মসলিন, সিল্ক অথবা সুতি শাড়ির জমিনে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মোটিফগুলো ফুটিয়ে তোলেন গ্রামীণ নারী হস্তশিল্পীরা। আর শাড়ির নকশা নির্ধারণ করে দেন নাসরিন আকতার। এই উদ্যোক্তা নিশা নামেই অধিক পরিচিত। পনেরোজন নারী হস্তশিল্পীদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি। যারা এক একজন আলাদা আলাদা হাতের কাজে পারদর্শী। তাদের যৌথ কাজের প্রতিফলন ফুটে ওঠে এক একটি শাড়িতে। সেই শাড়িতে নারী নিজেকে সাজাতে অথবা কোনো পুরুষ তার প্রিয়জনকে সাজিয়ে দিতে নাসরিন আকতারের ফ্যাশন হাউসের শাড়িগুলো কিনে নেন। যারা কিনে নেন অনেক সময় তারাই এই শাড়ির প্রচারণা চালান। এভাবে দেশ কিংবা বিদেশের শাড়িপ্রেমীদের কাছে পৌঁছে গেছে নাসরিন আক্তারের স্বপ্ন ও শ্রমে গড়া প্রতিষ্ঠান M & N এবং Closet by M&N-এর শাড়ি।
নাসরিন আক্তার নিশা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার মেইন প্রোডাক্ট হাতের কাজ করা পোশাক। যেমন-শাড়ি, জামা ইত্যাদি। ডিজাইন, ফেব্রিক্স, কালার এগুলো আমি ঠিক করে কারিগরদের কাছে পাঠিয়ে দেই। তারপর এক একটি শাড়ি তৈরি হয়। কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, কাজ বুঝিয়ে দেওয়া এগুলো দেখাশোনার জন্য একজন ম্যানেজার আছেন। তিনিই সব করেন।’
নাসরিন আক্তার নিশার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পটা জানতে চাইলে বলেন, ‘ শুরুটা একদমই হঠাৎই। কিছু একটা করতে চাই, এই ইচ্ছে সব সময়ই ছিলো। মা হওয়ার পরে মনে হয়েছে অনলাইনে তো কিছু একটা শুরু করতেই পারি। নিজে কিছু করতে পারলে মেয়েটাকে টেক কেয়ার করতে পারবো, পাশাপাশি আমারও কাজের মধ্যেই থাকা হবে।– এই ভাবনা থেকে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে কাজ শুরু করি। তখন মোটামুটি অনলাইনে কেনাকাটা সম্পর্কে মানুষ জানা শুরু করেছে। শুরুটা ধীরে এগিয়েছে। সব কিছু বুঝে উঠতে এবং কর্মীদের সেট করতে দুই বছর সময় লেগেছে। শুরুতে আমার হাউসের শাড়িগুলো পরিচিত জনেরা কিনতেন। এরপর ধীরে ধীরে ক্রেতা বাড়তে থাকে। আমার সব সময়ই চেষ্টা থাকে আমাদের দেশের ওয়েদারের সাথে যেনো কমফোর্টেবল হয় এমন শাড়ি, পোশাক তৈরি করা।যেহেতু আমার ফ্যাশন হাউসের শাড়ি-পোশাক দেশের বাইরেও যায়, তাই প্রোডাক্ট ফেব্রিক্স, ডিজাইন সব কিছুই উন্নত মানের দিয়ে থাকি। এতে খরচ বাড়ে কিন্তু কোয়ালিটি আমার কাছে প্রাধান্য পায় বেশি। আর কোয়ালিটির সাথে কখনও কম্পোমাইজ করিনা। আমার মেইন ফোকাস থাকে উন্নত মানের ফেব্রিক্স আর ডিজাইনের ওপর। একদম সিম্পল ডিজাইনেও চমৎকার একটা লুক আনা যায়। বেক্সি ভয়েল, সুতি, মসলিন, সিল্কে বেশি কাজ করা হয়।’
প্রচারণা এগিয়ে নেওয়ার জন্য নাসরিন আক্তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেছেন। M & N নামে ফেসবুক পেইজ খুলে শুরুতে বুস্ট করেছেন। এরপর রিপিট কাস্টমার বা ক্রেতারা অন্যদের রেফারেন্স করেছেন— এগিয়েছে প্রচারণা। পরবর্তীতে ব্যাকআপ পেইজ হিসেবে এবং Closet by M&N পেইজেও প্রচারণা চালান।
এই সময়ে ট্রেন্ডে দেখা যায় পরিবারের সদস্যদের ম্যাচিং পোশাক পরতে। নাসরিন আক্তার পরিবারের সদস্যদের জন্য ম্যাচিং ড্রেসও তৈরি করে দেন। জনপ্রিয়তার পাওয়ার এটাও একটা বড় কারণ বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাসরিন আক্তার ছোটবেলা থেকে শাড়ি পছন্দ করতেন ।
তিনি বলেন, ‘শাড়ির প্রতি ভালোলাগা ভালোবাসা ছিলো ছোটবেলা থেকেই। আম্মুকে দেখতাম হাতের কাজ করা শাড়ি পরতে। তখন থেকেই ওই দিকে একটা ঝোঁক কাজ করতো। তবে আমি চেষ্টা করেছি এবং এখনো করছি নকশায় নতুনত্ব আনতে। কমন কিছু আমার ভালো লাগেনা।’
শুরুটা ধীরে হলেও বর্তমানে নাসরীন আক্তারের কাজের পরিধি এবং আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।
এই সফল উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমার কাজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বেড়েছে তখনই যখন দ্বিতীয়বার অর্ডার প্লেস করার সময় ক্রেতা শুধু রং আর ফেব্রিকের কথা বলেছেন কিন্তু নকশা কেমন হবে সেটা পুরোপুরি আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, কাজের সার্থকতা এখানেই। অনেকেই আছেন পেমেন্ট আগেই করে দিতে চায়। এমনকি অর্ডার প্লেস করার আগেই! এই যে বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি। এটাই বিশাল পাওয়া, যদিও অনেকটা সময় লেগেছে।’
নাসরিন আক্তারের স্বপ্ন দেশের ঐতিহ্য ছড়িয়ে যাবে পুরো বিশ্বে। এই লক্ষ্যে তার জায়গা থেকে ফ্যাশন সেক্টরে কাজ করতে চান। একই সঙ্গে হস্তশিল্পীরা যাতে মূল্যায়ণ পান সেদিকেও খেয়াল রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তিনি।
তিনি বলেন, এর জন্য আমরা যারা এই সেক্টরে কাজ করি সবার কোয়ালিটির দিকে আরও খেয়াল রাখা উচিত। আর এখনো কেউ কেউ আছেন যারা হাতের কাজের মূল্য দিতে চায় না। মনে করেন হাতে তৈরি জিনিস এর দাম হবে কম। অথচ বিষয়টা তা না, শুধু কাপড়, সুঁই- সুতো না, হাতে তৈরি মানে আমি থেকে শুরু করে প্রতিটি স্টেজে যারা কাজ করছেন, একবারে গ্রামের সেই নারী কর্মী পর্যন্ত আমরা সবাই কিন্তু আমাদের মেধা, সময়, শ্রম দিচ্ছি। তারপর এতো সুন্দর সুন্দর ডিজাইন গুলো উঠে আসছে। এর সঠিক মূল্য তো দিতে হবে। আর এসবের মূল্য কি করে কম হয়!