শিল্প ও সাহিত্য

শুধু আরেকবার

‘আপনার নাম?’  মিষ্টি হেসে রিসেপশনিস্ট জানতে চায়। টেমপারড গ্লাসের দরজা ঠেলে রিসেপশন এরিয়ায় পা দিলে তার দিকে চোখ পড়ে। মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকের হেড অফিসের ঝকঝকে ওয়েটিং এরিয়াটি সে যেন আরও বেশি আলো করে রেখেছে। টিয়া প্রথমেই তার সামনে দাঁড়ায়। ‘সাফরিন চৌধুরী,’ সামান্য হেসে বলে টিয়া; বলে, ‘একটা এপয়েন্টমেন্ট আছে বারোটায়, হেড অব ক্রেডিট ডিভিশন, মিস্টার হুমায়ূনের সাথে।’ কথার মাঝে টিয়া ঘড়ি দেখে নেয়। এগারোটা বিয়াল্লিশ বাজে। ঠিক সময়ে সব কাজ ঠিকঠাক মতো করাটা তার ক্ষেত্রে পুরোপুরি একটা রোগের মতো। সবখানে সময়ের আগে পৌঁছায়। কোথাও, সে যে কাজই হোক না কেন, সময়মতো পৌঁছাতে না পারলে তার মাথা ঝিমঝিম করে, চিন্তাশক্তি কাজ করে না। এখানে সে এসেছে আরও ভালো একটা চাকরির জন্য। সময়জ্ঞান ভালো বলে এখনকার অফিসের বসেরাও তার উপর সন্তুষ্ট। কোনো প্রজেক্টে সাফরিন চৌধুরী থাকলে তা ডেটলাইন মিট করবে না, এমন হয় না। মাঝে মাঝে নিজের কাজ শেষ হয়ে গেলে কলিগের কাজ, বসের কাজ এমনকী কখনও জুনিয়রের কাজ করারও বাতিক আছে তার। শুধু সময়ের ব্যাপারে নয়, কাজকর্ম, পোষাক, সাজগোজ, কথাবার্তা সবকিছুতেই সে যত্নশীল। একেবারে পারফেকশনিস্ট যাকে বলে। ‘প্লিজ একটু অপেক্ষা করুন। স্যার আপনার কথা বলেছেন। আই উইল টেল হোয়েন হি কলস ব্যাক। রিসেপশনিস্টের এবারের হাসিটা আগের চেয়েও মিষ্টি মনে হয়।’ 

টিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনের ঘননীল সোফার দিকে আগায়। বসতে হবে। অফিসে পারসোনাল কাজের দোহাই দিয়ে এসেছে। প্রায় বছরতিনেক ধরে বড়ো প্রাইভেট ব্যাংকে আছে সে। তার আগেও অবশ্য ছিল অন্য ব্যাংকে। সব মিলিয়ে মোটামুটি আট বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ার তার। ব্রাঞ্চে ক্রেডিটের কাজ করছে। বাসা নিকেতনে আর কাজ করে গুলশান ব্রাঞ্চে।  চাকরির জন্য আজ যে অফিসে এসেছে, এই ব্যাংকের হেড অফিস কারওয়ান বাজারে; সকালের ব্যস্ত রাস্তায় জায়গাটা তার বাসা থেকে বেশ দূরই মনে হবে হয়তো। ওদিকে হেডহান্টিং এজেন্সি থেকে যখন ইন্টারভিউয়ের জন্য ফোন এলো তখন ভাবল, আসা-যাওয়ার সামান্য কষ্টের জন্য এত বড় মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকের অফার ছাড়ার কোনো মানে হয় না। আসিফেরও একই মত। আজ সকালে নাশতা খেতে খেতে আসিফ তাকে তা জানিয়েছিল। টিয়া নিজেও হেড অফিসে কাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।  ব্রাঞ্চে কাজ করে সেরকম ক্যারিয়ার হয় না যেটা হেড অফিসে সহজে হয়ে যায়। ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের জন্য ইন্টারভিউ, তাই পোস্টিং হলে হেড অফিসেই হবে, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। টিয়া চোখ বুলিয়ে নেয় অফিসটাতে। রিসেপশনিস্টের টেবিলের ওপাশে কাঁচের দরজা খুলে মানুষ যায়, আসে। সে সেই ফাঁকে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করে কেমন হতে পারে অফিসের পরিবেশটা। তার প্রাইভেট ব্যাংকের ব্রাঞ্চ অফিসের চেয়ে অনেক বেশি গোছানো। দেখতে দেখতে ভাবে, এখানে চাকরিটা হয়ে গেলে বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এটা খুবই দরকার এখন তার আর আসিফের সংসারে। 

আসিফ একটা লিজিং কোম্পানিতে আছে। দুজনের আয় দিয়ে সংসার ভালোই চলে কিন্তু মাসশেষে সেই এক সমস্যা, হাতে কিছু থাকে না। বাসা ভাড়া দেয়া ছাড়া গাড়ির কিস্তির টাকাও আসিফ দেয়। আর টিয়া দৈনন্দিন খরচ চালায়। তাছাড়া কলিগ আর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে খাওয়া বা সপ্তাহান্তে কখনো তাদেরকে বাসায় ডাকা- এসব দুজনে মিলেই করে। তাতেও কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু দুজনেরই ইচ্ছে কিছুদিনের ভেতরে মোটামুটি ভালো একটা এপার্টমেন্টের বুকিং দেবে। একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির তৈরি করে রাখা অথবা কদিনেই হয়ে যাবে, এমন কিছু এপার্টমেন্ট ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছে তারা। পছন্দও করেছে। তাই টিয়ার এই চাকরিটা হয়ে গেলে তারা দুজন একটা এপার্টমেন্টের লোনের জন্য ব্যাংকে আবেদন করতে পারে। দুজন বলাবলি করে, এই ভাড়া বাড়িতে আর কতদিন থাকবে তারা? এরপর তাদের বাচ্চা হলে, তাকে তো তারা অন্তত নিজের বাসায় মানুষ করবে! তা ছাড়া, আসিফের প্রোমোশনগুলো একেবারে সময়মতো হলে কয়েক বছর পরে সে লিজিং কোম্পানির সবচেয়ে উঁচুতে পৌঁছে যাবে। সমস্যা হলো, তারপর তার ক্যারিয়ার আটকে যাবে। বছর তিন-চারেক পরে সেই পজিশনের মেয়াদ শেষ হলে হয়ত কোম্পানি ছাড়তে হবে। তখন নতুন কোথায় চাকরি জুটবে না-জুটবে, আয়ের অঙ্ক বাড়বে না কমবে- এসবের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তাই আগেভাগেই টিয়াকে তার ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিতে হবে। দুহাতের আঙুল দিয়ে আঙুল চেপে ধরে টিয়া মনে মনে বলতে থাকে, আই হোপ ফর দ্যা বেস্ট ফর মি। তারপর ঘড়ি দেখে, এগারোটা আটান্নো।

২ ঠিক তিন মিনিটের মাথায় ডাক আসে। ফোন রেখে রিসেপশনিস্ট আগের মতোই মিষ্টি হাসিতে তাকে হুমায়ূন সাহেবের রুমে যেতে বলে। টিয়া ’থ্যাংকস’ বলতেই লিফটের দিকে ইশারা করে বলে, সেকেন্ড ফ্লোর, থার্ড রুম অন ইয়োর রাইট।  দেয়াল থেকে দেয়াল পর্যন্ত কার্পেট থাকাতে টিয়ার পেন্সিল হিল কোনো শব্দ তোলে না; স্বস্তি পায় সে। উপর তলায় সরু করিডোরের দুপাশে সারি সারি রুম। নেমপ্লেট দেখতে দেখতে সোজা ডানদিকে এগোতে থাকে। হুমায়ূন সাহেবের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আঙুলের দুটো টোকায় ভেতর থেকে ‘কাম ইন প্লিজ’ শোনা যায়। হুমায়ূন সাহেব প্রশস্ত টেবিলের ওপাশে। দুপাশের চেয়ারে আরও দুজন বসে আছেন। তারা হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টের হতে পারেন। অনেকটা ইন্টারভিউ বোর্ডের মতোই দেখাচ্ছে। যদিও টিয়া এরকমটা আশা করেনি। এ ধরনের ইন্টারভিউগুলো সাধারণত গোপনে হয়। কখনো ছুটির দিনে ফাঁকা অফিসে আবার কখনো কারো বাসায়ও হতে পারে। প্রধান একটি ডিভিশনে ভ্যাকেন্সি আছে, তাই হয়তো তাড়াহুড়ো করে তাকে ডাকা হয়েছে।  ক্রেডিট ডিভিশনের হেড হুমায়ূন সাহেব কথা শুরু করেন।  ‘প্লিজ টেক ইয়োর সিট।’ ‘থ্যাংক ইউ।’ ‘উই হ্যাভ গন থ্রো ইয়োর সি ভি- নাথিং টু টক এ্যাবাউট ইট। হোয়াট প্রোপোজাল ডিড ইউ ওয়ার্ক উইথ লেইটলি?’

