মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, নারী নেত্রী এবং মহিলা সমিতির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সম্প্রতি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ফলে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনকে ‘সংবিধানবিরোধী’ বলে মনে করছেন ফওজিয়া মোসলেম। রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপকালে ‘নারী কোটা রহিত’ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি তার ভাবনার কথা জানিয়েছেন। কথোপকথনে ছিলেন স্বরলিপি
রাইজিংবিডি: কোটা সংস্কার আন্দোলন যাকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’। আন্দোলনের ফলে কোটা পদ্ধতির সংস্কার হয়েছে। এখন আর নারীদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা রইল না— এই সিদ্ধান্তকে কীভাবে দেখছেন?
ফওজিয়া মোসলেম: আমি মনে করি, এই সিদ্ধান্ত একেবারেই অসাংবিধানিক। কোটা সংস্কারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘নারী কোটা বাদ হয়ে যাচ্ছে’— বিষয়টি শুধু এই শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, তার সঙ্গেও এটি সাংঘর্ষিক। এটি নারীকে আরও বৈষম্যের মুখে ফেলবে। ছাত্র সমাজ যে ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনকে ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’ বলছে সত্যিকার অর্থে সেটা হলো না বলেই আমি মনে করি। নারী তথা সামগ্রীকভাবে বৈষম্য সৃষ্টি হলো। নারীর বর্তমান সময়কালের যে অগ্রগতি, এতে সমাজ এমনিতেই প্রতিকূল হয়ে উঠেছে। নারী যত এগিয়ে আসছে, সমাজ তত প্রতিকূল হয়েছে। এই অগ্রগতি যদি বাধাগ্রস্ত হয়, নারীর প্রতি সমাজের যে বৈষম্যমূলক মানসিকতা আছে সেই মানসিকতা আরও দৃঢ় হবে। এতো আন্দোলন, এতো কিছু হওয়ার পরে নারীর সমতার অগ্রগতি খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। এখনও অনেক জায়গায় কাজ করতে হবে। আমরা কিছু জায়গা ধরে এগোচ্ছিলাম। যদিও নারীর দৃশ্যমান অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আবার অনেক জায়গা নিয়ে কাজ করার বাকি রয়ে গেছে। এই সময় ‘নারী কোটা’ বিলোপ হয়ে যাওয়া আমাদের জন্য অ্যালার্মিং।
রাইজিংবিডি: আমরা দেখেছি, কোটা সংস্কার আন্দোলনে অনেক ছাত্রী অংশ নিয়েছেন— এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ফওজিয়া মোসলেম: যেসব ছাত্রী কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে তারা প্রান্তিক নারীর অবস্থা যথাযথভাবে জানে না।
রাইজিংবিডি: এর আগে ২০১৮ সালেও নারী কোটাসহ সব কোটা বাদ দেওয়া হয়েছিল।
ফওজিয়া মোসলেম: ২০১৮ সালে যখন নারী কোটা বাদ দেওয়া হলো তখন পুরো কোটা বাদ দিয়ে দিলো সরকার। তখন আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম যে, এই সিদ্ধান্ত ঠিক হচ্ছে না। এরপরে বিষয়টা যখন কোর্টে (আদালতে) চলে গেলো তখন তো আর কিছুই বলার থাকলো না।
রাইজিংবিডি: ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) বলছে, শ্রমবাজারে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণের কথা।
ফওজিয়া মোসলেম: সব জনগোষ্ঠী সমানভাবে এগিয়ে নেই। সমাজের অভ্যন্তরে অনেক বৈষম্য আছে। সব বৈষম্য দৃশ্যমান হচ্ছে না। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এগিয়ে নেওয়ার জন্য এতদিন কোটা ব্যবস্থা ছিল— সেই সুযোগ থাকলো না। এর মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়লো। ফলে আইএলও যে লক্ষ্য বা যেসব গোল সেট করেছে সেগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। পুলিশে মহিলারা ঢুকতেই পারবে না! সামগ্রীকভাবে এই সিদ্ধান্ত নারীকে অসম্ভব পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দুটি উপায়ে নারীর প্রতি বৈষম্য কমানো যেতে পারে। প্রথম শর্তই হচ্ছে— নারীর প্রতি সংবেদনশীল হওয়া এবং দ্বিতীয় শর্ত হলো, নারীর যে অধিকারটুকু আছে সেটুকু সে যেন পেতে পারে; সেটা নিশ্চিত করা।