যানজটের শহরে আলাদিনের চেরাগ হয়ে এসেছিলো মেট্রোরেল। দূষণহীন, আরামদায়ক আর দ্রুত গতির নিরাপদ যাত্রায় আশীর্বাদ হয়ে ওঠা এই গণপরিবহনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিলো নগরবাসী। কিন্তু কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নাশকতাকারীদের হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো এই স্বপ্নের মেট্রোরেল। আর তাতে আবারো পুরোনো ভোগান্তি পড়লো এই রুটে চলাচলকারী মানুষ।
ঠিক কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হলো এই গণপরিবহন আর কবেই বা খুলে দেওয়া সম্ভব হবে-তা বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত সুখবর নেই মেট্রোরেলে। এজন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে পারে নগরবাসীকে।
জানতে চাইলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের পাবলিক রিলেশনস অফিসার নাজমুল ইসলাম ভুইয়া রাইজিংবিডিকে জানান, তদন্ত কমিটি কাজ করছে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে। আসলে এই মুহূর্তে কোনো আপডেট নেই। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মেট্রোরেল। যে কারণে এটা নিরুপণ করা একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানায়, কোটা আন্দোলনের কমপ্লিট শাটডাউনের মধ্যে গত ১৮ জুলাই মেট্রোরেল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই সময় মিরপুর-১০ এর মেট্রো স্টেশনের নিচে পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়ার পর ডিএমটিসিএল এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরদিন সন্ধ্যায় মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় নাশকতাকারীরা। তারা টিকেট ভেন্ডিং মেশিন, মূল স্টেশনে যাত্রী প্রবেশের পাঞ্চ মেশিনসহ সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। নিয়ে যায় অনেক মূল্যবান জিনিস।
একইভাবে পল্লবী ও ১১ নম্বর স্টেশনেও হামলা হয় একই দিন। সেখানেও উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতি হয়েছে। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত ৬ দিনে আর মেট্রোরেল চলেনি রাজধানীতে।
এই হামলায় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির নিরূপণে ডিএমটিসিএল আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত সচিব মো. জাকারিয়াকে, সদস্য সচিব করা হয়েছে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) ইফতেখার হোসেনকে। কমিটিকে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
মেট্রোরেল চলাচল শুরু হওয়ার পর এই রুটে নিয়মিত চলাচল করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রাজিয়া খাতুন। মেট্রোরেল বন্ধ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার সকালে অফিসে যেতে কাজীপাড়ায় বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেল আসলে আমাদের মেয়েদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলো। নিরাপদে সহজে ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই মতিঝিল এসে নামতাম। অফিস শেষে আবার কাজীপাড়া নেমে যেতাম। ঢাকা বাসের চিত্র তো জানেনই, সেখানে ওঠা মেয়েদের জন্য একপ্রকার যুদ্ধই। কবে যে আবার মেট্রোরেল চালু হবে।’
রাজিয়ার মতো মেট্রোরেলের আরেক সুবিধাগ্রহণকারী আবির মাহমুদ। উত্তরা থেকে বাংলামোটর এসে অফিস করেন নিয়মিত। দীর্ঘ পাঁচদিন পর বুধবার অফিসে এসেছিলেন তিনি। অনেক কষ্ট সইতে হয়েছে এদিন। সেই কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেল আসার পর উত্তরার দিকে বাসা নিয়ে গিয়েছিলাম। ভালোই চলছিলো। কিন্তু এখন তো চিন্তা বেড়ে গেলো।’
নাশকতায় মেট্রোরেল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এখন উত্তরা থেকে বাংলামোটর কি পরিমাণ যানজট পেরিয়ে অফিসে আসবেন, সেটি ভেবেই চিন্তার ভাজ তার কপালে। তিনি বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ ভ্রমণ করেছি। আমাদের মেট্রোরেলে ওঠলে মনে হয় বিদেশেই আছি। যারা এটা ক্ষতি করলো এদের কোনো দেশপ্রেম নেই।’
মেট্রোরেলের ক্ষতিগ্রস্ত মিরপুর-১০ নম্বর স্ট্রেশন পরিদর্শনে বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তিনি বলেন, ‘যে স্থাপনাগুলো মানুষের জীবনকে সহজ করে, সেগুলো ধ্বংস করা আসলে কোন ধরনের মানসিকতা। ঢাকা শহর যানজটে নাকাল থাকলেও মেট্রোরেল স্বস্তি দিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির এই পরিবহন এভাবে ধ্বংস করেছে তা মানতে পারছি না।’
এদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল কবে নাগাদ চালু করা যাবে সেটি বলতে পারছে না এটি পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএন সিদ্দিক বলেন, চলতি সপ্তাহে মেট্রোরেল চালুর কোনো সম্ভাবনা নেই। আমি নিজেও জানি না মেট্রোরেল কবে চালু করতে পারব। তাই এই বিষয়ে এখন কিছু বলতে চাচ্ছি না।
তিনি বলেন, ‘কবে চালু হবে সেই ভাবনার মধ্যেই আমরা নেই। কারণ, ক্ষতির পরিমাণটা অনেক বেশি।’
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানায়, ধ্বংসপ্রাপ্ত স্টেশন ২টি ঠিক করে চালু করতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। এর আগে মেট্রোরেল চলাচল শুরু হলেও এই দুটি স্টেশনে ট্রেনের বিরতি ও যাত্রী সুবিধা বন্ধ থাকবে।