টিয়া কিছুদিন আগে একটা ফার্মাসিউটিক্যাল ফ্যাক্টরির একশ কোটি টাকা লোনের প্রপোজাল নিয়ে কাজ করেছিল। সেটার ব্যাপারে বলতে থাকে। বুঝিয়ে বলে যে সেটা ছিল ব্যাংকের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির টার্ম লোন আর প্রজেক্ট ফিন্যান্স দুই-ই দরকার ছিল। তাই টিয়া কেন সেটা ব্যাংকের জন্য লাভজনক মনে করেছিল তার বিস্তারিত জেনে নিতে চান তারা। কী ধরনের  অভিজ্ঞতার কারণে সে ক্লায়েন্টকে লোন দেয়ার উপযুক্ত মনে করেছিল আর পরে প্রপোজালটি ব্যাংকের জন্য আসলেই লাভজনক হয়েছিল কি না, সমস্ত কিছু একে একে বলে যেতে হয় তাকে। তিনজনে মিলে প্রোপোজালের আদ্যোপান্ত জানার পরে বেতন  নিয়ে কথা শুরু করেন। টিয়া সিনিয়র এ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের জন্য যে বেতন উল্লেখ করেছিল তা শুরুতেই না হলেও চার মাসের মাথায় পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে যায়।   কাজের কথা শেষ হলে কিছু ব্যাক্তিগত প্রসঙ্গ এসে পড়ল। বর্তমান ব্যাঙ্কে টিয়ার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না জানতে চান তারা। তারপর সবার শেষে হুমায়ূন সাহেব জানিয়ে দেন, ‘ঠিক আছে, মিস সাফরিন, ইউ মে জয়েন উইদিন থ্রি ডেজ- হোপ টু সি ইউ হিয়ার সুন।’

৩ নিচে নামবার জন্য টিয়া লিফটে ঢোকে। লিফট তিন তলা থেকে নামার আগে দোতলায় দাঁড়ায়। দরজা পুরোপুরি দুদিকে সরে যাওয়ার আগেই টিয়া চমকে ওঠে, কার গলা শুনছে সে? দরজা সরে গেলে দেখে রবিন দাঁড়িয়ে। টিয়া পাথর হয়ে যায়। একই শহরে থাকে অথচ গত তিন বছরে কোথাও দেখা হয়নি। টিয়া কখনো চায়নি দেখা হোক। ওদিকে রবিনও তার দিকে তাকিয়ে লিফটের বাইরে সটান দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে যেন অনন্ত কাল কেটে যাচ্ছে। দরজা দুটো একটি সরলরেখায় মিলে যাবার জন্য আবার যেই উদ্যত, কে যেন লিফট থামিয়ে দেয়, অস্থির ভাবে বলে, ‘রবিন, আরে কী হলো, আসো না!’  দরজা ধেয়ে আসা গতির কাছে রবিন অদৃশ্য হতে হতে আবার পুরো শরীর নিয়ে টিয়ার সামনে ভেসে ওঠে। রবিনও যেন চিন্তার ঘোরে ডুবে লিফটে ঢোকে। টিয়া নড়েচড়ে ওঠে। এবারে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকায় রবিনের দিকে। রবিনও। একটু হেসে বিস্ময় বা ধাক্কা, যাই থাকুক, রেখেঢেকে বলে, ‘টিয়া, তুমি এখানে!’ টিয়াও গলায় ঝরঝরে ভাব এনে বলে, ‘হ্যাঁ, কেমন আছ?’ ‘ভালো, তুমি এখানে কার কাছে?’ ‘এই তো হুমায়ূন সাহেবের কাছে, ক্রেডিট ডিভিশনে।’ ‘ও, ব্যাঙ্ক বদলাচ্ছ? আমি তো এখানে হিউম্যান রিসোর্সে বছরদুয়েক ধরে আছি।’    রবিন যেন তারপরেও কী সব বলে যায়। টিয়া শূন্যদৃষ্টিতে রবিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আসলে কি রবিনের কথা সেভাবে শোনে কিছু? হাতের ইশারায় পাশের লোকটিকে দেখিয়ে রবিন বলে, ‘ইনি পারভেজ হাসান, ক্রেডিট ডিভিশনে আছেন।’টিয়া তার দিকে ‘হ্যালো’ বলতেই তিনি হাসিমুখে বলেন, ‘ওয়েলকাম টু আওয়ার ওয়ার্ল্ড!’ ‘থ্যাঙ্ক ইউ, তবে সেরকম কোনো সিদ্ধান্ত এখনও নেয়া হয়নি। দেখা যাক কী করি।’     

টিয়া এই মুহূর্তে নিজের মধ্যে দু’ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ এদের দুজনের সাথে হেসে হেসে কথা বলে, এমনকি একতলায় যখন বাড়তি মানুষ লিফটে ওঠে তখন পেছনের দিকে সরেও যায়। অন্য ভাগের টিয়ার কানে শুধু বাজে অনেক আগের শোনা রবিনের মুখের কথাগুলো-  ‘টিয়া আজ তুমি আসবে?’ ‘তোমাকে ফোনে পেলাম না কেন বলো তো!’ ‘আজ সকালের চা এত ভালো হল কী করে, টিয়া?’ ‘তোমাকে দেখতে না আজ মারাত্মক লাগছে!’ রবিনের হাসি-রাগ, শেষের দিনগুলোর বিরক্তি, তাচ্ছিল্য সব এক একটা ছবির মতো টিয়ার চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়। লিফটের দরজায়, কারও মাথার পিছনে অথবা শুধুই শূন্যে ছবিগুলো ভেসে ওঠে। বড়ো পর্দার মতো। তবে সেকেন্ডে চব্বিশটা নয়, যেন চব্বিশশ’ ছবি।  

লিফট নিচের তলায় দাঁড়ায়। টিয়ার কাছে মনে হয়, এটাই তার জীবনের দীর্ঘতম পাঁচ মিনিট। রবিনের সঙ্গে থাকার শেষের দিনগুলোয় মনে হতো কোথায় পালিয়ে বাঁচবে। এখনো তেমনই মনে হচ্ছে। কোথায় যায়, নিজেকে কী করে অদৃশ্য করে ফেলে। বাইরে বেরিয়ে পারভেজ সাহেব বলেন, ‘ক্যান্টিনে চা-টা খেতে যাচ্ছি, আপনিও আসুন না আমাদের সাথে।’  ‘স্যরি আজ আসলে একটু তাড়া আছে। অফিসে কিছু কাজ রেখে চলে এসেছি,’ টিয়া দ্রুত বলে নেয়। তারপর রবিনের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে, ‘আচ্ছা আসি, বাই।’ তারপর চোখের পলকে কাচের দরজা ঠেলে উধাও হয়ে যায়। 

