সাতসতেরো

‘সাড়ে পাঁচমিশালি’ নিয়ে তনুশ্রীর সফল পথচলা

আম পেঁয়াজের ঝুড়ি আচার, ম্যাশড আম, গুড় আম, চালতার টক ঝাল মিষ্টি আচার, চোকাসহ আমের আচার, কাশ্মীরি আচার, রসুনের আচার— এমন নানা পদের আচার বানান তনুশ্রী হালদার। নাম শুনলেই জিভে জল আসে! কথায় আছে, যে কাজে আনন্দ পাওয়া যায় সেই কাজে মানুষ বিফল হয় না। তনুশ্রী হালদারের ক্ষেত্রে তেমনটাই হয়েছে।

তনুশ্রী হালদার একাডেমিক্যালি পড়াশোনা করেছেন পলিটিক্যাল সায়েন্সে। মাস্টার্স পাস করার পরে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু হয়নি। বিয়ের পরে চাকরি করার ইচ্ছাটাও চলে যায়। সংসারে মনোযোগী হন তনুশ্রী। স্বামী, সন্তান নিয়ে সংসার তার। একটা সময় মনে করেন নিজের কিছু করা উচিত। চিন্তা করলেন আচার বানাবেন আর সেই আচার পৌঁছে দেবেন খাদ্যরসিক মানুষের কাছে।

তনুশ্রী বলেন, ‘ভীষণ আনন্দের সাথে করে যাচ্ছি। প্রায় ৩০ পদের আচার বানাই। সব আচারই সিজনাল ফলের হয়ে থাকে। কুরিয়ার সার্ভিস গুলোর মাধ্যমেই পুরো বাংলাদেশে আচার পৌঁছে দিতে পারছি। তবে ঢাকায় ক্রেতাদের কাছে আচার পৌঁছানোর দায়িত্বে নির্ধারিত একজন সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তনুশ্রীর আচার বিক্রির পেইজ রয়েছে। তার পেইজের নাম ‘সাড়ে পাঁচমিশালি’। বাজারে যখন যে ফল পাওয়া যায় সেসব ফলের টক, ঝাল, মিষ্টি আচার তৈরি করেন তনুশ্রী। কখনো কখনো ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কাস্টমাইজড আচারও তৈরি করে দেন। তনুশ্রীর সাড়ে পাঁচমিশালির খোঁজ এখন দেশের অনেক নারী-পুরুষেরই জানা। আর তার বানানো আচারের ক্রেতাও নারী পুরুষ উভয়ই। 

ক্রেতাদের নতুন ধরনের আচারের চেয়ে পুরনো রেসিপির আচারের চাহিদা বেশি।

তনুশ্রী বলেন, ‘কাজ করতে  গিয়ে  তিন বছরে  দেখলাম, একদম নতুন  আচারের  থেকে। যে আচারগুলো একদম পুরোনো— অর্থাৎ আমাদের  দিদিমাদের আমলের; এখনও মানুষ সেসবই বেশি পছন্দ করেন। এতটুকু বুঝেছি, সময়ের অভাবে মানুষ  আচার  বানাতে  চান না, তবে খেতে  চান। মানুষ খাবারে খুঁজে পেতে চান পুরনো স্বাদ। সেজন্য  আমার পেইজে বেশির ভাগ আচারই পুরোনো দিনের রেসিপিতে বানানো। তবে ফিউশন বা নতুন আচারও ক্রেতাবন্ধুরা নিয়ে থাকেন।’

তনুশ্রী জানান, বাজারের জিনিস পত্রের দামের সাথে  সমন্বয় করে আচারের দাম নির্ধারণ করেন তিনি। কাঁচামাল  যে দামে কেনা হয় সেটার ওপর নির্ভর করে আচারের দাম। 

সাড়ে পাঁচমিশালি নামটা মানুষের কাছে কীভাবে পৌঁছালো? প্রশ্নের জবাবে তনুশ্রী জানান, তিনি নিজে প্রচারণা করেছেন। বিভিন্ন উদ্যোক্তা গ্রুপে নিয়মিত তার পণ্য নিয়ে লিখেছেন, নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রচারণা চালিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন এক্সিবিশনের অংশ নিয়েছেন তিনি। কখনো কখনো পেইজ বুস্টও করেছেন। কাজ এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভাই, বোন, হাসবেন্ডসহ পরিবারের প্রত্যেকের সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি।

