আশফাক নিপুন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। আন্দোলন সফল হয়েছে। সরকারের পদত্যাগের পর গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা রয়েছে। সাধারণ মানুষের মতো নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন নির্মাতারা। রাইজিংবিডিকে নিজের প্রত্যাশা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ভাস্কর্য ভাঙচুর, সহিংসতা এবং চলচ্চিত্র-ভাবনার কথা জানিয়েছেন এই নির্মাতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনার্য মুর্শিদ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছেন। একটি পরিবর্তনের প্রত্যাশায় রয়েছে দেশের মানুষ। এমন অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট আপনার প্রত্যাশা জানতে চাচ্ছি।
আশফাক নিপুন : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। কারণ আমরা গত ১৫ বছর যে দুঃশাসন দেখেছি এবং সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ সহজ ছিল না। অনেক প্রাণ চলে গেছে। অনেকদিন আমাদের ছাত্র-জনতাকে রাস্তায় থাকতে হয়েছে। শুধু ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছে এমন নয়, জনতাও প্রাণ দিয়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ এই তালিকায় ছিল। এত কিছুর পর যখন বিজয় অর্জিত হয়, তখন প্রত্যাশাও অনেক বেশি থাকে।
যে কারণে আমরা আন্দোলনটা করেছি; একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র, মানবিক রাষ্ট্র এবং নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রত্যাশা থেকে। গত ১৫ বছর অনিয়ম, দলীয়করণ প্রশাসনের প্রতিটি সেক্টরে জেঁকে বসেছিল। সচিব থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত। তো এখন প্রতিটি সেক্টর যেন বিশেষভাবে একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে চলে আসে। অর্থনৈতিক দিকটা যেন ঠিকঠাকভাবে সামাল দেয়া যায়। কারণ আমরা দেখেছি, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে এত পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার ঘটনা ঘটেনি।
গত স্বৈরশাসকের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল প্রভাবশালী মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী যারাই সরকারঘনিষ্ঠ ছিল তাদের কাউকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। একটা সময় আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, এদের বিচার হবে না। যদিও জনগণ চিহ্নিত করতে পারত কাদের বিচার হবে না। কাজেই সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে, যাতে জনগণের মনে স্বস্ত্বি ফিরে আসে। জনগণের মনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে- বিচার চাইলে বিচার পাব।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষ ভাস্কর্য ভাঙছেন। তাদের রোষ থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও রেহাই পাচ্ছে না।
আশফাক নিপুন: এটা অবশ্যই অন্যায়, আইনের লঙ্ঘন। কারণ আপনি দেশের জাতির জনকের যে অবদান, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারেন না। এই আন্দোলনে আমরা আবু সাইদকে পেয়েছি, মুগ্ধকে পেয়েছি যারা এই সময়ের বীর। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের আজন্ম বীর। তার ৩২ নাম্বারের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, ভাস্কর্য ভাঙা, বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য ভাঙা, এগুলো কোনোভাবেই জাস্টিফাই করা যায় না। এখানে যেভাবে বলা হচ্ছে, ক্ষোভের আস্ফালন, উল্লাস- ক্ষোভ বা উল্লাসের কারণে কেউ কখনো বাবা-মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারে না। যে ভাস্কর্যগুলো ভাঙা হচ্ছে সেগুলো ইতিহাসের অংশ। এগুলো যারা ভাঙচুর করছে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। শুধু তাই নয়, ভাস্কর্যগুলো যাতে পুনরায় গড়ে তোলা যায় সে উদ্যোগ নেয়া উচিত। ভাঙচুরের কালচারটা যেন আর না বাড়ে, এটা অবিলম্বে এখনই কঠোরভাবে দমন করা উচিত।
দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ভাঙচুর এবং ভাস্কর্য ভাঙচুরের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না?