৪ অফিসে ফিরে আসে আধাআধি করে রাখা কাজের তাগিদে কিন্তু কাজে মন বসাতে পারে না টিয়া। একদিকে বুঝতে পারে যে চাকরিটা হাতের মুঠোয় আসা সত্ত্বেও নিতে পারবে না, সেজন্য দুঃখ-বিরক্তি আর অন্যদিকে স্মৃতির যন্ত্রণা। চেয়ারে বসে শরীরটা পিছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজতেই পরিষ্কার সব দেখতে পায়।  রবিন তখন এক প্রাইভেট ব্যাংকে। টিয়া সেই ব্যাংকে প্রভিশনারি অফিসার হিসেবে জয়েন করেছিল রবিনের অধীনে। একই সঙ্গে নাইট শিফটে এমবিএ করছিল। অনার্সের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে তাকে চলে আসতে হয়েছিল কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে। আর রবিন তখন এলিফেন্ট রোডে একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকত। অল্পদিনেই অফিসে দুজনের ভালোলাগালাগি ধরা পড়েছিল দুজনের কাছে। কাজের মধ্যে সারাদিন আর তার পরেও সন্ধ্যাগুলো অনায়াসে একসঙ্গে কেটে যেত। ধীরে ধীরে ছুটির দিনগুলো রবিনের বাসায় কাটতে লাগল। ভাবতে ভাবতে বন্ধ চোখেই কিছু দেখে চমকে ওঠার মতো টিয়া শিহরিত হয়। কী ভয়ঙ্কর চুম্বক আকর্ষণ ছিল রবিনের তার জন্য! তার নিজেরও। শুধু রবিনের কাছে থাকতে চাইত সারাক্ষণ। ঈদের অথবা কোনো ছুটিতে যখন যে যার দেশের বাড়িতে চলে যেত সেই কয়েকটা দিন কাটত অস্থিরতায়। ফিরে এক হওয়ার আশায় শরীর-মন সব ব্যাকুল হয়ে থাকত।

টিয়া এই সম্পর্কের কথা মা-বাবা কাউকে বলেনি। ভেবেছিল সবাই জানে যে পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে করবে, তাই তখন বললেই চলবে। মনে মনে রবিনের সাথে সম্পর্কটা দাম্পত্যের মতোই লাগত তার কাছে। ব্যাংকের বন্ধুস্থানীয় কলিগরা অনেকেই জানত তাদের কথা। তারপর বছর তিনেক কেটে গিয়েছিল। রবিন অন্য ব্যাংকে জয়েন করল, টিয়ারও পড়াশোনা শেষ হলো। বাবা-মা বিয়ের জন্য পীড়পীড়ি করলে সে রবিনের কথা সবাইকে বলল। অথচ রবিনকে জানাতেই হলো যত বিপত্তি। রবিন বলে বসল সে এখন বিয়ের জন্য তৈরি নয়। টিয়া রবিনকে বোঝানোর জন্য তার বাসায় টানা কয়েকদিন থেকে গেল। বাবা-মাকে রবিনের কথা বলে দিয়েছে, টিয়ার পছন্দের গুরুত্ব আছে তাদের কাছে। কিন্তু রবিনের এক কথা, বিয়ের বিষয়ে এখনো তেমন কিছু ভাবেইনি সে। নিজেকে আরও গোছাতে চায়, কোনো দায়িত্বের মধ্যে এই মুহূর্তে ঢুকতে চায় না। টিয়া তার জন্য অপেক্ষা করবে কি করবে না, এ নিয়েও তার তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। টিয়া বুঝতে পারছিল রবিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিয়ের ব্যাপারে অনীহা জানাচ্ছে। কিন্তু কেন যেন নিজের বোঝার ক্ষমতাকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাই প্রতিদিন অফিস শেষে ছুটে গেছে রবিনকে আরও ভালো করে বুঝতে। রবিন বিয়ে করতে চায়নি ঠিকই কিন্তু টিয়া গেলে খুশি হয়েছে, জড়িয়ে ধরেছে দেখামাত্রই। আরো পরে একসময় টিয়াকে রবিনের মনোভাব মেনে নিতে হয়েছে। দিনের পর দিন রবিনের ‘না’ শুনতে শুনতে ভালোবাসার ঘোরও কাটতে শুরু করেছিল। বুঝেছিল তার ভালোবাসা আর রবিনের ভালোবাসা কিছুতেই এক নয়। 

টিয়া রবিনের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। রবিন তাকে ফোন করে ডাকত। অনুরোধ করত বাসায় যাওয়ার জন্য। কখনো ফোন না ধরলে এসএমএস দিয়ে রাখত। রবিনের মিসড কলস আর এসএমএস দেখে টিয়ার নিজের প্রতি ঘৃণা জেগেছিল। একা গুছিয়ে চলা একটা মেয়ে সে। নিজেকে খুব বোকাও মনে হয়নি কখনো। সে কী করে এরকম একটা ফাঁদে পা রাখল! আর রাখলই যদি তবে তা বুঝতে এতদিন লাগল কেন? এসব ভাবতে ভাবতে মাথা এলোমেলো হয়ে যেত। কিসের ঘোরে যেন মজে ছিল। তার ক্যারিয়ারের কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু আত্মসম্মানবোধে যে কত আঘাত লেগেছিল তা কাউকে বলেনি। প্রায়ই রাতের অন্ধকারে নিজের কাছে ভেঙ্গেচুরে পড়েছিল বারবার। আবার ভাঙ্গা টুকরোগুলো দিয়ে নিজের গড়েছে। কারো সাহায্য চায়নি। কাউকে বুঝতে দেয়নি তার ভেতরে কী চলছে। তাকে এভাবে কেউ ব্যাবহার করল অথবা ঠকাল- এই অনুভূতিটা তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। রবিনের উপরে রাগের চেয়ে নিজের ভুলের জন্য অনুতাপ হয়েছিল বেশি। মনে হতো, চারদিকে রবিনের মতো মানুষদের আনাগোনার খবর তো জানতই সে কিন্তু নিজেইবা কারও ওপর এতটা ভরসা করল কেন! রবিন কি কখনো তাকে বিয়ের কোনো আশ্বাস দিয়েছিল বা স্বপ্ন দেখিয়েছিল? মনে পড়ে না। তবে সে কেন নিজে নিজেই স্বপ্ন সাজিয়ে বসে ছিল? তারপরে রবিনের আর কোনো খোঁজখবর রাখেনি টিয়া। বছরখানেক পরে এক কলিগের মাধ্যমে সম্বন্ধ আসায় আসিফকে বিয়ে করেছে। একটা ব্যর্থতায় নিজেকে হতাশায় ডুবিয়ে রাখার মতো মেয়ে সে ছিল না। খুব দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল। তবে বিয়ের আগেই রবিনের সাথে সম্পর্কের কথাটা আসিফকে বলেছিল। একই ধরনের চাকরি করত আসিফ। বিয়ের পরে সে পুরোনো ঘটনা কারো কাছে হঠাৎ করে জানুক, টিয়া সেটা চায়নি। আসিফ স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল ব্যাপারটা। বিয়ের পর থেকে চমৎকার বোঝাপড়া তাদের দুজনের।  

টিয়া সোজা হয়ে বসে নিজের চেয়ারে। চোখ খুলে তার চারপাশের বর্তমানটাকে দেখে। কেন সে ভাবছে এসব অর্থহীন হয়ে যাওয়া সময়ের কথা? বিরক্ত হয় নিজের ওপরেই। নিজেকে কতবার বলেছে, রবিনের কোনো অস্তিত্ব নেই তার জীবনে। বহুদিন সত্যি সত্যিই রবিনের কথা মনে পড়েনি। আসিফের সাথে থাকতে থাকতে কোথায় হারিয়ে গেছে রবিন!  বোকামির জন্য নিজেকে দোষ দেয়ার কথাও আজকাল আর মনে আসে না।       

৫ সন্ধ্যায় আসিফ বাসায় আসে টিয়ার পরে। দরজায় দাঁড়িয়েই জানতে চায়, ‘কী হলো?’ ‘সব ঠিকই আছে। ইচ্ছে করলে জয়েন করতে পারি এক সপ্তাহের মধ্যে।’  ‘তাই? ভেরি গুডনিউজ! কংগ্র্যাচুলেশনস, টিয়া।’  ব্যাগ টেবিলের উপর রাখতে রাখতে আসিফ টিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম তা-ই হয়েছে। দু’একবার সময় পেয়েছিলাম ফোন করার, কিন্তু জানো, সামনে দাঁড়িয়ে সুখবরটা শুনতে চেয়েছিলাম তো, তাই ফোন করিনি।’ শেষ কথাগুলো বলতে বলতে আসিফের মাথা টিয়ার ঘাড়ের উপরে চলে আসে। আসিফ বলে, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি, টিয়া, খুব।’ টিয়া আসিফের পিঠে হালকা হাত রাখে। ভাবে, সে-ও যদি এমনই খুশি হতে পারত, কিংবা আসিফের খুশিটা ছুঁতে পারত! দখিনের খোলা জানালায় পতপত করে উড়তে থাকা আকাশের রঙের পরদার সামনে আসিফকে জড়িয়ে ধরে কয়েক পাক ঘুরতে পারত যদি! কিংবা আসিফ আসার সময়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে জোরে চিৎকার করত, ‘আসিফ, আই হ্যাভ ডান ইট!’ 