২০২২ সালে তনুশ্রী হালদার কাজ শুরু করেন। তবে হুট করেই শুরু করেননি। কোন পণ্য নিয়ে, কীভাবে কাজ করলে সফলতা পাওয়া যাবে সেই বিষয়ে জেনে বুঝে তারপর শুরু করেছেন। তনুশ্রী হালদারের কাজের পরিধি বেড়েছে। তার কাজে দুই জন কর্মী সবসময় সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। 

তনুশ্রী জানান, কখনো কখনো কাজের চাপ বেশি থাকে তখন চুক্তি ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়।

তনুশ্রী আরও বলেন, ‘শুরুতে রান্না নিয়ে কাজ করবো চিন্তা করি। প্রথমে সব ধরনের রান্না নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে থাকলেও, পরে একটা আইটেম ‘আচার’ নিয়ে কাজ শুরু করি। আচার  বানানো শেখার জন্য আমার দিদিমা, মাসিমা, মামি এদের কাছ থেকে রেসপি নিয়ে নিজে নিজে করেছি। এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে শিখেছি, প্রতিনিয়ত শিখছি।’

তনুশ্রী ২০১৫ সালে ফটোগ্রাফির একটি বেসিক ফাউন্ডেশন কোর্স করেছিলেন। উদ্যোক্তা জীবনে ওই কোর্সটা খুব কাজে লেগেছে তার। 

তনুশ্রী বলেন, ফটোগ্রাফি শেখার পরে বিভিন্ন  এক্সিবিশনও করতাম। সেকেন্ড বেবি হবার পরে আর পারতাম না। তবে কোনো শিক্ষায় বিফলে যায় না, অনলাইন বিজনেসে ছবিটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন সেই  শিক্ষাটা আমার উদ্যোগের পণ্যের ছবি তোলার কাজে লাগছে।

সাফল্যের গল্পটা যেমন— তনুশ্রী বলেন, ‘মাত্র ৫০০ টাকার জলপাই-এর সাথে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে কাজটা শুরু করেছিলাম। প্রথম মাসেই যমুনা ফিউচার পার্কে একটা গ্রুপেরসাথে এক্সিবিশন করেছিলাম। সেখানে এতো পজিটিভ রেসপন্স পাবো আশা করিনি। ব্যাস, সেখান থেকেই আমার আগ্রহ এবং সাহস বাড়লো। এখন মাসে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় হয়।

উদ্যোক্তা জীবন সম্পর্কে যদি কিছু বলতে হয়— তনুশ্রী হালদার বলেন, ‘উদ্যোক্তা  জীবন আমার ব্যক্তিজীবনেও প্রভাব ফেলেছে। এখন  নিজের উপার্জনের একটা পথ হয়েছে। আমার সাথে যারা কাজ করছে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। আমার মাধ্যমে  কারো কারো উপার্জন হচ্ছে,এটা একটা  আত্মতৃপ্তি দেয়। প্রচুর ক্রেতাদের সাথে বন্ডিং হয়েছে, এটাও একটা প্রাপ্তি। একটা  ঘটনা শেয়ার করি, একটা  এক্সিবিশনের পরে একজন আমাকে খুঁজে টেক্সট করেছেন ‘আপু আপনার আচার আর আপনাকে ভালো লেগেছে।’ অনেকে এএক্সিবিশনে দেখা করতে আসেন পরিচয় দেন,  এই ভালোলাগাগুলো আগে  ছিলো না, এগুলো  আমার উদ্যোক্তা  জীবনের প্রাপ্তি।  ক্রেতাবন্ধুদের ভালোবাসা ছাড়া আমি এতদূর আসতে পারতাম না,সাড়ে  পাঁচমিশালিও এতোটা পথ চলতে পারতো না।’

তনুশ্রীর স্বপ্ন সাড়ে পাঁচমিশালির কাজ আরও সম্প্রসারিত করা আরও মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।