আশফাক নিপুন: এত বড় ক্রাইম; এটাকে একই সূত্রে বাঁধা বললে ভুল হবে। আলাদাভাবে বিচার করতে হবে। শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করার পরে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়ার আগ পর্যন্ত তিনদিন কোনো সরকার ছিল না। বিভিন্ন মহল, বিভিন্ন গোষ্ঠী, আসলে পার্টিকুলারলি কোনো একটি দল- এভাবে বলা যায় না। কারণ যে অগ্নিসংযোগ করে, ভাঙচুর করে সে অপরাধী। তার কোন ধর্ম, বর্ণ বা মতাদর্শ রয়েছে সেটা আমার দেখার বিষয় না। অপরাধ অপরাধই।
যে কোনো ক্রান্তিকাল আসলেই আমরা দেখি সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার হয়। কোনো কিছু হলেই সফট টার্গেট তারা, তাদের উপর হামলা হয়। আমরা বিগত সরকারের আমলেও দেখেছি সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার। আপনি যদি এভাবেও বলেন, পুলিশের আইজিপি বেনজীর আহমেদ গোপালগঞ্জের একটা বড় অংশ জোর করে কিনে নিয়েছিলেন ভয় দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে; সরকারে থাকা অবস্থায়। আর এবার যে ভাঙচুর হলো- এটা প্রতিবারই হয়।
আশার কথা হচ্ছে, এবার আমাদের দেশের ছাত্র-জনতা যখন দেখল যে পুলিশ নেই, তখন নিজেরাই কমিটি বানিয়ে এটাকে প্রটেক্ট করতে শুরু করল একদম প্রথম দিন থেকে। আমি চট্টগ্রামে দেখেছি, চকবাজারে যখন একটা বড় মন্দির ভাঙতে আসলো তখন চকবাজারের লোকজন আটকে দিলো। পাহাড়তলী, সরাইলেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ভাঙচুর অবশ্যই হয়েছে, কিন্তু এই যে সম্প্রীতির জায়গাটা জনগণের মধ্যে রয়েছে সেটা আশা জাগায়।
রাজপথে আন্দোলনে প্ল্যাকার্ড হাতে
আবার দেখুন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙা হয়েছে আলাদা করে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন? মন্দির ভাঙা যেভাবে নিন্দনীয়, মাজার ভাঙাও নিশ্চয়ই সেভাবে নিন্দনীয়। আমি সব কিছুকেই নিন্দনীয় ভাবি। কিন্তু সংখ্যালঘুদের সাথে আমি মাজার ভাঙাকে জাস্টিফাই করতে চাই না। সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের ইতিহাস পুরোনো। বেশিরভাগ সময়ই সংখ্যালঘু আমাদের এখানে অনিরাপদ বোধ করে।
এ রকম কী মনে হতে পারে যে সালাফিজমের উদ্ভব হচ্ছে?
আশফাক নিপুন: সালফিজমের উদ্ভব না কি গ্লোবাল পলিটিক্সের অংশ, আবার এটাও দেখা যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের স্ক্রীনশট- আগুন দাও। আসলে এটা যে কারা করছে আমি ক্লিয়ারলি বলতে পারব না। তবে আমি সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার পক্ষে। আপাতত কারা করছে দেখার চেয়ে, ওদের নিরাপত্তা দেয়াটা সবচেয়ে বেশি দরকার। এটা যারা করছে তারা যে দল, মতবাদ বা আদর্শের হোক না কেন, তারা শত্রু।
এমনকি ডাকাতির বেলাতেও একই ঘটনা ঘটেছে। কে যে করছে যতক্ষণ পর্যন্ত পুলিশ না ধরছে, আমরা বলতে পারছি না। তবে আমাদের দেশের মানুষ যা করে দেখিয়েছে এটা বিশাল ব্যাপার! আমাদের সেই নব্বইয়ের ‘মহল্লা কালচার’ আবার ফেরত এসেছে- মহল্লায় মহল্লায় পাহারা দেয়া। এটা একটা ইউনিটি। ছাত্র আন্দোলন থেকে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। আর আন্দোলন পরবর্তী যে একটা বিশাল প্রাপ্তি এটাকে আমি অনেক বড় করে দেখি। এখন আমরা খুব ইউনাইটেড- এটাই আমাকে খুব আশা জাগায়।
পুলিশ নিয়ে আপনি ওয়েব সিরিজ করেছেন। দারুণ প্রশংসা পেয়েছে কাজটি! পুলিশ নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার গবেষণা রয়েছে। আপনি জানেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশ কর্মবিরতি পালন করছে।
আশফাক নিপুন : এ জন্য পুরোপুরি দায়ী বিগত স্বৈরাচারী সরকার। পুলিশের মধ্যে অনেক ভালো মানুষ রয়েছে। আমি যখন ‘মহানগর’ সিরিজটি করি; যখন আমি পুলিশ নিয়ে ঝামেলার মধ্যে পড়েছিলাম তখন অনেক পুলিশ সাহায্য করেছে। এই আন্দোলনেও দেখা গিয়েছে যেমন অনেক পুলিশ গুলি চালিয়েছে, তেমনি অনেক পুলিশ আবার আহতদের নিয়ে হাসপাতালেও গিয়েছে। বিগত সরকার জনগণের ভোটের অধিকারকে নষ্ট করেছে, ফলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রশাসনে দলীয়করণ করেছে। পুলিশে প্রচুর পরিমাণ দলীয়করণ করা হয়েছে। ফলে সুবিধাভোগী পুলিশ মানুষের উপর অত্যাচার করেছে। থানা হামলা করার কালচার কিন্তু আমাদের দেশে ছিল না। কিন্তু এখন হঠাৎ করে কেন থানা হামলা হলো? এটি ওই দলীয়করণের ফল। পুলিশের উপর মানুষের বিশ্বাস উঠে গেছে। এ কারণে বেশিরভাগ পুলিশকেই জীবনের ভয়ে পালাতে হয়েছে।
