মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী দিঘীরপাড় বাজারের পাশ দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত চার দিন ধরে শুরু হয়েছে ভাঙন। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) একদিনে বাজারটির ৯টি দোকান নদীতে বিলীন হয়েছে। দুটি দোকানের আংশিক অংশ ভেঙে গেছে। এছাড়া, হুমকির মুখে রয়েছে আরো ১০টি দোকান।
স্থানীয় লোকজন ও ব্যবসায়ীরা জানান, ভাঙন বন্ধ করতে ব্লক দিয়ে স্থায়ী বেড়িবাঁধের প্রকল্প হাতে নেয় প্রশাসন। চলতি বছরে বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, এখনো বাঁধের দৃশ্যমান কোনো কাজ শুরু হয়নি।
শুক্রবার (১২ জুলাই ) সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে পদ্মা নদীতে তীব্র স্রোত বইছে। ঘূর্ণি স্রোতে ২০০ বছরের পুরাতন দীঘিরপাড় বাজারের কামারপট্টি এলাকার নদীর পাড়ে ফোলানো বালুর বস্তা ধসে ভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে পুরো বাজারটি ঝুঁকিতে পড়েছে। বাজার ঘাটের পশ্চিম পাশ থেকে পূর্ব দিকের ১০০ মিটার এলাকায় ভাঙন চলছে, যা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভাঙনের কারণে কামারপট্টি ও তার পাশের কিছু দোকানের সমস্ত মালামাল সরিয়ে নিতে দেখা গেছে ব্যবসায়ীদের। আজ সকালে বৃষ্টি হওয়ায় দোকান সরাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে তাদের।
স্থানীয় লোকজন ও বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে টঙ্গীবাড়ী উপজেলার দিঘীরপাড় ইউনিয়ন এবং পাশের কামারখাড়া, হাসাইল ও পাঁচগাও ইউনিয়নে নদী ভাঙন চলছে। গত ৫ বছরে ভাঙনে দিঘীরপাড় ইউনিয়নের দক্ষিণ মূলচর, মিতারা, কান্দাপাড়া, হাইয়ারপারের কয়েক শ’ বাড়িঘর, মসজিদ, আবাদি জমি ও কবরস্থান বিলীন হয়েছে। এ সময়ে দীঘিরপাড় বাজারটিরও অন্তত ২০০ মিটার বিলীন হয়েছে। তিন বছর আগেও ভাঙন তীব্র ছিল। সে সময় বাজারের পাশ দিয়ে জিও ব্যাগ ফেলা হয়। এরপর ভাঙন বন্ধ করতে ব্লক দিয়ে স্থায়ী বেড়িবাঁধের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। চলতি বছরে বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো বাঁধের দৃশ্যমান কোনো কাজ শুরু হয়নি।
গত ১৫ দিন ধরে মুন্সীগঞ্জ ও তার আশেপাশের এলাকায় বর্ষার পানি বেড়েই চলছে। নদীতেও তীব্র স্রোত বইছে। ফলে দিঘীরপাড় বাজারের পাশে ফেলা জিও ব্যাগ সরে গিয়ে কামারপট্টি এলাকার যোগেশ মণ্ডল, গৌতম মণ্ডল, দিলিপ মণ্ডল, অনিল মণ্ডল, কালু মণ্ডল ও সুনীল মণ্ডলদের দোকান নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া, নজির হালদার নামের ব্যবসায়ীর ছয়টি, স্বপন মণ্ডল, আলমেছ ব্যাপারি ও ওলি ব্যপারিদের দুটি দোকানের আংশিক পদ্মা নদীতে বিলীন হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মার ভাঙন রোধে ২০২২ সালের মে মাসে লৌহজং উপজেলার খড়িয়া থেকে টঙ্গিবাড়ীর দীঘিরপাড় বাজার পর্যন্ত পদ্মার বাঁম পাশের তীরের ৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার অংশে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৪৪৬ কোটি টাকা। কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কয়েকটি ভাগে এ বাঁধ নির্মাণের কাজ পায়। তাদের মধ্যে সিগমা ইঞ্জিনিয়ারিংকে দীঘিরপাড় অংশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে, এখনো কাজ শেষ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
ব্যবসায়ী স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘শুনতাছি বাঁধ হইবো। কাজও চলতেছে। দুইদিন কাজ করলে ঠিকাদার ১৫ দিন কাজ করে না। তারা যদি ঠিকমতো কাজ করতো তাহলে আমাদের এই অবস্থা হতো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে অবস্থা (ভাঙন) দেখতেছি, তাতে আমরা হুমকির মুখে আছি। যে কোন মুহূর্তে আমাদের দোকান ঘর ভাইঙ্গা যেতে পারে।’
কামার যোগেশ মণ্ডল বলেন, ‘গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর ৫টার দিকে বাজারের মানুষ ফোন দিয়ে বলছে, আপনাদের দোকান ভেঙে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাজারে আসছি। এসে দোকান ঘরটি কোনো রকম সরাইয়া নিতে পেরেছি। এখন অন্যের দোকানে বসে কাজ করতেছি। বাঁধটা যদি ঠিকমতো দিতো তাহলে আমাদের এই দোকান ভাঙতো না। তারা কাজ করছে গাফিলতি কইরা। তাদের করণে আমাদের আজকে এই অবস্থা।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিগমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপক মোশাওয়ার হোসেন বলেন, ‘ব্লক তৈরির জন্য যে পরিমাণ জায়গা দরকার ছিল, আমরা সময়মতো সেই জায়গা পায়নি। এজন্য কাজ করতে পারিনি। জায়গা ভাড়া নিয়েছি। এখন ব্লক তৈরির কাজ চলছে। আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছি। সে সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করা হবে।’
মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন, ‘বাঁধের কাজের সময় বাড়ানো হয়নি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজের সময় বাড়াতে আবেদন করেছে। এখন বর্ষাকাল, পানি না কমা পর্যন্ত ব্লক ফেলা যাবে না। সে জন্য প্রকল্পের সময় বাড়ানো হতে পারে। ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলার কার্যক্রম চলছে। কিন্তু ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না।’