বাস্তবে সেসব কিছুই করে না টিয়া। তেমন খুশিও চোখে-মুখে থাকে না। মনটা বরং বিষিয়ে আছে। যে চাকরির জন্য সে প্রায় বছরখানেক ধরে অপেক্ষা করছে, তদবিরও করছে, আজ হাতের মুঠোয় আসার পরও কোনো আনন্দ নেই। কিছুতেই ওই অফিসে রবিনের উপস্থিতিকে উপেক্ষা করতে পারে না। রাগ-বিরক্তি ফেনার মতো ফুলে ফুলে ওঠে। এরকম সুযোগ কি তার জীবনে বারবার আসবে? আবার নিজেই নিজেকে জানায়, না, আসবে না। তারপর চমকে উঠে আবার বলে, তাই বলে রবিনের সাথে একই অফিসে দিনের পর দিন? অসম্ভব!  আসিফের জড়িয়ে রাখা হাত টিয়ার নির্লিপ্ততার খবর পেয়ে যায়। শিথিল হয়ে যায় টিয়ার পিঠের ওপরে। টিয়ার নির্বিকার চোখ দেখে অবাক লাগে তার। অস্থির হয়ে বলে, ‘এই টিয়া, শরীর খারাপ নাকি? কী হয়েছে?’ তাকে চুপ দেখে আসিফের অস্থিরতা দ্বিগুণ হয়। অধীর হয়ে জানতে চায়, ‘বলো না, ওরা কী বলেছে? খুশি হওনি তুমি?’ ‘না না, কিছু হয়নি, সবই ঠিক আছে। দ্যা মিটিং ওয়াজ ভেরি সাকসেসফুল। আমার ভীষণ খুশি হওয়া উচিত। সব কিছুই ঠিক ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত--- ‘যতক্ষণ পর্যন্ত কী?’  ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি রবিনকে ওই অফিসে দেখিনি।’

আসিফ ছোট নিঃশ্বাস ফেলে টিয়ার ঘাড় থেকে হাত নামিয়ে নেয়। তারপর পাশ কাটিয়ে বেডরুমের দিকে চলে যায়। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে টিয়াও চলে যায় রান্না ঘরে। আসিফ কাপড় বদলে এলেও কথা বলে না। চা বানাতে গিয়ে টিয়া ভাবে, এই বিষয়ে কথা শেষ; এ নিয়ে আর কোনো কথা থাকতে পারে না। আসিফের হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যাওয়াই সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। ভালোই হয়েছে, চিন্তার হাত থেকে বাঁচা গেল। এই চাকরির কথা সে আর ভাববে না। নিজেদের এপার্টমেন্ট না-হয় আরও পরে হবে অথবা হবে না। টিয়া আসিফের সামনে আর চাকরির প্রসঙ্গ তুলবে না। অথচ ডিনারের সময় আকস্মিক আসিফ প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে প্রশ্ন করে, ‘তা, রবিন সেখানে কী করছিল?’ ‘ওখানে হিউম্যান রিসোর্সে আছে। আমি জানতাম না।’ ‘আচ্ছা। এমনিতে তোমার কেমন লাগল?’ ‘খুব ভালো। হুমায়ূন সাহেব তো ইমপ্রেসড হলেন মনে হলো। বললেন, আমাদের সব ক্রাইটেরিয়াই আপনি মিট করছেন। স্যালারি আমি যা আশা করছিলাম তাতেই রাজি হলেন। হোম লোনের ব্যাপারে কম ইন্টারেস্টে লোন ফ্যাসিলিটি দিতেও আপত্তি নেই তার। রিক্রুটিং এজেন্সিকে যা চাই আগেই বলেছি, সুতরাং তাদের সাথে বারগেইনিং করতে আর রাখঢাক করিনি। পেমেন্ট থেকে শুরু করে সব বেনেফিটের ব্যাপারেই খোলাখুলি আলাপ হয়েছে। আমার বস, আহসান ভাই ওনার চেনা। তার কাছে আমার ব্যাপারে কখনো মনে হয় কোনো সুনাম শুনেছেন। যাই হোক, এখন এসব বাদ দাও। এ নিয়ে কথা বলে আর লাভ নেই। তা আজ তোমার কেমন কাটল?’ ‘ব্যস্ত বেশ। তবে ফাঁকে ফাঁকে তোমার ইন্টারভিউয়ের কথা ঠিক-ই ভাবছিলাম। মিরপুরে এক ক্লায়েন্টের কাছে যেতে হলো। ফেরার পথে গাড়ির ব্লুবুক রিনিউ করতে বিআরটিএ-তে নামলাম।’ ‘ভালো করেছ।’ খাবার পরে তারা দুজন মিলে গোছগাছ শেষ করে টিভি দেখতে বসে। টিয়া তার আর আসিফের পরদিন সকালে পরার কাপড় আয়রন করে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখে। ড্রেসিং টেবিলে নিজের জন্য ম্যাচিং কানের দুল আর ব্যাগ বেছে সাজিয়ে রাখে। তারপর আসিফের সাথে একটা সিনেমার শেষের অর্ধেকটা দেখে ঘুমিয়ে পড়ে। 

সকালে বুয়ার ডোরবেলের আওয়াজে দরজা খুলতে যায় টিয়া। আসিফকে ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে গোসলে চলে যায়। পরে আসিফ গোসল সেরে বেরিয়ে এলে এগিয়ে আসে ড্রেসিং টেবিলের দিকে। সামনে বসা টিয়ার কানে আসে আসিফের গলা, ‘টিয়া, সত্যি করে বলো তো, এখন রবিনের জন্য তোমার কোনো ফিলিং নেই, আছে নাকি?’ চুল আঁচড়াতে গিয়ে টিয়ার হাত থেমে যায় চিরুনিসহ। সামনের আয়নায় তীর্যকভাবে আসিফকে দেখে। আসিফ এখনো ভাবছে ওই চাকরি নিয়েই? তার মুখ থেকে উত্তর বেরিয়ে যায়, ‘এ্যাবসার্ড! ওর জন্য ফিলিং! আগে যতবার ওর কথা মনে হয়েছে কেবল বিরক্ত লেগেছে। আজকাল আর তাও লাগে না। কিছুই মনে পড়ে না ওর কথা।’  ‘আমারো তাই মনে হয়। তোমার কাছে রবিন কোনো ব্যাপার না এখন আর। ইউ উইল ফিল নাথিং ইফ ইউ সি হিম নাউ, উইল ইউ?’ ঠোঁট উলটে অবহেলার ভঙ্গিতে বলে আসিফ। ‘জানোই যখন তাহলে থামোখা এসব কথা বলছ কেন?’ টিয়া এবারে বিরক্ত হয়। ‘বলছি কারণ তাহলে তো চাকরিটা না নেয়ার কোনো কারণ দেখি না। রবিন ইজ নোবডি রাইট নাউ। ইন দ্যাট কেইস, আমার মনে হয় তুমি ব্যাপারটা আর একবার ভেবে দেখতে পার। এই ধরো, অফিসে সবাইকে কি আমাদের ভালো লাগে? একটা ফর্মাল পরিবেশে কাউকে বিরক্ত লাগলেও আমরা তা প্রকাশ করি না, করি? কলিগদের মধ্যে কাউকে ভালো না লাগলেই তো অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিই না। আই থিঙ্ক ইউ শুড বি প্রফেশনাল, টিয়া।’ চিরুনি আর চিরুনিতে প্যাঁচানো চুলসহ হাতটা কানের পাশেই থমকে আছে টিয়ার। মাথাটা চিরুনির দিকে সামান্য হেলে আছে। চোয়াল নিচের দিকে নেমে গিয়ে মুখটা একটু খুলে গেছে। মুখ না ঘুরিয়ে আয়নায় সে আসিফকে দেখে। আসিফ যেন টিয়ার কাছে থেকে কিছু শুনতে চায়। কিন্তু বিস্ময় কাটলে তো সে কথা বলবে! এদিকে দেরিও হয়ে যাচ্ছে অফিসের।  আসিফ আবার শুরু করে, ‘আরেকবার ভাবো তুমি, ইফ পসিবল, জবটা হাতছাড়া করা উচিত না। আমাদের সংসারের ভালোর জন্য তোমার জয়েন করা উচিত। তুমি নিজেও জানো, এতে অনেকগুলো সমস্যা মিটে যাবে। আর যদি মানা করে দাও, বুঝতেই পারছ, বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে যাব আমরা।’