শরীয়তপুরে পুলিশ বলেছে কোনো দলীয় কাজে তাদের যাতে ব্যবহার করা না হয়। পুলিশের পক্ষে ১১ দফা দেয়া হয়েছে সেখানেও এই প্রসঙ্গ আছে।
আশফাক নিপুন : এটাই হচ্ছে এই আন্দোলনের বিউটি। হ্যাঁ, প্রাথমিকভাবে আমাদের অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে, তবে এই আন্দোলন আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবেই আমরা লেজুড়বৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আপনি যখন রিফর্ম করেন, কিছু ভাঙা হয় গড়ার জন্য। যদি আপনি জনবান্ধব পুলিশ তৈরি করতে চান, কিছু না কিছু জায়গায় ভাঙবেই। কিছু জায়গায় শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। সেটা হয়ত অনেকের ভালো লাগবে না। মনের মতো হবে না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ পুলিশের মধ্যে এক ধরনের শৃঙ্খলা এই ঘটনার পরে ফিরে আসবে।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ বিভিন্ন সময় কারাবরণ করেছেন, এমনকি কারাগারে মৃত্যুও হয়েছে।
আশফাক নিফুন : আমি শুরু থেকেই সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের বিপক্ষে ছিলাম। যেটা আগে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ছিল। আমি আন্দোলনও করেছি, রাস্তায় দাঁড়িয়েছি, রেগুলার লেখালেখি করেছি। যদিও এই আইন তৈরি হয়েছিল অনলাইনে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য, কিন্তু বিগত সরকার অনলাইনে মানুষকে যতটা না নিরাপত্তা দিয়েছে তার চেয়ে বেশি ভোগান্তি দিয়েছে। বিরোধী মত দমন করার জন্য যেভাবে এই অ্যাক্ট ব্যবহার করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ সবসময়ই ছিল, এখনও আছে। জনগণের স্বার্থে যদি কোনো আইন করতে হয় সেটা যেন অবশ্যই জনবান্ধব আইন হয়। এই অত্যাচারের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, জনমত চাপিয়ে রাখার হাতিয়ার যেন না হয়- আমার জোর দাবি থাকবে। মত প্রকাশের জন্য সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট কোনোভাবেই কাম্য নয়।
‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজের সেটে মোশাররফ করিমকে দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন
চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি।
আশফাক নিপুন : চলচ্চিত্রের সেন্সরশিপের বিলুপ্তি নিয়ে আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি। ব্রিটিশ আমলের সেই পুরোনো সেন্সর বোর্ড এখন আস্তাকুড়ে চলে গেছে। পৃথিবীর কোথাও এখন সেন্সর বোর্ড নেই। এখন হচ্ছে সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ড। সার্টিফিকেট দিয়ে দেয় মানে গ্রেডিং সিস্টেমে চলছে। ১৬, ১৪, ৯ বছর বয়সীদের উপযুক্ত বা প্যারেন্টাল গাইডেন্স যেটা জেনারেল যেটা সবাই দেখতে পারবে উন্মুক্ত। আমাদের আসলে সার্টিফিকেশন বোর্ড চালু করতে হবে। কারণ সেন্সর বোর্ড দিয়ে যুগে যুগে নির্মাতাদের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা হয়েছে। আমরা যদি এনামুল করিম নির্ঝরের ‘মলুয়া’, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’, অং রাখাইনের ‘বাইসাইকেল’ অথবা ভেরি রিসেন্টলি সাজ্জাদ খানের ‘কাঠগোলাপ’, রায়হান রাফির আরেকটা চলচ্চিত্র ‘অমীমাংসিত’ এগুলো আটকে দেয়া হয়েছে। এর মূল কারণ সেন্সর বোর্ড। একটি সুস্থ, সাংস্কৃতিক সমাজে সেন্সর বোর্ড থাকতে পারে না। শিল্পে কখনও সেন্সর বোর্ড চলবে না যত খারাপ শিল্পই হোক না কেন। খারাপ শিল্প হলে দর্শক, জনগণ সেটা প্রত্যাহার করে নেবে অথবা ছুড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু শিল্পে অবশ্যই সেন্সরশিপ থাকা যাবে না। সেন্সরবোর্ড প্রথা অবিলম্বে বিলুপ্ত হোক।