মতামত

কোটা আন্দোলন নিয়ে কী ভাবছেন বিশিষ্টজনেরা?

দেশে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন করছেন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর আগে ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে কোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছিল। সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ পুনর্বহালের রায় দিয়েছেন আদালত। এরপরেই কোটা সংস্কারের দাবিতে পুনরায় আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যেই আন্দোলনে ৬ জন নিহত হয়েছেন। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। 

দেশের চলমান পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘ছয়জন মানুষের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দুই পক্ষকেই এ জন্য দায় নিতে হবে। বিশেষ করে সরকারের। আমি সরকারের একজন সমর্থক হয়ে বলছি যে, কারও মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়।’

‘আন্দোলনকারীরা যে কিছু ভুল-ত্রুটি করেনি তা নয়। তারা যে স্লোগান দিয়েছে সেটি অত্যন্ত আপত্তিকর। তবে শিক্ষার্থীদের যে সেন্টিমেন্ট সেটা যদি সরকার অনুধাবন করতে পারতো এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতি মনোযোগী হতো তাহলে এতোগুলো তাজা প্রাণ ঝরে যেতো না। এতো সম্পদ নষ্ট হতো না।’ বলেন তিনি। 

এখন কীভাবে এই সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব জানতে চাইলে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘আমার মনে হয় যে এখনও সময় আছে। বিচার বিভাগ যে কথা বলেছে সেটা অনুসরণ করে একটা আলোচনা করে সমঝোতায় পৌঁছানো যায়। আমি মনে করি কোটা সংস্কার হওয়া উচিত। ২০১৮ সাল থেকে আমি সংস্কারের পক্ষে। নারী কোটা, তৃতীয় লিঙ্গ কোটা এবং প্রতিবন্ধী কোটা রাখতে হবে। কিন্তু কতটুকু রাখতে হবে সেটি আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। বাকি রইলো মুক্তিযোদ্ধা কোটা। প্রজন্ম যদি মনে করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে না, তো থাকবে না। কোটা বহাল রাখার জন্য তো এই প্রজন্মের মুখোমুখি দাঁড়াবো না। কিন্তু তারা যখন বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে আপত্তিকর স্লোগান দিয়েছে ‘তুমি কে, আমি কে রাজাকার-রাজাকার’ এই স্লোগান আমরা প্রত্যাশা করি না। একেবারেই না।’

কোটা পদ্ধতি সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রাজাকার’ স্লোগানে মর্মাহত শিক্ষাবিদ ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কার করতে হবে,  একে আমি সমর্থন করি। তবে আন্দোলনের নামে মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করার ব্যাপার কোনোভাবেই সমর্থন করি না।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবি যখন শুরু হলো তখন দেশের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে কোনো মতামত আসা উচিত ছিল কিনা এমন  প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযোদ্ধা ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘অবশ্যই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তথা ‘রাজাকার’ স্লোগান দেওয়ার আগ পর্যন্ত কথা বলার জায়গা ছিল। কিন্তু আমরা বলতে পারিনি। আমি প্রথমে আমার এবং আমাদের দোষ স্বীকার করে নিচ্ছি। নিজেদের প্রশ্ন করা দরকার— মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে স্বকীয়ভাবে থেকেছি। এখন কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুর দিকেই বিষয়টি নিয়ে আমরা যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি তারা কেন কথা বলতে দেরি করলাম? আটের দশকে, ছয়ের দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যখন মানুষের জীবন বিপর্যস্ত তখন আমরা রাস্তায় নেমে মানুষের জন্য ভিক্ষা করেছি, এটি আমাদের ঐতিহ্য। সেখান থেকে আমরা এখন বিবৃতি সর্বস্ব দায়িত্বপালনকারী হয়ে গেলাম! আমার মনে হয় আমাদের যারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে আছেন; মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আছেন তাদের এ বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিত ছিল।’

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কোটা আন্দোলন অন্য দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে উল্লেখ করে পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘যে মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে ‘স্লোগান’ উঠলো তখন আর কিছু বলার নেই। বলার সময় পার হয়ে গেছে।’ 

এই মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, ‘দেশের বেশিরভাগ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। এর বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা, তাদের বংশের লোকজনদের অসম্মান করা, জমিজমা কেড়ে নেওয়া এগুলোও এই দেশে হয়েছে, হচ্ছে। কোটা আন্দোলনও একটি পর্যায়ে একটি ইভেন্টে পরিণত হয়েছে এবং এটি একটি পরিকল্পিত ইভেন্ট- এটা এখন পরিষ্কার।’ 