টিয়ার বিস্ময় না কাটলেও আসিফের শেষ কথাগুলো খুব বাস্তব হয়ে ধরা দেয় তার কাছে। তাই তো, বেতন বেড়ে যাচ্ছে, গাড়ির লোন সহজে শোধ হয়ে যাবে, তারপর বাড়ির জন্য ব্যাংক থেকে সুবিধাজনক শর্তে লোন পাবে, সুতরাং এ্যাপার্টমেন্টের সমস্যারও সমাধান। ওদিকে, লোনের কিস্তিগুলো শোধ করেও মাস শেষে ভালো টাকা হাতে থাকবে। কিছু টাকা জমলে হঠাৎ কোনো প্রয়োজন এলেও তা নিয়ে ভাবতে হবে না। মাসে দুএকটা খাওয়া-দাওয়া বেশি হতে পারে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। একটা জীবন বীমা পলিসিও নিতে পারে, তার অথবা আসিফের নামে। পরিচিত কতজনই তো ইতিমধ্যে করেছে আর তিন-চার বছর ধরে প্রিমিয়ামও দিচ্ছে। আসিফ আর টিয়ার মতো ছোট্ট সংসারের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তাটা খুব দরকার। আবার হাতে টাকা জমলে ব্যাংকে একটা ফিক্সড ডিপোসিট এ্যাকাউন্ট ওপেন করা যায়, কিংবা কেনা যায় বন্ড। আজকাল সেভিংস এ্যাকাউন্টের চেয়ে ওতে ইন্টারেস্ট ঢের বেশি। একসাথে অতগুলো টাকা জমেনি তাই কখনো করাও হয়ে ওঠেনি। 

মেঘের ফাঁক দিয়ে লম্ব হয়ে পড়া সূর্যরস্মির মতো টিয়ার কল্পনাগুলোর আলাদা আলাদা ছবি চারপাশে খাড়াখাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। কাল থেকে যা যা ভাবছিল ভুলতে সময় লাগে না। কোথাও কোনো দ্বিধা নেই। শুধু তাসের উপরে তাস পড়ার মতো কল্পিত ছবিগুলো একটার উপরে একটা সেঁটে যেতে থাকে। সামনের আয়নার প্রতিবিম্বে ঝুলে যাওয়া চোয়াল উঠে আসে আর ঠোঁটে তিন দিনের চাঁদের মতো একটা স্বস্তির হাসিও ফুটে ওঠে। অদ্ভুত নিশ্চিন্ত এক জীবন তাকে আয়নার ভেতর দিয়ে হাতছানি দেয়। এই জীবনটা তো তারই। আর একবারই মাত্র ভোগ করতে পারবে। তারপরেই শেষ। তাহলে এই জীবনে যতটা পাওয়া সম্ভব, তা সে নেবে না কেন?

৬ দুই দিনের মাথায় পুরোনো অফিসে কোনো নোটিস না দিয়ে একেবারে দুম্ করে মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকটাতে জয়েন করে ফেলে টিয়া। অনেকে খুব অবাক হয় টিয়ার সাফল্যে। টিয়া জানে, কাজে প্রমাণ করতে হবে যে সে পদটির উপযুক্ত। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে যেতে হয় হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টে। ম্যানেজারের চেয়ারে বসে আছে রবিন। ব্যবহার দেখে মনেই হয় না তারা পূর্বপরিচিত। রবিনের জায়গায় একজন অন্য মানুষ থাকলে টিয়ার কথাবার্তা, চালচলন যেমন হতো, তেমনই হয়। ওই সময় রুমে অফিসের অন্য একজন মানুষ থাকায় আরো সুবিধা হয়। ‘এখানে সাইন করতে হবে, এই রুলসগুলো একটু পড়ে দেখবে ‘, দরকারি এটা সেটা বলতে থাকে রবিন।  অল্প দিনেই টিয়ার ভালো লেগে যায় নতুন অফিস। সিনিয়র পারভেজ সাহেবের পাশে থেকে নতুন কাজকর্ম ধরতে বেশি সময় লাগে না। টিয়ার কাজে সবাই খুশি। আর কদিনেই টিয়া হয়ে ওঠে ক্রেডিট ডিভিশনের অপরিহার্য একজন। রবিনের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা হয় অফিসের করিডোরে অথবা এখানে ওখানে। ধীরে ধীরে দেখা হওয়াটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। কেউ কাউকে দেখে অস্বস্তি বোধ করে না।

টিয়ার ভয় ছিল চোখের সামনে রবিনের ফিরে আসাটা হবে ঘুমন্ত কষ্টকে আবার জাগিয়ে তোলার মতো। কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। কোনো একদিন তার স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে ভয়ানক কষ্ট হয়েছিল টিয়ার। ঘষে ঘষে গাঢ় পেন্সিলের দাগ ওঠাতে গিয়ে যেমন কাগজ কোথাও কোথাও ছিঁড়ে যায়, টিয়ার ভিতরে জায়গায় জায়গায় সেরকম নানান আকৃতির ফুটো হয়ে গিয়েছিল। কিছু স্মৃতি ভুলতে গিয়ে একসাথে অনেক কিছুই সে ভুলে গেছে। অনুভূতিগুলো অনেক ক্ষেত্রে ভোঁতা হয়ে গেছে। তবু টিয়া খুশি। আবেগহীন এরকম একটা যান্ত্রিক জীবন তার ভালোই লাগে। আসিফও সেরকম। অফিস আর ছুটির দিনের সামান্য আড্ডা ছাড়া তেমন কিছু বোঝে না। এই চাকরিতে আসার পর প্রথম প্রথম আসিফ টিয়াকে প্রশ্ন করত। অফিসে রবিন থাকাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না জানতে চাইত। রবিনের ব্যাপারে টিয়ার আবেগহীন জবাব পেয়ে পেয়ে এখন আর তা-ও করে না, বরং ধীরে ধীরে বিষয়টা সহজভাবে একটা দুষ্টুমির জায়গায় পৌঁছে যায়। টিয়া হয়ত অফিস যাবার আগে কখনও বেশ যত্ন করে সাজলে আসিফ বলে, ‘আজ রবিনের সাথে লাঞ্চ নাকি, টিয়া?’  টিয়া পাল্টা হেসে জবাব দেয়, ‘আরে হ্যাঁ, তুমিও চলে আসো না, তিনজনে বেশ জমবে।’ তারপর দুজনে মিলে হাসতে থাকে।  

হোম লোন পেয়ে গেলে বছর ঘুরতেই টিয়া আর আসিফ তাদের ভাড়া বাসা ছেড়ে নিকেতনে নিজেদের এপার্টমেন্টে উঠে যায়। এপার্টমেন্টটা পাঁচতলায়; বেশ খোলামেলা, বড়সড়। সামনের বারান্দায় বসলে একচিলতে লেক আর ওপরে বিস্তৃত আকাশ। সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারলে চা নিয়ে সেখানে দোলানো চেয়ারে বসে গল্প করে তারা। তখন নিঃসন্দেহে তারা দু’জন পৃখিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হয়ে ওঠে। এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে তারা বাসার সব আসবাব কিনেছে। এর পছন্দে এটা তো ওর পছন্দে ওটা। দেখতে দেখতে তাদের ইট-সিমেন্টের এপার্টমেন্টটা ভালোবাসার নীড় হয়ে যায়। প্রতিটি কোণায় টিয়া আর আসিফের ভালোলাগার ছোঁয়া স্পষ্ট। ছুটির দিনে সকালের নাস্তাটা সামনের বারান্দায় সারে তারা। ছুটির দিনে আসিফ কখনও শখ করে সকাল সকাল বাজারের দিকে যায়। টিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ে ওপর থেকে। আসিফও কয়েক সেকেন্ডের জন্য গাড়ির জানালায় মুখ বাড়িয়ে ওপরে তাকায়, পালটা হাত নাড়ে।    

