ক্যাম্পাস

ছাত্রলীগের নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন বাকৃবি শিক্ষার্থীরা

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের দ্বারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এতদিন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য ছিল সীমাহীন।

তাদের ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপত্যের কারণে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাননি। কিন্তু গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন তারা। ছাত্রলীগের ভয়াবহ নির্যাতনের কথা তুলে ধরছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে।

ফেসবুকে দেওয়া এসব পোস্ট সামনে আসলে কথা হয় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ভুক্তভোগীরা জানান, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশরাফুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। শিবির বা ছাত্রদল সন্দেহে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনজন শিক্ষার্থীর উপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর ক্লাস শেষে আশরাফুল হক হলে ফেরার পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাকে গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে মোবাইল তল্লাশি করেন। তল্লাশি শেষে ছাত্রদলের লোকজন আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে আছে এবং রেটিনা কোচিংয়ের পেজে লাইক দেওয়ার কারণ দেখিয়ে শিবিরের সদস্য বলে চিহ্নিত করে। পরে আমাকে সালমান ভাইয়ের রুমে (২৩৬ নং রুম) নিয়ে সেখানে ছাত্রলীগ নেতা সৌরভ, আল মামুন, এবং দুর্জয় শারীরিকভাবে আঘাত করতে শুরু করে। এছাড়াও নুহাশ, অন্তর, মিনহাজুল, অন্তর চৌধুরী এসে পাশবিক নির্যাতন করে। পরক্ষণে সালমান কয়েকটি থাপ্পড় দেওয়ার পর আজহার রড দিয়ে পেটাতে থাকে। এক পর্যায়ে আমার দুই কানের টিমপ্যানিক মেমব্রেন ফেটে যায়।

তিনি বলেন, এ অমানুষিক নির্যাতনের পর সাতদিনের মতো বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। কানের অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, আমাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অপারেশন করাতে হয়েছে। আমি ঘটনার সুস্থ বিচার চাই এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনু্যায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।

আশরাফুল হক হলের আরেক আবাসিক শিক্ষার্থী রিফাত বিন শায়েকুজ্জামান বলেন, গেস্টরুমে নির্যাতনের কারণে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বের হওয়ার সময় সিনিয়ররা আমাকে গেস্টরুমে নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পর আমার উপর অমানবিক নির্যাতন করে। তামিম মাহমুদ আকাশ আমার বুকে ১০-১২ বার লাথি মারে। পরে আমাকে তিনতলায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ প্রচণ্ড মারধর করতে থাকে। আজহার খান ও আকাশের মারধরের এক পর্যায়ে আমার কানের পর্দা ফেটে গিয়ে রক্ত বের হয়। এরপর শহীদ শামসুল হক হল ছাত্রলীগ নেতা মো. সেন্টু  এসে আমাকে সিগারেট ধরাতে বলে। প্রথমে আমি রাজি না হলে পরে সিগারেট ধরাতে গেলে আমাকে থাপ্পড় দিয়ে ফেলে দেয়। এ সময় সে আমাকে হকিস্টিক দিয়ে মারতে থাকে। প্রচণ্ড জোরে আমার হাটুতে মারলে আমি আর মাটি থেকে উঠতে পারিনি।

কৃষি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমাকে গেস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে জানতে পারি হলে ছাত্রদল সন্দেহে কয়েকজনকে ধরা হয়েছে এবং তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। আমাকে গেস্টরুম থেকে ২৩৪ নং রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পর প্রথমেই সালমান মোস্তফার থাপ্পড় খেয়ে ফ্লোরে পড়ে যাই। এরপর আজহার এসে আমার হাটুতে সজোরে রড দিয়ে আঘাত করেন। পরে আমার ফোন চেক করে ছাত্রদলের মিথ্যা ট্যাগ দেয়। কার্যত আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। শারীরিক নির্যাতনে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং আমি বমি করি। পরে আমাকে দুই ডোজ ঔষধ খাওয়ার পর আবারও আমাকে ১০-১২ জন থাপ্পড়সহ রড দিয়ে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। আমি হেলথ কেয়ারে চিকিৎসার জন্য গেলে অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিৎসকরা আমাকে দ্রুত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা অন্তর চৌধুরী জানান, আমি তাকে চিনি না। ঘটনাটি আমার জানা নেই।

অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা সালমান মোস্তফা বলেন, আমি এটা সম্পর্কে জানি না। আমি ওইদিন ঘটনাস্থলে ছিলাম না। তবে কোনো কিছু নিয়ে সে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে।

অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা নুহাশ বলেন, আমি করোনার পর থেকে রাজনীতিতে আর জড়িত না। বর্তমান কমিটিতে আমার কোনো পদ পদবি নেই। যেখানে রাজনীতিতেই নেই সেখানে শিবির সন্দেহে কাউকে পেটানোর অভিযোগ ভিত্তিহীন।

অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা মো. সেন্টু বলেন, ঘটনা ভিত্তিহীন। আমি এমন কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমি শামসুল হক হলে ছিলাম, আশরাফুলে একদিনও থাকিনি। আমি হলে ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছিলাম। এর মধ্যে এমন কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মামুন ফোন ধরে কেটে দেন। সৌরভের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়, বাকিদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যত প্রশাসন না থাকায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নির্যাতনের প্রেক্ষিতে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা জানা সম্ভব হয়নি।