মতামত

‘নারী কোটা বাদ দেওয়ার সময় এখনও আসেনি’

গত রোববার সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ে নারী কোটা সামগ্রিকভাবে বাতিল করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আদালতের এই সিদ্ধান্তে দেশের ৬৬টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গভীর বিস্ময় প্রকাশ করেছে। মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম এক বিবৃতিতে বলেছেন, নারী-পুরুষের সমতার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে নারী কোটা অবশ্যই প্রয়োজন। আদালতের রায়ে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বাকি ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে।

মেধায় একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারী সমানতালে এগিয়ে থাকলেও নারীকে বঞ্চিত করা হতে পারে বলে মত দিয়েছেন সচেতন মহলের বিশিষ্ট নারীরা। তারা বলছেন, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নারী এমনিতেই আতঙ্কে থাকে, সরকারি চাকরিতে কোটা বাদ হওয়ার ফলে তাদের এই আতঙ্ক আরও বাড়বে।

নারী কোটা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে কি সময়োপযোগী মনে করছেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে নারী নেত্রী মালেকা বেগম বলেন, ‘কোনো সিদ্ধান্তকেই আমি সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত হিসেবে মানি না—  এটা হচ্ছে এক নম্বর কথা। আমি মনে করি, সিদ্ধন্ত যাচাই করার ক্ষেত্রে দেখার বিষয় হচ্ছে, সিদ্ধান্তটি সঠিক কিনা? বাংলাদেশের বাইরে অন্যরকম পরিস্থিতি। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে নারী কোটা বাদ দেওয়া হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তকে পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করবো না। আমি আমার দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেখবো। আমি বলছি বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে, নারী কোটা তুলে দেওয়ার কোনো অর্থই নেই।’ 

‘অনেক ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, জেনেছি; পুরুষরা বলে, তার থেকে বেশি মায়েরা বলে, মেয়েরাও বলে ‘একটি মেয়ে বড় হয়েছে বিয়ে দিয়ে দাও’। শিক্ষার মধ্য দিয়ে এগোতে এগোতে মেয়েটি কিছু (চাকরি) করতে চায়। মেয়েরা তো এমনিতেই আতঙ্কের মধ্যে থাকে। সেই আতঙ্ক আরও বাড়বে।’ বলেন মালেকা বেগম।

নারী নেত্রী এবং মানবাধিকারকর্মী খুশি কবীর বলেন, ‘এই আন্দোলন ঘিরে আমার প্রশ্ন হচ্ছে— কেন এটা ঘটেছে, কারা এটা ঘটিয়েছে, গুলি করার নির্দেশ কারা দিয়েছে? আর আমাদের এজেন্সিগুলো কোথায় ছিল যে এতো এতো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলো? যা ঘটেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে নারী কোটা একটি ছোট বিষয়। তবে নারী কোটার প্রয়োজন যে শেষ হয়ে গেছে, সেটা আমি বলছি না। কোটা সংস্কার হয়েছে সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু যে সাত শতাংশ কোটা আছে এই অংশের কতটুকু কোন কোটা হবে— সরকারের পক্ষ থেকে যারা এটা করার কথা তাদেরও মতামত নেওয়া উচিত ছিল।’

‘বাংলাদেশে এখনও নারী কোটার প্র্র্রয়োজন আছে।’ উল্লেখ করে খুশি কবীর বলেন, ‘কারণ আমাদের যে স্বভাব, যে পিছুটান সেটা এতোটাই প্রান্তিক যে নারীরা মেধাতে এগিয়ে আসলেই যে তাদের নেওয়া হবে বিষয়টা এমন নয়। অথচ বিগত দিনগুলোতে আমরা দেখেছি নারী কোটা করার পরে যেসব নারী চাকরিতে এসেছেন তারা সাংঘাতিক দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে গেছেন। এবং এগিয়ে গেছেন। সে কারণেই নারী কোটা দরকার।’ 

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় যে নারী কোটা একেবারে বাদ হয়ে গেলো, সেরকম না। উচ্চ আদালতে বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে মেধার কোটাকে ৯৩ শতাংশ দেওয়া হয়েছে। বাকি সাত শতাংশের ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং বাদবাকি দুই শতাংশ অন্যান্যদের জন্য দেওয়া হয়েছে। এই রায়ে ‘তবে’ আছে একটা। যেটার ভিত্তিতে সংস্কারের প্রয়োজন হলে সরকার আগামীতে চিন্তাভাবনা করে দেখতে পারে। কোনো সংস্কারই তো একেবারে ‘সিলগালা’ করে বন্ধ করে দেওয়া না। সবসময় সংস্কার মানেই হচ্ছে সেটা পুনঃসংস্কার হবে।’

‘নারী কোটা থাকলে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হতাম। কারণ নারীদের আলাদা করে যে গুরুত্বের জায়গা সেটা হিসাব করতে হবে। অনেক জায়গায় নারীদের সমান সুযোগ আছে কিন্তু নারীদের যে সর্বপরি বাস্তবতা, সেখানে কিন্তু তারা একটু পিছিয়েই থাকে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে আনার কথা সংবিধানেই আছে। নারী কোটা অন্তত ১ বা ২ শতাংশ থাকলেও স্বীকৃতির একটা জায়গা থাকতো। এই স্বীকৃতির দেওয়ার সুযোগ এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি।’

আগামীতে এ ধরনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সেই জায়গাটি খোলা থাকবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী। 

নারী কোটা পুনঃসংস্কারের সুযোগ রয়েছে। তবে তা ভবিষ্যৎ-এর কথা। নারীকে লড়তে হবে মেধা দিয়ে। ইতোমধ্যেই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না— অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নারীর প্রতিবন্ধকতা কম নয়। পারিবারিক, সামাজিকভাবে নানামুখি আতঙ্কে থাকার পরও নারী এগিয়ে যাচ্ছে-যাবেন। মেধার ভিত্তিতে এগিয়ে থাকা নারীকে শুধু ‘নারী’ বলেই যেন বঞ্চিত না করা হয়— এমনটাই প্রত্যাশা সচেতন মহলের।