প্রায় নয় মাস যুদ্ধ শেষে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের ত্যাগ ও ইজ্জতের বিনিময় স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব দেশের মর্যাদা লাভ করে। সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার মানুষ। সেখানে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অপ্রশংসনীয়।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ছাত্ররা জান-মাল দিয়ে দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রতিবাদী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। দেশের প্রায় প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা আজ অসহায়। প্রত্যেকটা সেক্টরে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তরুণ সমাজ তার যোগ্যতা অনুযায়ী তেমন কোনো ভালো কাজে যোগদান করতে পারছে না। দুর্নীতির কারণে তরুণ সমাজ আজ হতাশাগ্রস্ত।
গত কয়েক বছরে যে পরিমাণ দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে, তাতে সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষিত বেকার। যারা লোক লজ্জার ভয়ে নিম্ন শ্রেণীর কাজও করতে পারছে না আবার তার যোগ্যতা অনুযায়ী একটা ভালো চাকরিও পাচ্ছে না। তারা তৈরি হচ্ছে পরিবারের বোঝা এবং সৃষ্টি হচ্ছে তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা। তথাকথিত সিস্টেমের কারণে তারা যে তাদের যোগ্য স্থানে যেতে পারছে না, সেটা কাউকে বলতেও পারছে না এবং মেনেও নিতে পারছে না। কিন্তু এই তরুণ সমাজে ভূমিকা রেখেছে পূর্বের ঐতিহাসিক সকল সংগ্রাম অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে।
আমরা যদি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৫২’র ভাষা আন্দোলনের কথা চিন্তা করি, তাহলে অনায়াসে আমাদের উত্তর পেয়ে যাব। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে আমাদের রফিক, শফিক, বরকতসহ নাম না জানা অনেক শিক্ষার্থী ভাষা আন্দোলনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। আবার আমরা যদি এই কিছুদিন আগের কথায় চিন্তা করলে দেখতে পাব, এই তরুণ সমাজের কারণে দেশে নতুন শাসনব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। যেখানে শহিদ হয়েছেন আবু সাঈদের মত বীর সাহসী একজন শিক্ষার্থী। আবু সাঈদ ছাড়াও আমরা স্মরণ রাখতে চাই সেই মুগ্ধকে। যে ‘পানি লাগবে, পানি লাগবে’ বলে সবাইকে জিজ্ঞেস করছিল। কিন্তু এত ত্যাগ ও জীবনের বিনিময়ে তরুণরা কি পেয়েছে অধিকার?
আজ বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকা মধ্যে অন্যতম। দেশের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে চলেছে দুর্নীতি। যোগ্য ব্যক্তি যোগ্য স্থানে তার অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি। সামান্য পুলিশে চাকরির জন্য অনেককে দিতে হয়েছে কয়েক লাখ টাকা। যেটা দেশের জন্য খুবই হতাশা ও লজ্জার। উন্নত বিশ্ব যেখানে তরুণ সমাজকে নিয়ে উন্নতি শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে চলছে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিযোগিতা। দেওয়া হচ্ছে না তরুণদের অধিকার । ভাষা আন্দোলনে মাধ্যমে বাক স্বাধীনতা পেলেও কেউ বলতে পারেনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু তরুণদের দমিয়ে রাখতে পারেনি।
আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মাত্র ১৭ বছর বয়সে গঠন করেছিলেন সামাজিক সংগঠন ‘হিলফুল ফুজুল’। মাস্টারদা সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম বসু, প্রীতিলতারা তারুণ্যে বুক পেতে দিয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সম্রাট বাবর, সম্রাট আকবর, নেলসন ম্যান্ডেলা, মোহাম্মদ বিন কাশেম, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী, বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়সহ বহু বীর সেনা ও মনীষী তাদের কৃতিত্ব অর্জন করেছে তরুণ অবস্থায়।
তরুণ অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের বিখ্যাত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য । তিনি এই তরুণ অবস্থার মনোভাব পোষণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন এক বিখ্যাত কবিতা ‘আঠারো বছর বয়স’ । এছাড়াও অনেক মনীষী এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন । তারা তরুণদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
এমনকি জাতিসংঘ তরুণ অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। আমরা যদি বিখ্যাত ফেসবুকের মালিকের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাবো তিনি তরুণ বয়সে সেটা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। আবার মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসও তরুণ বয়সে হয়েছেন বিলিয়নিয়ার। তাহলে তরুণরা অবহেলিত কেন?
আজ তরুণরা দেখিয়ে দিয়েছে তারা কী পারে। তরুণরা যেমন দেশ রক্ষার্থে গর্জে ওঠে তেমনি দেশের সংস্কার উন্নয়নেও মেধার বহিপ্রকাশ ঘটায়। আমাদের দেশে সংঘটিত কোটা সংস্কার আন্দোলন পরবর্তীকালে দেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা রাস্তা পরিষ্কার, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, দেওয়াল চিত্র, ক্যালিওগ্রাফি, উপাসনালয় পাহারা, বাজার তদারকিসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে লিপ্ত হয়েছেন। এমনকি ট্রাফিকের কাজও দক্ষতার সঙ্গে করছেন। সেই সঙ্গে নিজ নিজ এলাকার নিরাপত্তার কাজেও তৎপর আমাদের তরুণ প্রজন্ম। তাহলে কেন তারা অবহেলিত থাকবে?
আজ জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত। এখন সময় এসেছে এই লজ্জা থেকে নিজেকে মুক্তি পাবার। সময় এসেছে দেশের সর্বস্তরে শিক্ষিত তরুণদের নিয়োজিত করে দেশকে নতুন রূপে তৈরি করার। মেধা, মনন শক্তি, সততা, নৈতিকতা ইত্যাদি সবকিছু কাজে লাগিয়ে এক নতুন দেশ তৈরি করা, যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। যেখানে থাকবে না দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হয়েও দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। কেন ঘুরতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয় আসন বরাদ্দের আগে প্রশাসনের কি উচিত ছিল না, যে পরিমাণ শিক্ষার্থী প্রতি বছর পাশ করিয়ে বের করছি তারা কোথায় যাবে সেটা ভাবার? তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান কী হবে? তারা কি দেশের মূল্যবান সম্পদ হবে নাকি আবর্জনা হবে? কোন উত্তর নেই।
তাই প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয় ‘নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মান’। প্রয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা কমিয়ে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে তার পড়াশোনা শেষ করার পরে যেন চাকরির মুখ দেখতে পারে, হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অকালে আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যক্তিগত অপরাধে জড়াতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করা।
পরিশেষে বলতে চাই, দল মত নির্বিশেষে হোক একটা নতুন আধুনিক গ্রহণযোগ্য বাংলাদেশ। যেখানে প্রয়োগ হবে গণতন্ত্র, থাকবে বাকস্বাধীনতা, তৈরি হবে মেধাবীদের স্থান, থাকবে নিজ যোগ্যতায় নিজের স্থান গড়ে তোলার সুযোগ। (লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া)