৭ মাসকয়েক পরে কক্সেসবাজারে একটা হোটেলে অফিসের কনফারেন্সের কথা জানতে পারে টিয়াা। অন্য ব্রাঞ্চের ম্যানেজাররা সেখানে আসবে। টিয়াকে দেখাতে হবে তার ডিভিশনের কাজের পদ্ধতি। তিন দিন হোটেলটাতে থাকতে হবে। অনেকেই পরিবার নিয়ে যাচ্ছে দেখে টিয়া আসিফকে বলে ছুটি নিয়ে সেখানে চলে আসতে। কনফারেন্সের পরে দুটো দিন সমুদ্রের পাশে কাটাতে চায়। কিন্তু আসিফ ছুটি পায়নি। যাওয়ার আগে খাবার-দাবার ফ্রিজে গুছিয়ে আসিফকে সব বুঝিয়ে তবে টিয়া বাসা ছাড়ে। তবু কেন যেন মন কেমন করে। আসিফ সময়মতো মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করে খাবে তো? চিন্তায় অস্থির হয়ে বারবার বলতে থাকে, ‘কেন যে যেতে পারছ না আসিফ! কত ভালো হতো গেলে, একই সাথে বেড়ানো হয়ে যেত।’ 

আসিফ মন খারাপ করে। বলে, ‘এবার শীতে একসাথে যাব, দেখ। এমন জরুরি একটা কাজ পড়েছে, কিছুতেই এ্যাভয়েড করতে পারলাম না। তুমি চিন্তা করো না, আমি ভালো থাকবো। গুড লাক ফর ইয়োর প্রেজেন্টেশন।’ ‘থ্যাঙ্ক ইউ। ফোন কোরো প্রতিদিন।’ ‘অবশ্যই, আমি আমার টিয়ার খোঁজ নেব না? এ বাসায় তুমি ছাড়া প্রতিটা মুহূর্ত আমার কেমন লাগবে ভাবো তো!’  টিয়ার চোখ টলটল করে। মাত্র তিনদিনের বিচ্ছেদ। তবু কোনো বিদায় আনন্দের নয়।  আসিফ যেন বুঝতে পারে টিয়ার মনের অবস্থা। জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়, ‘ডোন্ট ওয়ারি, আই উইল বি ফাইন।’   তিন দিনে কনফারেন্স শেষ হয়ে যায়। লাগাতার প্রোগ্রাম থাকাতে বোঝাই যায় না কী করে সময় পেরিয়ে গেল। শুধু লাঞ্চ ব্রেকে কলিগরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলার সুযোগ পেয়েছিল। কখনও লাঞ্চে আবার কখনও প্রজেন্টেশনের ফাঁকে কিছু সামাজিক কথাবার্তা হয় রবিনের সাথে টিয়ার। রবিন এখনও বিয়ে করেনি। টিয়া মনে মনে হাসে। এখনও তাহলে একইরকম আছে রবিন। একইভাবে হয়তো আবার কারও সাথে. . . যা ইচ্ছে করুক, তাতে টিয়ার কী?  

প্রেজেন্টেশন শেষ হলে রাতটা হোটেলে থেকে খুব ভোরে ঢাকার পথে রওনা দেবে তারা। রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে টিয়া। অনেকে হোটেলের ভেতরের দিকের বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। টিয়ার সাথে একই রুমে থাকছে সহকর্মী রুমানা, তার সাথে টিয়াও আড্ডায় আসে। রবিন ছিল আসরের মধ্যমণি। কেউ জানে না তাদের দুজনের আগের সম্পর্কের কথা। রবিনের কথা বলা, হাত নাড়ানো টিয়া অবাক হয়ে লক্ষ করে। এসব তার কত চেনা! হাত না নাড়িয়ে রবিন কথা বলতে পারত না। মাঝে মাঝে টিয়া রবিনের হাত চেপে ধরত আর রবিনের কথা বন্ধ হয়ে যেত, কী বলছিল আর মনে করতে পারত না। খেই হারিয়ে হাসতে হাসতে বলত, ‘অ্যাই টিয়া, হাত চেপে ধরে দিলে তো ভুলিয়ে জরুরি কথাটা!’ 

রবিন স্বভাবসুলভ কৌতুক বলে যাচ্ছে, ‘রেলের বাঙ্কারে উঠে একজন বলছে, কার যে এত বড় ব্রিফকেস! আর একজন নিচে থেকে জানতে চাইল, কেন ভাই কী সমস্যা? বিরক্ত হয়ে প্রথম জন বলল, আরে ধ্যাত, আমার স্যুটকেসে তো ঢোকানোই যাচ্ছে না।’ সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। মহা উৎসাহিত রবিন আবার অন্য কৌতুক বলা শুরু করে। টিয়া দেখে আর ভাবে, রবিন সেই একই রকম আছে। একই রকম মানুষকে মাতিয়ে রাখে কথা দিয়ে। ওর কথায় হাসতে হাসতে পাগল হতো একসময় টিয়া। এতদিন অফিসে তাকে এড়িয়ে চলেছে, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনি বা রবিনকেও বলার সুযোগও দেয়নি। কিন্তু এই মুহূর্তে এখানে থাকতে কেন যেন ভালোই লাগে। জুনিয়র কলিগরা থেকে থেকে অস্থির হয়ে উঠছে, ‘রবিন ভাই, ওই যে ওইটা বলেন, সেদিন ক্যান্টিনে যেটা বললেন! ওইটা জোস ছিল।’ রবিনও চালিয়ে যায়, ‘ও, আচ্ছা, ওইটা?’ সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বারবার আর হাসি মিলিয়ে যাবার আগেই রবিন আবার শুরু করে, ‘আরে এটা আর এমন কী, এবার যেটা বলব সেটা শোনো।’  আবার বাকিরা মনোযোগী হয়। কথায়, হাসিতে টিয়া একসময় নিজের আড়ষ্টতার কথাই ভুলে যায়। অন্য সবার মতো কৌতুক আর গল্পের ভেতরে কখন যে ঢুকে পড়ে নিজেই জানে না। রাত বাড়তে থাকে। কে যেন বলে, ‘আচ্ছা, এত রাতে এভাবে হোটেলের বারান্দায় চেঁচামেচি করা কি ঠিক হচ্ছে? অন্য বোর্ডাররা তো বিরক্ত হতে পারে।’  অন্য আর একজন বলে, ‘তা হচ্ছে কিন্তু এত মজার আড্ডাটা শেষ করে দিও না প্লিজ।’ রবিন সাথে সাথে বলে, ‘ওকে, আমার রুম এখান থেকে সবচেয়ে কাছে, তো চলো না সবাই আমার রুমে।’ 

৮ আবার আড্ডা জমে ওঠে রবিনের রুমে। রবিনের সাথে ওই রুমে ছিল পারভেজ। বিকেলেই সে হোটেলের অন্য রুমে চলে গেছে। তার বউ-বাচ্চা এসেছে। সাপ্তাহিক ছুটি এখানে কাটাবে ওদের সাথে। রাত বাড়লে আড্ডা ফিকে হয়ে আসে। একে একে সবাই যে যার ঘরে চলে যেতে থাকে। সকালে যাত্রা সুতরাং সবারই একটু ঘুমের প্রয়োজন। তবু দু’একজন বেশ আসন গেড়ে বসে থাকে। তাদের মধ্যে রুমানা একজন। সে টিয়াকেও উঠতে দেয় না; বলে, ‘আরে বাসে ঘুমিয়ে নিলেই হবে, কাল অফিস বন্ধ, আর ঢাকায় গিয়ে আবার তো সেই একঘেয়ে জীবন! ভালো লাগছে, আর একটু বসো না, টিয়া।’ তারপর একসময় রুমানা উঠতে চাইলে টিয়া রবিনকে যেই ‘গুডনাইট’ বলতে যাবে রবিন তার আগেই বলে, ‘যাওয়ার আগে একটু চা খেয়ে যাও।’ রুমানা হাই তুলতে তুলতে বলে, ‘না না, এখন চা খেলে আমার এক ফোটাও ঘুম আসবে না। সারারাত এপাশ ওপাশ করতে হবে। আপনারা খান, আমি যাই।’ টিয়াও দাঁড়ায়, বলে, ‘চলো যাই।’ রবিন অনুরোধ করে, ‘জাস্ট এ কাপ অফ টি টিয়া, প্লিজ একটু বসো না, শেষ হলেই চলে যেও।’