কোটা আন্দোলন এখন শুধু আন্দোলনে নেই, বিক্ষোভে পরিণত হয়েছে বলে মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন। তিনি বলেন, ‘সবসময় বলছি যে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে সবকিছু নিয়ে আলোচনার জায়গা আছে। আমাদের দেশে যে সমস্যা হয়ে গেছে সেটা হচ্ছে— একটি দল দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আছে। তারা আসলে অন্যের মতামতকে খুব বেশি তোয়াক্কা না করার কারণে আলোচনার জায়গাগুলো বেশি আমলে নেয় না। সে জন্যই আন্দোলনটা এই পর্যায়ে এসেছে। যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখনই সেই আন্দোলনকে বিএনপি, জামায়াতের আন্দোলন বা দাবিদাওয়া হিসেবে আমলে নেওয়া উচিত না। আমি একটি দাবিদাওয়ার সাথে একমত না হতেই পারি, কিন্তু কারও আন্দোলন করার অধিকার হরণ করতে পারি না।’

‘গত দুই দিন ধরে দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এটি তো আর আন্দোলন নেই। এটি রীতিমত বিক্ষোভ। মনে রাখতে হবে, একটি সংগঠন যখন প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা চালায়, তখন তার প্রতিবাদে আরও মানুষ বের হয়ে আসে।’ বলেন জোবাইদা নাসরীন। 

আন্দোলনকারীদের পক্ষে সবকিছু কি সুষ্ঠুভাবে সংগঠিত হয়েছে বা তেমন সুযোগ ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাবি এই শিক্ষক বলেন, ‘একটি গণআন্দোলনে যে সতর্কতা থাকা দরকার সেটি হচ্ছে যে, আন্দোলনের সুযোগ যেন অন্য পক্ষ নিতে না পারে। সেই জায়গা থেকে আমি বলবো যে, আন্দোলনকারীদের আরেকটু সতর্ক থাকা উচিত ছিল। এই আন্দোলনের লিমিটেশন বা সীমাবদ্ধতার জায়গা হচ্ছে ‘রাজাকার’ স্লোগান। যদিও আমি মনে করি না যে শিক্ষার্থীরা ভালোবেসে এই স্লোগান দিয়েছে। তারাও বিষয়টি নিতে পারেনি। নিতে পারেনি বলেই তারা বিষয়টিকে অপরপক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যদিও কোনো স্লোগানকে কেন্দ্র করে কাউকে হামলা করা বৈধতা পায় না। একেবারেই না। এখন পর্যন্ত যে কয়জন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন তাদেরকে হত্যার নিন্দা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।’

‘এই আন্দোলন ফয়সালা হওয়ার পথ নাই, এমনটা বলছি না। এটি নির্ভর করবে সরকারের আন্তরিকতার ওপরে।’ যোগ করেন জোবাইদা নাসরীন।

অভিনয়শিল্পী, প্রযোজক, নির্মাতা এবং নারী নেত্রী রোকেয়া প্রাচী বলেন, ‘সবাই সবার নিজস্ব দাবিদাওয়া উত্থাপন করতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই। একটা প্রজন্ম যারা ভবিষ্যৎয়ে জাতিকে নেতৃত্ব দেবে তাদের আন্দোলনের ভাষা কেমন হওয়া দরকার সেটা আসলে আমাদের ভাবাচ্ছে। যখন তারা নিজেদের ‘রাজাকার’ হিসেবে দাবি করছে সেটা যে কারণেই হোক না কেন, তাকে সঠিক মনে হয় না। প্রজন্ম যে দাবি তুলেছে সেটি নিয়ে আলোচনার জায়গা আছে, বিতর্কের জায়গা আছে এবং শেষ পর্যন্ত বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের বিষয় আছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে।’

মুক্তিযুদ্ধে একদল গিয়েছেন, আরেকদল রাজাকার ছিলেন কিন্তু বিশাল একটি জনগোষ্ঠী ছিলেন যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। যুদ্ধে তারাও নানাভাবে ভুক্তভোগী হয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে ছিলেন। তাদের প্রজন্মকে কি রাজাকারের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রোকেয়া প্রাচী বলেন, ‘‘না। রাজাকার একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী। যারা একাত্তরে পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশের বিপক্ষের একটি অপশক্তির নাম হচ্ছে রাজাকার। শিক্ষার্থীরা নিজেদের কেন রাজাকার বলবে? প্রধানমন্ত্রীকে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল সেখানে দুইটি অপশন ছিল। মুক্তিযোদ্ধা নাকি রাজাকার? সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলেছেন। আর কোটা সংস্কার আন্দোলন তো শুধু মক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে নয়, এখানে আরও অনেক কোটা আছে। তাহলে আন্দোলনকারীরা কেন নিজেদেরকে ‘রাজাকার’ বলবে? কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে দাবিদাওয়া নিয়ে মাঠে নেমেছিল কেন যেন মনে হচ্ছে এটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। আন্দোলনের একটা পর্যায়ে এটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেখানে মনে হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম এই প্রজন্ম’। দেশ অস্থিতিশীল করার এটি একটি চক্রান্ত।’’