সারা বাংলা

ঋণে-অভাবে দিশেহারা ছাত্র আন্দোলনে নিহত আবু সায়েদের পরিবার

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই বিকালে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় ঘটনাস্থলে মারা যান আবু সায়েদ (৪৫)। এরপর থেকে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে তার পরিবারের সদস্যরা।

মাথায় ব্যাংকের ঋণের বোঝা, দিতে হবে এনজিও ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা। পাশাপাশি রয়েছে দুই বেলা খাবারের চিন্তা। কে জোগাবে সংসারের খরচ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা আবু সায়েদের পরিবার। 

নিহত আবু সায়েদের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের প্রধানহাট এলাকায়। স্ত্রী মাজেদা বেগম, ১০ম শ্রেণী পড়ুয়া ছেলে মামুন ইসলাম এবং মেয়ের ঘরের আড়াই বছরের নাতনি মনিষাকে নিয়ে ছিল সায়েদের পঞ্চগড়ের সংসার। তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে মুদি দোকান করতেন। সেখানে এক ছেলেসহ দ্বিতীয় স্ত্রী রয়েছেন। তবে আবু সায়েদ পঞ্চগড়ে তার সংসার চালানোর জন্য প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে আড়াই হাজার করে টাকা পাঠাতেন। এখন সেই টাকা বন্ধ হয়ে গেছে। 

পরিবারের সদস্যরা জানান, আবু সায়েদ প্রায় এক যুগ আগে ঢাকায় রিকশা চালানো শুরু করেন। মোহাম্মদপুরের বছিলা ৪০ ফিট এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। বছর দুয়েক আগে সেখানে দোকান দেন। ১৯ জুলাই নামাজের পর দোকানের জন্য পলিব্যাগ আনতে সড়কে বের হন। এ সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলের মধ্যে পড়েন। এক পর্যায়ে তার মাথায় গুলি লাগে। এতে ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়েন। সড়কে পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। বাড়ির মালিকসহ স্থানীয়রা উদ্ধার করে জানাজা শেষে তার মরদেহ দাফনের জন্য পঞ্চগড়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। ২০ জুলাই সকাল ৮টার দিকে বাড়ির পাশে তাকে দাফন করা হয়।

সম্প্রতি আবু সায়েদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আবু সায়েদের সাত ভাইয়ের আলাদা পরিবার। আবু সায়েদের মাটির ঘরে তার স্ত্রী ও ছেলে মামুন বসে ছিলেন। সহায় সম্বল বলতে ১৫ শতকের ভিটে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ভিটেটি স্থানীয় কৃষি ব্যাংকে জামানত দিয়ে ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ঢাকায় পানের দোকান শুরু করেন। কিছু টাকা পরিশোধ করার পরও সেই ঋণ এখন সুদে আসলে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার। এছাড়া সংসার চালানোর জন্য একটি এনজিও থেকেও ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তাকে দেন স্ত্রী মাজেদা বেগম। সেই ঋণের প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয় ১ হাজার ৬০০ টাকা। পরিবারে ঋণের বোঝা রেখে চলে গেলেন আবু সায়েদ। 

নিহত সায়েদের স্ত্রী মাজেদা বেগম বলেন, ‘মৃত্যুর একদিন আগে আমার স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছে। শুক্রবার কিস্তির টাকা পাঠানোর কথা বলেছিল। পর দিন শুনি তাকে নাকি গুলি করে মারা হয়েছে। তিনি ছাড়া তো আমাদের সংসার চালানোর আর কেউ নেই। মরদেহ আনার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেখানের বাড়িওয়ালা নাকি টাকা তুলে লাশটা পাঠিয়ে দিয়েছেন।’ 

সায়েদের ছেলে মামুন ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবার তো কোনো অপরাধ ছিল না। পত্রিকায় দেখেছি, বাবার মৃত্যুর ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমরা কী এর বিচার পাব। ঘটনার পর থেকে সাংবাদিক ছাড়া কেউ খবর নেয়নি। এর আগে প্রশাসন থেকে দুই জন এসেছিলেন। বাবার পাঠানো টাকায় মায়ের ওষুধ, এনজিও ঋণের কিস্তিসহ সংসার চলত। বাড়ির জমি বন্ধ রেখে বাবার নেওয়া ৪৫ হাজার টাকা এখন ১ লাখ ২০ হাজার হয়ে গেছে। গত মাসে ব্যাংক থেকে নোটিশ এসেছে। এখন আমাদের কী হবে?’

নিহতের বড় ভাই সমেত মিয়া বলেন, ‘আমরা সাত ভাই ও এক বোন। আবু সায়েদ ঢাকায় ছোট দোকান করতেন। সেখানে তার আরেকটা সংসার ছিল। এরপরও নিয়মিত বাড়িতে কিছু করে হলেও টাকা দিতেন।’ 

ঢাকার বছিলা এলাকার সায়েদের ভাড়া বাড়ির মালিক মো. তুষার মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আবু সায়েদ ভাই সহজ-সরল এবং ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি কীভাবে মারা গেছেন জানি না। তবে খবর পাওয়ার পর আমি যাই। এখানে তার এক শ্যালকসহ দোকান করতেন। তিনিসহ আমরা এলাকার লোকজন তার মরদেহ পঞ্চগড়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। ভাড়া দ্বিগুণ দিলেও শুরুতে যেতে চায়নি। পরে মারকাজুল সংগঠনের মাধ্যমে ২৭ হাজার টাকা ভাড়ায় একটি অ্যাম্বুলেন্স জোগার করি। সেই টাকা সকলে মিলে দিয়েছি। টাকা নেই শুনে স্থানীয় অনেকে নিজ উদ্যোগে ১০০০, ২০০০, ৫০০, ১০০, ৫০ টাকা চাঁদা দেয়। সেই টাকায় তার মরদেহ পঞ্চগড়ে পাঠানো হয়।’

বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহরিয়ার নজির বলেন, ‘আবু সায়েদের মৃত্যুর খবর শুনে আমরা তার বাড়িতে যাই এবং কিছু খাদ্য সহায়তা করা হয়েছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন দেওয়া হয়েছে। আবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠানো হয়েছে। আশা করি, পরিবারের জন্য দ্রুত কিছু একটা করা হবে।’