টিয়া রুমানার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। ভয়ও লাগে, তার ব্যবহারে রুমানা যদি জেনে যায় রবিনের সাথে আগের ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা। আবার এতক্ষণ রবিনের সাথে হাসাহাসি, গল্পের পর অচেনা ভঙ্গিতে কথা বলার দূরত্বটাকে কোথাও খুঁজে আনার কোনো যুক্তিও পায় না। সবার মতো রবিনকেও সাধারণ একজন কলিগ বলে মনে হয়। টিয়াকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে রুমানা আবার লম্বা হাই তুলে বলে, ‘আমি আগাই, তুমি চা খেয়ে আস। রুমের চাবি সাথে আছে তো, না?’ টিয়া কী বলে না শুনেই রুমানা পা বাড়ায়। ঘুমে আর দঁড়িয়ে থাকতে পারে না। রবিন ইলেকট্রিক হিটারে পানি দিয়ে সুইচ অন করে। দুটো কাপে দুটো টি ব্যাগ রাখে। অনেক আগের চেনা গলায় বলে, ‘কেমন আছ, টিয়া?’  টিয়া একেবারে শান্তভাবে বলে, ‘ভালো আছি। অনেক ভালো।’  ‘এতো জোর দিয়ে বলছ কেন? ভালো আছো, জানি। এখনও কি দুধ ছাড়াই চা খাও? ক্রিমার দেব?’  ‘না।’ ‘হেলথ্ কনশাস, একই রকম আছ।’  ‘তুমিও তো দেখি একই রকম আছ, এত রাতে চা খাও।’ ‘আমি তো কোনোদিনও বদলাব না।’  ‘জনি।’ ‘খুব অল্প দিনে ক্যারিয়ারে সাংঘাতিক জাম্প করেছ টিয়া, অ্যামেইজিং!’ ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ টিয়ার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে রবিন পাশের সোফায় বসে, বলে, ‘আজ ফোনে শুভ ভাইয়ের সাথে কথা হলো। অফিসের শুভ ভাইয়ের কথা মনে আছে তোমার? আমার বাসায় আসার আগে ফোন করে বলত, রবিন আর টিয়ার পাখসাট শেষ হয়েছে? শেষ হলে বলো। আমি আসব।’  ‘তা, এত রাতে কী পাখসাটের জন্য আমাকে এখানে বসালে?’

রবিন হাসে। টিয়া আপন মনে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। চামচ দিয়ে কাপের চা নাড়তেই থাকে অবিরাম। হাত কিছু করছে অথচ মন ভাবছে অন্য কিছু। হাতের যান্ত্রিক নড়াচড়ার ব্যাপারে সে সচেতন নয় যেন। চামচের খোঁচায় টিব্যাগ ছিঁড়ে চায়ের গুড়ো পুরো কাপটিতে ছড়িয়ে পড়েছে, টিয়ার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। রবিন চমকে বলে, ‘হায় হায়, এটা তো আর খেতে পারবে না। দাও বদলে দেই।’    টিয়া দ্রুত উঠে চা সিঙ্কে ফেলে আবার নতুন টি-ব্যাগ নেয়। হিটারের সুইচ অন করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। পিছনে ফিরে হেসে বলে, ‘খেয়ালই করিনি কীভাবে টি-ব্যাগটা ফেটে গেল।’

হিটারের দিকে মাথা ঘোরাতেই আকস্মিক টিয়া দেখে ওয়ার্ক এরিয়ার উপর রাখা তার হাতের ওপরে রবিনের হাত, ধীরে উপরে উঠছে। হাতটা কাঁপছে অথচ স্পর্শটা শক্ত, একদম আগের মতো। টিয়ার শরীর অবশ হয়ে যায়, হাত সরাতে পারে না। মনে হয় ঘুরে রবিনের মুখোমুখি দাঁড়ানোর শক্তিও অবশিষ্ট নেই তার। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঝিঁ ঝিঁ লাগার মতো হয়ে গেছে। কোনোভাবে নড়তে পারছে না। ঘাড়ের উপর চুলের গোছা ভাগ হয়ে গেছে দুপাশে। সেখানে রবিনের ঘন নিঃশ্বাসের ঝাপটা কিছুতেই সহ্য করা যাচ্ছে না। কানের কাছে ফিসফিস শব্দ শুনতে পায়, ‘আই অলওয়েজ লাভড্ ইয়োর স্ট্রেইটেনড্ হেয়ার, টিয়া।’ ওয়াটার হিটারের অটোসুইচ বন্ধ হওয়ার শব্দে টিয়া কোথা থেকে যেন ফিরে আসে, ঘুরে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে রবিনের হাত সরাতে থাকে বারবার। আবার সেই হাত টিয়ার হাতে, ঘাড়ে, কোমরে নতুন করে হাতড়াতে থাকে। টিয়া কোনরকমে বলে, ‘লিভ মি, রবিন।’ রবিন শোনে না। শুধু মরিয়া হয়ে নেশাগ্রস্ত গলায় প্রশ্ন করতে থাকে, ‘আমাদের আগের দিনগুলো মনে আছে, টিয়া? আমাদের আগের রাতগুলো? একটু মনে কর টিয়া, জাস্ট ওয়ান্স। শুধু একবার টিয়া, প্লিজ।’

রবিনের শান্ত গলার দৃঢ় কথাগুলো যেন সম্মোহনের দরজায় নিয়ে যায় টিয়াকে। চোখের সামনে ঝুলন্ত পেন্ডুলামের মতো রবিনের হাত টিয়ার সমস্ত শরীরের উপর দুলে দুলে এদিকওদিক যাওয়া-আসা করে। টিয়া বিচ্ছিন্ন একটা মানুষ হয়ে যায় ওইখানে দাঁড়িয়ে। তার যেন কোথাও কেউ নেই। টিয়া শুধু টিয়া- যে টিয়া পাগলের মতো ছুটে যেত রবিনের বাসায়। একেবারে সেই জায়গায় চলে যায় সে। মাঝখানের দিনগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই এক ছোঁয়া, একই মুহূর্তের পূনরাবৃত্তি। মাথার ভেতরে ফাঁকা হয়ে যায়। মাথার দুর্বল আর মিহি নির্দেশ শরীর আর শোনে না। টিয়ার আঁটোসাঁটো শরীর প্রশস্ত হতে থাকে। একেবারে তলিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে নিজের ঠোঁটের ওপরে রবিনের ঠোঁটের ভেজা স্পর্শে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে।

৯ বাসায় আসার পর থেকেই কাঠের পুতুলের মতো টিয়া এক জায়গায় বসে থাকে। আসিফ ডাকলেও শুনতে পায় না। কাছে এসে হাত দিয়ে শরীর ঝাঁকিয়ে আসিফ যখন বলে, ‘টিয়া, এ্যাই টিয়া শুনছ?’ তখন টিয়া লাফ দিয়ে ওঠে, চমকে তাকায়। মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করে একটু। লজ্জা পেয়ে বলে, ‘স্যরি, আমি শুনতে পাইনি।’   বারবার এমনই চলতে থাকে। আসিফ জানতে চায়, ‘কী হলো, ফেরার পর থেকে ওরকম মনমরা হয়ে আছ কেন? কী এত ভাবছ?’ টিয়া মুখ স্বাভাবিক করে আসিফের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কই না তো, শুধু একটু ক্লান্ত লাগছে।’  ‘তা তো লাগবেই। সবসময় অতিরিক্ত কাজের প্রেশার নাও। এক কাজ কর, দু-একটা দিন ছুটি নাও অফিস থেকে। একটু রেস্ট দরকার তোমার।’  ‘আচ্ছা, নেব।’ 

