সারা বাংলা

মহাসড়ক যেন মরণফাঁদ

নোয়াখালী-চাঁদপুর আঞ্চলিক সড়কের লক্ষ্মীপুর জেলার অধীন ৩৬ কিলোমিটার সড়ক যেন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন এই সড়কের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলছে। এতে অকালে প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ব বরণ করছেন যাত্রী ও পথচারিরা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মূল্যবান যানবাহন ও সড়ক পরিবহনে বহনকারি মালামাল। 

সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে নোয়াখালীর চৌমুহনী চৌরাস্তা থেকে চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুরের সীমান্তবর্তী বর্ডার বাজার পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার সড়ক ১৮ ফুট থেকে ২৪ ফুট প্রশস্ত করে। কিন্তু নিম্মমানের কাজের কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সড়কটিতে কার্পেটিং উঠে গিয়ে খানাখন্দকে ভরে যায়। এরপর দফায় দফায় সড়কটি সংস্কার করা হলেও তা কোন কাজে আসছে না।

গত জুন মাসের শেষ দিকে ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে এই আঞ্চলিক মহাসড়কের হাজির পাড়া থেকে মান্দারী পর্যন্ত এসবিএসটি মেরামত করা হলেও তা এক সপ্তাহের মধ্যেই আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে এই সড়কের এমন এক মিটার সড়ক খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে কোন রকমের খানাখন্দক নাই। পুরো সড়ক জুড়েই রয়েছে খানাখন্দক। বড় যানবাহন কোন রকমে চলতে পারলেও মোটর সাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা, প্রাইভেটকারসহ ছোট চাকার যানবাহন চলাচল কঠিন হয়ে পড়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই এই সড়কে খানাখন্দক, দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ ও সড়কের জমি জবর দখল মুক্ত করার জন্য লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক পিংকু মে মাসের প্রথম সপ্তাহে জেলা আইনশৃংখলা কমিটির সভায় জেলা প্রশাসন ও সড়ক বিভাগকে জোরালো নির্দেশ দিলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে জানা গেছে।

লক্ষ্মীপুরের সড়ক বিভাগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে  দ্রুত লক্ষ্মীপুরের সড়কের জমি অবৈধ দখল উচ্ছেদ করার জন্য গত মে মাসে লক্ষ্মীপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে পত্র দেওয়া হয়। তিনি গত ২৫ মে জেলা প্রশাসককে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করার জন্য ম্যাজিস্ট্রট নিয়োগ দেওয়ার জন্য একটি আবেদন ও অবৈধ দখলদারদের দ্রুত সময়ের মধ্যে সড়কের জমি থেকে তাদের দোকানপাট ও স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা সম্বলিত মাইকিং করেই তার দায়িত্ব শেষ করেন।

অপর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সড়ক বিভাগের অবৈধ উচ্ছেদ সংক্রান্ত মাইকিংয়ের পর অবৈধ দখলদারদের সংঘবদ্ধ চক্র সড়ক বিভাগের কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করার কথা বলে প্রতিটি বাজার থেকে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন করে। সে টাকার একটি অংশ কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে। ফলে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়ে আছে।

এ ব্যাপারে জানতে লক্ষ্মীপুরের সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলামের বক্তব্য জানার জন্য রবিবার তার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।

লক্ষ্মীপুর সড়ক বিভাগের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মোশারফ হোসেন জানান, সড়কটি ফোর লেনে উন্নীত করার জন্য সম্প্রতি একনেক বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর প্রাক্কলন তৈরি করা হচ্ছে। সড়কটি ফোরলেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হলে অবৈধ দখল উচ্ছেদ হয়ে যাবে এবং সড়কটিতে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে।   বাংলাদেশ রোডস অ্যান্ড টান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক সড়ক সূত্রে জানা যায়, গত ৭ মাসে এই জেলার সড়কে ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন অন্তত ৫০ জন। চলতি জুলাই মাসে মারা গেছেন ১০জন। প্রতিদিন এই জেলার সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলছে। বর্তমানে সড়কে যানবাহন চলাচল কম থাকলেও গত বুধবার এই সড়কের পৃথক দুইটি স্থানে দুইজন পথচারির মৃত্যু হয়েছে।

সড়কে এই দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর জন্য সংশ্লিষ্টরা সড়কের অপ্রশস্ততা, চালকের অদক্ষতা, সড়কের উপর অসংখ্য হাট বাজার, সড়কের দুই পার্শ্ব জবর দখল, একই সড়কে যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক সব ধরনের যানবাহনের চলাচল ও যানবাহনের বেপরোয়া গতি ও যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আইন প্রয়োগকারি সংস্থাগুলো আইনের বাস্তবায়ন না করাকে দায়ী করেছেন নিরাপদ সড়ক চাই-লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার সভাপতি, সাবেক জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আশফাকুর রহমান মামুন।

লক্ষ্মীপুর বিআরটিএ-এর মোটরযান পরিদর্শক প্রণব চন্দ্র নাগ বলেন, লক্ষ্মীপুর বিআরটিএ সড়কে শৃংখলা বজায় রাখার জন্য মোবাইল কোর্ট  পরিচালনা ও নানা সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছেন।

অপরদিকে লক্ষ্মীপুরের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টি আই) প্রশন্ত কুমার দাস বলেন, জেলা ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। প্রতিদিনই যানবাহন জব্দ ও জরিমানা করা হচ্ছে। এ জেলার সড়কে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে বেপরোয়া গতির ড্রাম ট্রাকের কারণে। শত চেষ্টা করেও ড্রামট্রাকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। 

লক্ষ্মীপুর বাসমালিক গ্রুপের সভাপতি অ্যাড. সৈয়দ ফখরুল আলম নাহিদ বলেন, সড়কে বেপরোয়া গতির অবৈধ ড্রাম ট্রাক, একই সড়কে যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল, বাজারের উপর অসংখ্য হাটবাজার, যানজট ও সড়কের অপ্রশস্ততা, সড়ক জুড়ে খানাখন্দকের কারণে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।

চাঁদপুর- নোয়াখালী রুটে চলাচলকারি আনন্দ পরিবহনের চালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আনন্দ পরিবহন  লোকাল বাস। এই বাস চলাচলের জন্য সময় নির্ধারিত। লক্ষ্মীপুর ঝুমুর থেকে নোয়াখালীর চৌরাস্তা পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার দূরত্ব পার হওয়ার জন্য ৫০ মিনিট সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ৩০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৭টি বড় বাজারসহ ১৫টি ছোট বড় বাজার রয়েছে। প্রতিটি বাজারেই যানজটে গাড়ি আটকে থাকে। এতে নির্ধারিত সময় যানজটেই পার হয়ে যায়। ফলে চালকদের বাধ্যহয়েই বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে।

চন্দ্রগঞ্জ বাজারের গাড়ির কাউন্টার মালিক নুরুল আমিন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু যাত্রী ও পথচারিরা মারা যায় না, চালক-হেলপারও মারা যান। গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।