কবিতাটা ছাপা হইছে, পড়ছিস?’ ‘মাকিদ ভাই, আমি তো ঘুম থেকেই উঠিনি, কী করে দেখব?’ ‘ওঠ ওঠ, পড়, কবিতাটা ভালো হইছে।’

আমার হয়তো-বা বিরক্তও লাগে কিছুটা তখন। কারণ এইভাবে ঘুম থেকে ফোন করে ডেকে উঠিয়ে কেউ কাউকে কবিতা পড়ায়? কিন্তু মাকিদ ভাই তো অগ্রজ, অগ্রজের ওপরে বিরক্তি প্রকাশ করা নাজায়েজ। কারণ, একদিন আমিও অগ্রজ হলো। এটাই ধর্ম। তাই সেই ঘুম ঘুম ভোরে ফোনের অপরপ্রান্তে আমার সঙ্গে কথোপকথনকারী কবি মাকিদ হায়দারকে হয়তো জিজ্ঞাসা করি, ‘কার কবিতা?’ ‘তোর কবিতা।’ মাকিদ ভাই উত্তর দেন। আমি আর কী বলব? ফোন রেখে অসমাপ্ত ঘুম সমাপ্ত করতে পাশ ফিরে কোল বালিশ পুনরায় জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলি, ‘আই লাভ ইউ।’  আর কোনোদিন মাকিদ ভাইয়ের কাছ থেকে ফোন আসবে না আমার নাম্বারে। সালাম, মাকিদ ভাই, আপনাকে সালাম।