আসিফ অফিসে গেলে টিয়া সারাদিন ভাবে, কী করলে এই গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে- একেবারে চেপে যাবে? কেন যেন মন সায় দেয় না। আসিফের অতিরিক্ত ভালোমানুষি আর তার উপর অগাধ বিশ্বাস সেরকম কিছু ভাবতে দেয় না। একটা মানুষের বিশ্বাসে কী করে এতটা আঘাত করা যায়? বারবার মাথায় একটাই চিন্তা আসে, তা হলো, আসিফকে সবকিছু খুলে বলা দরকার। ভেতর থেকে যেন আওয়াজ আসে, এছাড়া তার অন্য কোনো উপায় নেই। এখন আসিফ যদি তাকে মাফ করে তবেই এই বিশ্রী অনুভূতি পিছু ছাড়তে পারে।  সন্ধ্যার দিকে অন্ধকার হয়ে এলেও টিয়া বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। উঠে জানালা বন্ধ করে না, লাইট জ্বালায় না। অপরাধবোধের তীব্র কষ্ট চোখ বেয়ে পানি হয়ে গড়ায়। হাত দিয়ে চোখ মুছতেও ইচ্ছে হয় না।

আসিফ ফিরে এসে ডাকতে ডাকতে বেডরুমে আসে, ‘টিয়া, ভরাসন্ধ্যায় শুয়ে আছ কেন?’ বলতে বলতে লাইট জ্বালায়, জানালা বন্ধ করে। ‘আচ্ছা টিয়া, জানালাও বন্ধ করনি? কত মশা ঢুকে গেল, দেখ তো!’ বলে টিয়ার পিঠের কাছে বিছানায় বসে কপালে হাত রাখে, ‘কী হয়েছে তোমার? জ্বর নাকি? টাইলনল দেব?’      টিয়া পাশ ফিরে আসিফের দিকে সরাসরি তাকায়। আসিফ চমকে বলে, ‘আরে হয়েছেটা কী? কাঁদছ কেন?’ টিয়ার হঠাৎ যেন কী হয়, ভূতগ্রস্তের মতো উঠে বসে, ফুলে যাওয়া চোখ মোছে আর একনাগাড়ে বলতে থাকে, ‘আসিফ আমার একটা কথা বলতেই হবে তোমাকে, চারদিন ধরে বলতে চাচ্ছি, বলতে পারছি না। আই হ্যাভ ডান সামথিং রং, আই নিড টু কনফেস। কক্সেসবাজারে হোটেলে আমি রবিনের সাথে...।’ আর বলতে পারে না টিয়া, হাঁফাতে থাকে। আবার চোখ মুছে বলে, ‘বিশ্বাস করো আসিফ, ইট ওয়াজ নট প্রিপ্ল্যানড্।’ আসিফের হাত নিজের শরীরের উপর থেকে শিথিল হয়ে সরে যেতে দেখে বলে, ‘ইট ওয়াজ নট ইভেন ইনটেনশনাল, বিলিভ মি। মাফ করো, আসিফ, প্লিজ ফরগিভ মি।’  

আসিফ বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকে দেখে। তার চেনা পারফেকশনিস্ট টিয়া। কোন কিছুর পরোয়া না করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো টিয়া। দায়িত্ববান টিয়া। অবাক হয়ে ভাবে, এই কি সেই মানুষ? তার মুখ শক্ত হয়ে আসে। সে কি টিয়াকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করে ফেলেছে? টিয়ার সততার উপর নির্ভর করা তার ভুল হয়েছে? টিয়া ঝাপসা চোখে আসিফের মুখটা পড়তে পারে। আবার অস্থির হয়ে বলে, ‘তোমার কাছে লুকাতে পারছিলাম না, তাই কষ্ট পাচ্ছিলাম। বলো, তুমি আমাকে মাফ করবে না?’  এবার সত্যি অসহ্য লাগে আসিফের, গলাও একটু চড়ে যায়, ‘তুমি আমার জায়গায় থাকলে মাফ করতে পারতে?’  ‘আই এ্যাম স্যরি, আসিফ দেখ, আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে না বলেও থাকতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। তোমাকে ঠকাতে চাইনি।’   আসিফ কোনো কথা বলে না।  উদভ্রান্ত টিয়া মুখ ফসকে বলে ফেলে, ‘আসিফ শোন, রবিনের সাথে আমি প্রায় টানা তিন বছর ছিলাম, না হয় আর একটা দিন....কী আসে যায়?’ ‘ছি টিয়া ছি! এরপরও বলছ তুমি আমাকে ঠকাওনি?’

তারপর আর কোনো কথা বলেনি টিয়া। আসিফও। শার্টের কাফলিঙ্ক খুলতে খুলতে টিয়ার দিকে একবার চোখ পড়লে এমনভাবে চোখ সরিয়ে নেয় যেন নোংরা, জঘন্য কিছুর দিকে চোখ পড়ে গেছে, ঘৃণায় মুখ বিকৃত হয়ে যায়। সারারাত বিছানার উপরে একভাবে বসে থাকে টিয়া, আসিফ কোথায় আছে, ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দেখতে সাহস হয় না। সকালে বুয়া এলে আসিফ দরজা খুলে দেয়। রাতের সব খাবার তখনও টেবিলে সাজানো, ধরাই হয়নি। টিয়াকে এসে জিজ্ঞাসা করলে বুয়া কোনো জবাব পায় না। তারপর খাবার সরিয়ে আবার সকালের নাস্তা দিয়ে দেয়। তারা কেউ টেবিলে যায় না। আসিফ অফিসের জন্য তৈরি হয় না। সারারাত জেগে বসে থেকে কাহিল হয়ে গেল কি? টিয়া উঠে এসে জানতে চায়, ‘অফিসে যাচ্ছ না?’  সোফায় এলিয়ে, বন্ধ চোখের উপরে একটা হাত রেখে সে বলে, ‘গিয়ে কী হবে?’ টিয়ার কণ্ঠস্বরে যেন মাথায় আগুন ধরে যায় আসিফের। নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে সে। আবার সবকিছুর জন্য নিজেকেও দোষের বাইরে রাখতে পারে না। সে যদি চাকরিটা নিতে টিয়াকে জোর না করত তাহলে আজ এতসব কিছু হয়তো হতোই না। এই চাকরিতে তাদের আয় বেড়েছে, সংসার বদলে গেছে। কিন্তু যেমন সংসার তাদের ছিল সেটা কোনো অংশে খারাপ তো ছিল না। সুখে ছিল তারা। আর এটা তো সত্যি যে এতকিছুর পরেও টিয়া তার কাছে কিছু লুকায়নি। একেবারে সেই প্রথম থেকেই সে তাকে সরাসরি সব বলেছে। এরকমই বা কয়জন পারে! 

আসিফকে আর কিছু বলতে না দেখে বেডরুমে চলে আসে টিয়া। সংসার ফাঁপা হয়ে গেছে, তাই অফিসের দায়-দায়িত্বও কি আসিফের কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে? হঠাৎ দরজা লাগানোর শব্দে টিয়া দৌড়ে গিয়ে দেখে আসিফ নেই। ভাবে, অফিসে চলে গেল কি? উপর থেকে আসিফকে দেখার জন্য ছুটে যায় বারান্দায়। সে গাড়ি নেয়নি, হেঁটে মেইন গেটের বাইরে চলে যাচ্ছে। যেভাবে ছিল সেভাবেই বেরিয়েছে, শর্টস আর গেঞ্জি গায়ে। টিয়া অপেক্ষা করে, আসিফ উপরে তাকাবে না? তাকায় না। একটু এগিয়ে গিয়ে দু’হাত মুঠি করে পাখির ডানার মতো দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গে আসিফ। বাসার ভেতরে কি তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল? বাইরে বের হয়েই বুঝি সে মুক্ত। এত উপর থেকেও টিয়া বুঝতে পারে আসিফ ফুসফুস ভরে বাতাস টেনে নিচ্ছে। ইচ্ছে হয়, একবার জোরে ডাকে- আসিফ, উপরে দেখ একবার! কেন যেন গলায় শক্তি জোটাতে পারে না। তবু তাকিয়ে থাকে ঝাপসা চোখে। তারপর কয়েক পা এগিয়ে আসিফ ফিরে তাকায়, সরাসরি টিয়ার দিকে। টিয়া হাতটা তুলতে গিয়েও মুঠি করে ফেলে। চোখের পানি গড়িয়ে পড়লেও ঠোঁট কামড়ে একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে। 

আসিফ তখনও তাকিয়ে আছে। এতদূর থেকে টিয়ার কান্না দেখতে পাচ্ছে কি?