সারা বাংলা

নারকীয় তাণ্ডবে ক্ষত-বিক্ষত রংপুর

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে দুষ্কৃতকারীদের নজিরবিহীন তাণ্ডবে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে রংপুর। সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য স্থাপনায় ভাঙচুর, যানবাহনসহ স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও নৈরাজ্যে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা। জেলা ও মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে এসব ঘটনায় ১২টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে ১৮২ জন।

বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) রংপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলা ও মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নামে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নাশকতার ঘটনায় মোট ১২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন দপ্তর।

গত তিন দিনে দেশের অন্যান্য জেলার মতো রংপুরেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে স্বস্তি ফিরছে জনমনে। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢুকে পড়া নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন এখনো সাধারণ মানুষের চোখের সামনে ভাসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেসব দুষ্কৃতকারীদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নিতে তৎপর রয়েছে। আজ শুক্রবার (২৬ জুলাই) কারফিউ শিথিল থাকায় অনেকটা স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরেছেন মানুষজন।

গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল ছিল রংপুর। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যোগ দেয় কয়েকশ’ অপরিচিত মুখ। এদিন বেলা ১১ টার দিকে রংপুর জিলা স্কুলের সামনে থেকে কোটা সংস্কারের নামে একটি বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। সেটি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে যাত্রা করে। সেখানে বেলা ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় মোড়ে দফায় দফায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারীদের।

এক পর্যায়ে আন্দোলনকরীরা বেপরোয়া হয়ে মহানগর তাজহাট থানায় তাণ্ডব চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। সেখানে চারটি কাভার্ড ভ্যান, তিনটি ট্রাক ও দু’টি মাইক্রোবাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর একে একে মহানগর ডিবি কার্যালয়, নবাবগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, সমবায় ভবন, সুপার মার্কেট, পরিবার পরিকল্পনা অফিস, আদালত, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ অফিস, ছাত্রলীগ কার্যালয়সহ অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় তাণ্ডব চালানো হয়। 

এ সময় তারা নগর পর্যবেক্ষণে থাকা শতাধিক সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়। দুষ্কৃতকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যবহৃত পাঁচটি কাভার্ড ভ্যান, ২০টিরও বেশি প্রাইভেট কারসহ শতাধিক মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। 

পরের দিন শুক্রবার (১৯ জুলাই) জুমআর নামাজের পর রংপুরে ফের বেপরোয়া হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীরা। এতে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে নামে রংপুর জেলা ও মহানগর বিএনপি, এবিপার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন চরমোনাইয়ের কর্মী সমর্থকরাও।

এদিনও রংপুর আদালত ভবন ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে হামলা চালাতে গেলে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পুলিশের। বিকেল থেকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। দুই দিনের সংঘর্ষে নিহত হন ছয় জন, আহত প্রায় শতাধিক।

এদিকে শুক্রবার (২৬ জুলাই) রাত ১২টা থেকে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশব্যাপী কারফিউ জারি হয়। এরপর ওই রাত থেকেই রংপুরের মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সতর্ক অবস্থান নেন সেনা সদস্যরা। 

রংপুরের জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসান বলেন, ‘কারফিউ জারির মধ্য দিয়ে চলমান পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। এখন থেকে কারফিউ সীমিত করে দোকানপাট অফিস আদালত খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। আশা করছি পরিস্থিতি খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটি থানা পুড়িয়ে দেওয়াসহ সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য স্থাপনায় ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা ছাত্র আন্দোলনে নেমে এই হামলায় অংশ নেয়। ভিডিও দেখে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। এছাড়াও সিসিটিভির ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কাজ চলমান রেখেছে।’

রংপুরের নৈরাজ্যকর এসব তাণ্ডবের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খসড়াভাবে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রায় ১২ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে মহানগর পুলিশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা।

রংপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনাগুলো এত ভয়াবহ যে মামলা করতে আমাদের অনেক সময় লাগছে। কারণ যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, যে পরিমাণ আলামতের ক্ষতি হয়েছে, জ্বালাও পোড়াও হয়েছে, মামলার ডকেট (নথিপত্র) পুড়েছে, পুলিশ ফাঁড়ি পুড়েছে, গাড়ি পুড়েছে। বহু কিছুর ক্ষতি হয়েছে, মামলা করতে সময় লাগবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আইনানুগ সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেব এবং পেশাগত দায়িত্ব থেকেই সেটা অতি দ্রুততার সঙ্গে করব। আমরা এজন্য নগরবাসীসহ সকলের সহযোগিতা চাই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কারফিউ জারি হয়েছে। সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনীর টহল অব্যাহত আছে। নগরজীবন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। যারা এসব নৈরাজ্যের সাথে জড়িত, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছি।’

আরপিএমপি কমিশনার আরও বলেন, ‘শুক্রবার (২৬ জুলাই) সকাল পর্যন্ত ১২টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। আরও কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে মোট ১৮২ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। যারা ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত, যাদের সম্পর্কে আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি তারাই গ্রেপ্তার হয়েছে।’

অন্যদিকে জেলা পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান জানান, রংপুরের আট উপজেলা থেকে গত কয়েকদিনে গ্রেপ্তারের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছে। বিশেষ এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

উল্লেখ্য, কারফিউয়ের শিথিল সময়ের মধ্যে অফিস ও দোকানপাট খোলা হচ্ছে। সীমিত আকারে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাস চলাচল শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত রেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। 

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড়ে কোটা সংস্কারে দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আবু সাঈদ নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হন। এ ঘটনার পর আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে গোটা জেলাজুড়ে। নিহত আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।